১
চলতি বিশেষণে তিনি নিতান্তই জাতীয় সংবিধানের প্রণেতা। একটু পরিশীলিত উচ্চারণে, পিছড়ে বর্গ আর দলিতের মসিহা। আজ, ২০২১-এর গ্রীষ্মে, তাঁর ১৩০ পূর্ণ করা জন্মদিনে, ভোটে তেতে পুড়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে বাবাসাহেব আম্বেদকর থেকে থেকে প্রাসঙ্গিক। তাঁর জন্মদিনের আগের দিনেও হইচই, শোরগোল অব্যাহত: গণতান্ত্রিক ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোগুলির পলেস্তারা কি খসে পড়ছে একের পর এক? প্রশ্ন উঠছে, ভোটসর্বস্বতার বাইরে, সংসদীয় আবহে জনগণেশের প্রতিনিধিত্ব কতখানি? আমি যে রাজ্যের নাগরিক, সেখানে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় নতুন মোড় নিয়েছে জাতপাতের রাজনীতি। বাবাসাহেব এ সবের কোন উত্তর হাতড়াতেন আমরা জানি না, তবু মনে হয়: তিনি আর আমরা হয়তো দাঁড়িয়ে রয়েছি, একই সমতলে, একই চৌরাস্তায়।
২
কদিন আগেই তো নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী বললেন – সংসদীয় গণতন্ত্র ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘলালিত আত্মা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এ দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য। তথ্য হিসাবে তা ঠিক না কি ভুল – সেই জরিপ সমাজবিজ্ঞানী করবেন। কিন্তু কথাটা শোনা ইস্তক মনে হল মনে হচ্ছে, সংবিধান নিয়ে নেহরুবাদী ভাবনার রেশ ছিঁড়ে তবে কয়েক দশক এগিয়ে এল আমাদের দেশ! একদা এ দেশে সংবিধান ছিল সুলিখিত ও গুরুভার ধর্মসংহিতা-বিশেষ: মন্ত্রপূত কৌশলে যা ধরে রাখবে দেশের আইন, বিচার ও সংসদ। আজ যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁরা মনে করেন – ঐ, প্রধানমন্ত্রী যেমন বললেন আর কি: গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংবিধান থেকে উৎসারিত নয়, বরং গণতন্ত্র উপ্ত রয়েছে ভারতের ক্লাসিকাল ঐতিহ্যের নিগড়েই। টেলিভিশনে একদা বিজেপির এক তাত্ত্বিককে দিল্লির শীতাতপ কনক্লেভে বলতে শুনেছিলাম: রাষ্ট্র মানে কি কেবলই মানচিত্র, সংবিধান ও জাতীয় পতাকার নিট যোগফল? রাষ্ট্রভাবনা এই দেশের অন্তঃশীল ও দীর্ঘলালিত সংস্কার – আরএসএসের আমলে এই তাত্ত্বিক সরণটুকুও খেয়াল রাখার।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
৩
নাগরিক হিসাবে অস্ফূটে কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধে কেবল। মনে হয়: গণতন্ত্র কি তবে কেবলই জাতীয়তাবাদী অহমিকা বিশেষ? নিছকই সুপার মার্কেটে বউনিযোগ্য রাষ্ট্রীয় অহংবোধের তুখোড় কাঁচামাল? নরেন্দ্র মোদী যে দেশের সনাতন সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত হন, সেই দেশেই হাজার বছরের ও পারে জন্মেছিলেন এক স্থিতপ্রজ্ঞ ও জিতেন্দ্রিয় ভাবুক। তাঁর শিষ্যদের মহাবীর বুঝিয়েছিলেন অনেকান্তবাদের বিচিত্র কিসিম। ধরা যাক, চার দৃষ্টিহীন পরখ করছে একটা মোটাসোটা হাতিকে। কেউ হাত বুলোচ্ছে, ছুঁয়ে দেখছে, শুঁড়টুকু জরিপ করছে, কেউ দু-কান… মহাবীর বুঝিয়েছিলেন, জ্ঞানের দস্তুরই এমন। হাতিটি এক হতে পারে, কিন্তু হাতি বিষয়ক যে জ্ঞানের সংবেদ বাসা