~সৌমি জানা~
সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আমাদের শৈশব থেকেই কোনগুলো স্বাভাবিক এবং কোনগুলোকে ভয় পেতে হয়, ঘৃণা করতে হয় শিখি। যেমন ধরুন আমরা আম গাছকে আম বলতে শিখি, জাম গাছকে জাম বলতে শিখি। ঠিক সেরকমই আমরা মুসলিম শব্দ এবং জাতটাকে ঘৃণা করতে শিখি। এটাই স্বাভাবিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় আমাদের কাছে। নিজেদের অজান্তে হোক বা সজ্ঞানে, আমরা এই বিদ্বেষগুলো ওগরানোর অপেক্ষায় থাকি। ‘মুসলিম’ শব্দটা এতটাই আপত্তিকর যে এর উল্লেখে পুরো ছাত্রসমাজের মহিমা ধুলোয় মিশে গেছে। বলা হচ্ছে মেধাই তো একমাত্র পরিচয় ছাত্রীর। আইডেন্টিটি পলিটিক্সের মাধ্যমে রাজ্য সরকার তোষণের রাজনীতি করছে। রাজ্য সরকারের সঙ্গে হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও এই জায়গায় কি দ্বিমত হওয়ার জায়গা আছে, যে রাজনৈতিক প্রয়োজনেই রুমানার পরিচয় মুসলমান বলা হলেও ক্ষতি নেই? মুসলমান পরিচয়টি কি লজ্জার? বা গোপন রাখার বিষয়? কবীর সুমন বলেছিলেন “আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে”। সেখানে তার সাঁওতাল পরিচয় একজনের পরিচয়কে বা জন্মগত সত্তাকে তুলে ধরার একটি বিপ্লবী ও প্রগতিশীল ধারণা। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মেইনস্ট্রিম ডিসকোর্স বা সংখ্যাগুরুর প্রাধান্যের প্রাত্যহিক মানসিক নিপীড়নের এজেন্ডা এবং স্বাভাবিকীকরণকে উল্টে দিচ্ছে। রুমানার বিষয়টি একদম তাই। আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মুসলিম বিদ্বেষের বিচ্ছুরণের দরুন আমরা মুসলিম তোষণের সাম্প্রদায়িক ধারণাকে মান্যতা দিয়ে ফেলছি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংখ্যাগুরু আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলমানদের এই উঠে আসা আমাদের চোখে বিপদ বা আশঙ্কা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মুখে মেধার, শিক্ষাক্ষেত্রের অজুহাত দিলেও গোড়াটা কিন্তু একই।
ঠিক এভাবেই আমরা বলে থাকি, দেশের জেনারেল ছেলেমেয়েদের ‘যোগ্যতার’ ভিত্তিতে প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এস সি, এস টি ছেলেমেয়েরা, যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত। অথবা মহিলারা তো নিজের পরিচয় ব্যবহার করে বাসের সিট থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র সমস্ত জায়গায় সুবিধা নেন। এভাবেই স্বাভাবিকীকরণ হয় বিদ্বেষের।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পরিচয় নিয়ে রাজনীতির কথা বলছেন? এই মুসলিম হওয়ার জন্যই জুনেইদ, আখলাককে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল। মুসলিম হওয়ার জন্য যে বাচ্চা ছেলেটা মন্দিরে জল খেতে গিয়েছিল তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। এই পরিচয়ের জন্যই উত্তরপ্রদেশের দলিত মেয়েটাকে জিভ কেটে গণধর্ষণ করা হয়েছিল, মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে পুলিশ পুড়িয়ে দিয়েছিল দেহ। এই পরিচয়ের জন্যই ধর্মের ভিত্তিতে সিএএ করে দেশ থেকে মুসলিমদের তাড়িয়ে দেওয়ার ছক কষা হয়। এই পরিচয়ের জন্যই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কবর থেকে তুলে মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের নিদান দিয়েছেন। আরও জমাট তথ্য যদি দিই, ২০১৯-এর এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী ৪৫,৯৩৫ জন তফসিলি উপজাতির মানুষকে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তার পরিচিতি বা পরিচয়র জন্য। আমরা মুখে “উহু, আহা” করলেও সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে ধর্ষকাম হয়ে উঠি, যখন এই পরিচিতির জন্যই সংখ্যালঘু ও দলিতরা বৈষম্যের শিকার হয়, মেরে ধর্ষণ করে দেহটা অবধি আস্ত রাখা হয় না।
তাই এই রুমানা একজন ছাত্রী মাত্র নয়। সে একজন মহিলা, একজন মুসলিম, পিছিয়ে পড়া একটা গ্রাম থেকে লড়ে উঠে আসা একজন। এই সমস্ত পরিচয়ের জন্য যে লড়াই তাকে করতে হয়েছে তার স্বীকৃতি জরুরি অবশ্যই জরুরি। শুধু মেধা কারও পরিচয় নয়, হতে পারে না। মেয়ে বলেই তার লড়াই তার প্রথম হওয়া সব কিছু ছাপিয়ে মাথার কাপড়, টপ এগুলো আলোচনার অভিমুখ হিসাবে উঠে আসে। রুমানাকে বেশ কয়েক ধরণের পরিচয়জনিত অসুবিধার বিরুদ্ধে লড়ে এই জয় হাসিল করতে হয়েছে। এর কোনটা কে কী পরিমাণে কাজে লাগাবে সে অন্য কথা। লাগাতেই পারে। কোন আধিকারিক কোন আঙ্গিকে কোন কথা বলেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু সংখ্যাগুরুর প্রাধান্যকে প্রত্যেক মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করা দরকার। রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুদের আরও বেশি করে সামনে নিয়ে আসা দরকার। মুসলিম পরিচয় সামনে আসার জন্য এত রে রে করে তেড়ে আসার আগে বরং একটু সহনশীল হই আমরা। ভুলতে শিখি, চ্যালেঞ্জ করতে শিখি মনের মধ্যেকার বিদ্বেষগুলোকে।
জাত ধর্ম বর্ণ শ্রেণি লিঙ্গ নির্বিশেষে আমার পরিচিতির জন্য যখন আমরা ভায়োলেশন, হিংসা, বিদ্বেষ, বৈষম্যের শিকার হই তখন সেটা আমাদের মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। আমাদের সংবিধানও সেই কথাই বলে। নিজের জাতের জন্য, লিঙ্গের জন্য পিছিয়ে পড়া, সামাজিক বৈষম্যের শিকার মানুষের প্রতি অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন হিসাবে এবং সামাজিক সম্মান প্রতিষ্ঠিত করতে সংরক্ষণ, ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদের মত ধারাকে স্বীকৃতি দেয় আমাদের সংবিধান। রুমানার মানুষ হিসাবে যতগুলি পরিচয় আছে প্রত্যেকটি নিয়েই তিনি আজ আমাদের লড়াইয়ের আইকন। এই মেয়ে জোরের সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছে সমাজ যত বিদ্বেষের বীজ বুনবে, যত ব্রাত্য করবে, ততই উঠে আসবে হাজার হাজার রুমানা। তাই লড়াইটা বিদ্বেষের বিপক্ষে হোক, ইসলামোফোবিয়ার পক্ষে নয়।
নিবন্ধকার নারী আন্দোলনের কর্মী
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।