প্রথমে বাংলাদেশি বন্দীদের কথাই বলি, কারণ জেলে তো অনেকটা সময় বাংলাদেশি বন্দীদের সঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। অবাক লাগে যখন দেখি, যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমাদের এই বাংলায় কত আবেগ, যন্ত্রণা, কত রক্তাক্ত স্মৃতি; সেই বাংলাদেশের বাঙালিরা যখন এই বাংলায় ধরা পড়েন এবং ফরটিন ফরেনার্স অ্যাক্টে তাঁদের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেই বাংলাদেশি বন্দীদের দিয়েই, কলকাতায় যতগুলো সেন্ট্রাল জেল আছে আপনারা খোঁজ নিন, জেলা স্তরের যে সমস্ত সাবডিভিশনাল জেল আছে, সেখানে খোঁজ নিলেও জানতে পারবেন যে ওই বন্দীদের দিয়েই সবচেয়ে নারকীয়, জঘন্যতম কাজগুলো করানো হয়। নর্দমা পরিষ্কার করা, মলমূত্র সাফ করা, বেগার খাটানো — যাকে দিয়ে যা সম্ভব। এমনকি কম বয়স যাদের তাদের ওপর যৌন নিপীড়ন পর্যন্ত চলে।
আমার মনে আছে, বেশকিছু বছর আগে শ্রীলঙ্কার উপকূলে কিছু ভারতীয় মৎস্যজীবীকে এক ইতালিয় জাহাজ থেকে বেশকিছু ইতালিয় নাবিক একদম পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। এ দেশের বিচার ব্যবস্থায় তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আজ পর্যন্ত কারোর হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করলেও অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাদের সরকারের হাতে। কারণ যারা হত্যাকারী, তারা সকলেই ছিল ইতালিয়। প্রথম বিশ্বের উন্নত দুনিয়ার নাগরিক। কিন্তু যদিও বাংলাদেশ আমাদের প্রতিবেশী দেশ এবং সেখানকার বন্দীরা ওই ইতালিয়দের মতই বিদেশি বন্দী, ভারতরাষ্ট্র বাংলাদেশকে যেহেতু ‘উপগ্রহ রাষ্ট্র’ বলে মনে করে, তাই সেখানকার নাগরিকরা এ দেশে বন্দী হলে তাঁদেরও গলগ্রহ বলেই মনে করা হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
একটা ঘটনার কথা বলি। যে সময় জেলে যাই তার কয়েকদিন বাদেই জেলে ‘পাগলী’ হয়েছিল।
প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেল, যাকে কলকাতার অন্যতম হাই সিকিউরিটি জেল বলে গণ্য করা হয়, সেই জেলে পাগলী হওয়া মানে সুপার, জেলার সহ উচ্চপদস্থ স্টাফদের একেবারে ঘুম ছুটে যাওয়া। পাগলী হলো প্রত্যেকটা জেলে দিনে চারবার করে যে গুনতি হয়, সেই গুনতি না মেলা। একটা জেলে সমস্ত বন্দীর সংখ্যা দিনের শেষে মেলানো হয় এবং সারাদিন ধরে সেই প্রক্রিয়াটা চলে। বন্দীদের হাঁটু মুড়ে বসে গুনতি দিতে হয়। যে নিয়ম ব্রিটিশ জমানায় ছিল সে নিয়ম আজও বহাল তবিয়তে আছে। প্রত্যেকটা জেলে সেপাই জমাদার যারা, তারা লাঠি দিয়ে প্রত্যেকের শরীর স্পর্শ করে ঠুকে ঠুকে গুনতি করে। ঠিক ভঙ্গিমায় না বসলে পিঠে দু-চার ঘা পড়াও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
আমরা যে রাজনৈতিক বন্দীরা প্রথম থেকেই এই নিয়ে সরব হয়েছি, বলেছি কোনো শর্তে আমরা হাঁটু মুড়ে বসব না, তাদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঝামেলার পর এটা ওরা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সাধারণ বন্দীদের প্রত্যেককে এটা করতে হয়, যা অসম্ভব অপমানজনক।
সেবার পাগলী হলো আর সারাদিন পর জানা গেল যে গুনতি মিলছে না, অর্থাৎ বন্দীর হিসাবে গরমিল। গুনতি যখন মেলে না আর সেপাই জমাদাররা লাঠি নিয়ে বেরোয়, তখন সামনে যাকে পায় তাকেই এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকে। কারও হাত ফাটে, মুখ ফাটে, মাথা ফাটে। তাতে কারোর কিচ্ছু এসে যায় না। এই সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেপাই জমাদারদের অঘোষিত ছাড় দিয়ে দেওয়া হয়।
তা সেবার গুনতি না মেলায় সারারাত খোঁজার পর জানা গেল দুজন বাংলাদেশি বন্দী জেল থেকে পালিয়েছে। প্রেসিডেন্সির মতো জেল থেকে দুজন বন্দী পালানো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সকালের দিকে আবিষ্কার হল, যেখানে নির্মাণ আর মেরামতির কাজ চলছে, সেখানকারই একটা মই ব্যবহার করে আর সম্ভবত তিন-চারটে বেডশিট একসাথে জড়িয়ে দড়ি বানিয়ে তারা পালিয়েছে। যারা পালিয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল আশরাফ, আরেকজনের নাম কী ছিল খেয়াল নেই। আশরাফের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। শুনেছিলাম তার ইতিহাস এবং এখানে ধরা পড়ার পর যেহেতু বয়স কম ছিল, তাকে কী কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল,হয়তো আমিও নতুন বন্দী বলেই সে মন খুলে