বাঁধে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়ে, তা অনেকান্ত, অপার সম্ভাব্যতাময়। শুঁড়ও হয়ে উঠতে পারে একটা হাতি, আবার ল্যাজও। একটা হাতি তখন আর কেবলই একটা হাতি থাকে না আর। বরং, সেই গহ্বরে জমাট বাঁধে হাতি বিষয়ক অগুনতি সত্যের টুকরো। প্রত্যেকেরই হক রয়েছে জ্ঞানে, প্রত্যেকেরই হক রয়েছে নিজস্ব সত্যের নির্মিতিতে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে, অন্যের সত্যভাবনার প্রতি সম্ভ্রমবশে বিনত হওয়াটাই এ-দেশের দস্তুর। অপরের সত্যবোধকে দুচ্ছাই করলে, ঘৃণা করলে জন্ম নেয় বিপুল হিংসা: যা, মোদ্দায়, গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী। বাবাসাহেব জানিয়েছিলেন একদা: তাঁর গণতান্ত্রিকতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথানুগ চর্চা থেকে জন্ম নেয়নি কখনো, বরং তার রেশ লেগে এক গভীর, সচেতন ধর্মবোধে। এই ধর্মচেতনা গোপনে হিংসার কথা ফেরি করে না, বরং তা ধাবিত হয় ধ্রুব, ঋজু ও আবহমান সত্যের গন্তব্যে – যা অন্যকে আঘাত করতে বলে না; এবং একটি তুচ্ছ, মর জীবকেও অনন্ত বিশ্বশৃঙ্খলের সজীব উপাদান বলে মনে করে। সেই ধর্মবোধ বেঁচে থাকে প্রাত্যহিকী রাজনীতির থেকে দূরত্বে, নশ্বর দুনিয়ায় রাজনীতির কূটক্রীড়ার থেকে আসমান-জমিন ফারাক তার।
৪
তাই ভাবছিলাম, ভোটের ভরা বাজারে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গেল কোথায়? অথবা সেই গভীর ধর্মবোধ? ধরুন, গণপ্রতিনিধিত্ব। কে না জানে, ভারতীয় রিপাবলিকের হট্টমেলায় এই প্রতিনিধিত্বের শর্তটিই আদত প্রাণভোমরা! আমার আর হবু বিধায়কের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মত: আমি জানি, এক বার তাঁকে, ঐ নির্দিষ্ট প্রতীকে জেতাতে পারলে তিনিই সংসদে হয়ে উঠবেন আমার কণ্ঠ, দৃষ্টি ও আত্মা। আদর্শ জনপ্রতিনিধি তো তিনিই, যিনি জনগণের শূন্যতা যথাযথ ভরাট করেন আইনসভায়। অথচ গত কয়েক বছর যাবৎ দেখছি এক বিচিত্র সার্কাস: জনতার ভোটে জিতে, নির্লজ্জ ভোটভিক্ষার পর, সময় বুঝে, প্রকাশ্য দিনের আলোয় সামাজিক চুক্তির খেলাপ ঘটিয়ে অচানক রংবদলু। নাগরিক ও প্রতিনিধির পারস্পরিক সংলাপে এর চেয়ে গুরুতর থাপ্পড় বোধহয় অসম্ভব। থেকে থেকে মনে হয়, গণতান্ত্রিক নৈতিকতা, বাবাসাহেব-প্রণীত সংবিধানের পৃষ্ঠাগুলিতে যে গণতান্ত্রিক আদর্শ অভিব্যক্ত – তার সারবস্তু ছিল এই নৈতিকতার বোধ: আমি যখন কথা বলি, সোচ্চার ফেটে পড়ি, কিংবা প্রকাশ করি আমার স্বাধীন ইচ্ছে, প্রতিনিধি কথা বলেন আমার হয়ে। যথার্থ গণতন্ত্র ছাড়া আম নাগরিক ও নেতার এই পারস্পরিক বন্ধুতা কার্যত অসম্ভব।
৫
ভারতে ঐতিহাসিকভাবেই গণতন্ত্রের ভূমিকা নিহিত ছিল সংসদে, খবরের কাগজে: জনপরিসর নির্মাণে, বিতর্কে, প্রতিযুক্তিতে। ভারতমাতার চরণতলাশ্রয়ে একান্ত গুটিসুটি মারা ভক্তিবাদকে গণতন্ত্র, অন্তত আদর্শগতভাবে, কখনোই সমর্থন করবে না– সে কখনোই প্রশ্রয় দেয় না এমন কোনও বিগ্রহকে, যে অদ্বৈত সত্তার বেবাক হাঁ গিলে নেবে যাবতীয় কূট বিরুদ্ধতা ও সপ্রশ্ন সংশয়। রাজানুগ্রহে, জোড় হাত প্রণামীতে কিংবা অলৌকিক জাতীয় সত্তার বিপুল নির্মাণে গণতন্ত্রের চিঁড়ে ভেজে না। অথচ এ দেশে আজ যেন তা-ই হচ্ছে – গণতন্ত্রের কাঠামোয় পড়ছে আধ্যাত্মিক কোনও দেবদূতের পোঁচ। প্রশ্ন ওঠে, কী নিয়ে কথা বলবে গণতন্ত্র? দীর্ঘ সময় পর্যন্ত, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ফর্মুলা মেনেই, এ দেশের মোদ্দা গণতান্ত্রিক রিচুয়াল, মানে নির্বাচনগুলো, টিকে ছিল জনতার চাওয়া-পাওয়ার রাজনীতির ওপর। এই চাওয়া এবং পাওয়া ঠিক আদর্শরহিত কাস্টমার কেয়ারের পরিষেবাভিত্তিক রাজনীতিও নয় – তার মধ্যে নিহিত রয়েছে আদর্শগত বিরোধিতা, রাষ্ট্রক্ষমতার বিপ্রতীপে যাওয়ার সাহসিক ভঙ্গিও। এমন এক ভারতের ছবি আঁকা হয়েছিল, যুক্তিবাদ, প্রতিবাদ, তর্ক হবে যার সম্বল। এবং ভাবা গিয়েছিল, এই উপাদানগুলিই শ্রেয় কোন আলোকবৃত্তে নিয়ে আসবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে।
৬
ভুবনায়নের ঋতুতে যখন মানবিক ও চিন্তাশীল সব কিছুই খোলা হাটে বিকিয়ে যায়, গণতন্ত্রেই বা তার বিরাট ব্যত্যয় হবে কেন? কালে কালে আম মানুষের অধিকারের রাজনীতি ছেয়ে দেখা দিল পণ্যায়িত গণতন্ত্রের ইমারত। এই নতুন স্থাপত্যে, আদর্শ ইত্যাকার শব্দগুলি মামুলি খড়কুটো মাত্র, তার কোন দৃঢ় ভিত্তি নেই। অস্থিরমতি শেয়ার বাজারের জুয়ো খেলায় আবহাওয়া মাফিক পণ্যের দাম যেমন ওঠে এবং পড়ে, রাজনীতির এই নতুন ভাষ্যেও পণ্যরতি, বিগ্রহপুজো, ব্যক্তিত্বের নতুন সব অভ্রংলিহ মিথ নির্মাণের বাজার গড়ে উঠল। এবং সচেতন, তার্কিক কোন নাগরিকের শূন্যস্থানে আসীন হল আদর্শ বিযুক্ত বাঁধা খদ্দের। হাওয়া যে দিকে, তিনিও সে দিকেই থাকবেন। উত্তরোত্তর পণ্যরতির এই করাল মেঘে যে কোনও মোহোত্তীর্ণ সংশয়ই টিকে থাকতে পারে না। ফলও হয়েছে তাই। ব্যক্তিত্বের প্রভা আজ তার গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতিকে ঢেকে দিতে পেরেছে৷ বাজারের যেমন পোক্ত কোন নিশানা থাকে না, যখন-যেমন-তখন-তেমনের প্রগলভ রাজনীতি তেমনি ভাবেই নন-ইস্যুকে ইস্যু করে দেয়। কৃষিক্ষেত্রের দুরবস্থাকে আড়াল করে দেয় সিয়াচেন-বাহিত দূরাগত বক্তিমে। হাতের কাছে, ফলত, খবর হয় না।
৭
বহু দিন অব্দি আর কে লক্ষ্ণণের আঁকা কমন ম্যানই ছিল আমার স্বদেশ। সেখানে একটা টেকো লোক ছিল, চেকশার্ট-পরিহিত, চশমাচোখ: হেঁটে চলেছে কালো কালো তুলির আলপথ ধরে। কিংবা জনি ওয়াকার, যার মাউথ অর্গানে সাবলীল বেজে উঠত কমন ম্যানের ছুটির দিনের মেরিন ড্রাইভ। আজ কি মনে হয় না, ভারতীয় গণতন্ত্রের তামাম ইতিহাসটাই এক আস্ত বিষণ্ণ স্ববিরোধবিশেষ? কমন ম্যানটি অবলুপ্ত। সূর্য ডুবলে ইদানীন্তনে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে বহুল-প্রচারিত দাঙ্গার ভিডিও দ্যাখেন। রিপাবলিকের জায়গা নিয়ে ফেলে রিপাবলিক টিভি। সচেতন শুভ বোধ খোয়া গেছে ভোটবাজারে। নিরঙ্কুশ স্বৈরের আবহে হারিয়েছে নাগরিকের ক্রমমুক্তি।
৮
আম্বেদকরের পথ-হাঁটা এখনও থামে নি। এক থেকে বহু হয়েছেন – এগিয়ে চলেছেন পরাজিত অধিকারের সনদ হাতে। চোখে চশমা, কাঁধে ঝোলা।
ডঃ আম্বেদকর, ভারতীয় সংবিধান ও জাতীয় পতাকা – ছবি Wikimedia থেকে
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।