বলেছিল আমায়। বেশ কিছুদিন ওদের খোঁজ পাওয়া গেল না। না পাওয়া যাওয়া মানেই ভাল। মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম ওরা অন্তত নিজেদের দেশে পৌঁছে যাক তাদের পরিবারের কাছে, যেখানে অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে পরিবারগুলো ওদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হল। দু সপ্তাহ বাদে জানতে পারলাম যে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে পলাতক দুই বাংলাদেশি বন্দী বারাসাত-বনগাঁর লাইনে কাটা পড়েছে। কী করে পড়েছিল জানি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম, কোনোরকমে সীমান্তের দিকে যেতে চেয়েছিল ওরা, সীমান্ত অবধি পৌঁছতে পারেনি।
যারা পালায় তাদের না হয় পরিণতি অনিশ্চিত। কিন্তু শয়ে শয়ে এমন ঘটনা আছে যেখানে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বছরের পর বছর বন্দী আটকে থাকে বিভিন্ন জেলে। তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য,তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো তরফ থেকেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
আমাদের সাথেই জেলে থাকতেন শাহাবুদ্দিন ভাই। আমরা চাচা বলতাম। চাচা পেটের তাগিদে এম্ব্রয়ডারির দোকান দেবে বলে বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছিল। আইএসআই চর বলে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমরা যখন চাচাকে দেখি তখন চাচার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে বকতো। খালাস হয়ে গেছে, কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই, তার সাথে দেখা করতে আসার কেউ নেই, তার জন্য ভাবার কেউ নেই। এই যন্ত্রণা যে একটা মানুষকে কী ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে নিয়ে যেতে পারে, তা চোখে না দেখলে সত্যিই অনুভব করা যায় না।
বাংলাদেশি বন্দীদের ক্ষেত্রে এবং এ দেশের মুসলিম বন্দীদের ক্ষেত্রে এই যন্ত্রণা আমরা প্রতি মুহূর্তে দেখতাম। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, কলকাতার যে সমস্ত সেন্ট্রাল জেল আছে সেখানে হিসাব করলে দেখা যাবে ষাট শতাংশ বন্দীই মুসলিম শ্রমজীবী মানুষ, যাঁরা চাষের কাজ করেন, খেতমজুরি করেন, দর্জি শ্রমিক, বিড়ি বাঁধেন। বেশিরভাগই অসংগঠিত শ্রমিক। কে তাঁদের উকিলের ব্যবস্থা করবে? কে তাঁদের পাশে দাঁড়াবে? বেশকিছু মুসলিম সংগঠন আছে, কখনও কখনও তাঁরা কিছু উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাঁদের রসদের সীমাবদ্ধতা আছে, উদ্যোগেরও সমস্যা আছে।
কিছু কিছু এন জি ও কখনো কখনো উদ্যোগ নেয়, খবরে আসে, হইচই হয়, আবার চাপা পড়ে যায়। তাছাড়া যদি কোনো উকিল তাঁদের পক্ষে দাঁড়ায়ও, যদি কোনো উকিল খুব দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁদের কেসগুলো নিয়ে লড়াই করে, যদি ইউএপিএ-র মত কেসে তাদের বার করে আনার উদ্যোগ নেয়, তার পরিণতি কী হতে পারে সেটা শাহিদ আজমির ঘটনা থেকে আমরা জানি। শাহিদকে নিয়ে বলিউডে ছবি হয়েছে, গল্প হয়েছে, শাহিদ দৃষ্টান্ত হয়েছে। কিন্তু এটাও বাস্তব যে রাষ্ট্র দেখিয়ে দিতে পেরেছে, যদি কোনও র্যাডিক্যাল মুসলিম যুবক তার সম্প্রদায়ের পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে তাকে কোন পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
শাহিদ তিহার জেলে ছিল। বোম্বাই বিস্ফোরণে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। জেলেই সে পড়াশোনা করে আইন পাশ করে এবং সতেরোটা ইউএপিএ কেসে জামিন করায়। আমাদের দেশে এমন অনেক বাঘা বাঘা উকিল আছেন, যাঁরা একটা দুটো ইউএপিএ কেসেও জামিন করাতে পারেননি। সেখানে শাহিদ আজমি তার সম্প্রদায়ের সতেরো জন মানুষ এবং তার সাথে আরও অনেক মানুষ যাঁরা এইসব কেসে মিথ্যা অভিযোগে আটক ছিলেন, তাঁদের বেকসুর খালাস করায়। তার সর্বশেষ কেস ছিল সেই ২৬/১১-এর কেস, যেখানে সে সামীম আনসারির হয়ে কেস লড়ছিল। সেই কেসের পরেই তাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়।
শাহিদের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? আজ পর্যন্ত কারোর সাজা হয়েছে? কেউ ধরা পড়েছে? প্রত্যেকটা রাজ্যে ২০০৪-এর পর এই স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গড়ে তোলা হয়েছে। স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, স্পেশাল ফোর্স ধরনের কমব্যাট ফোর্স তৈরী করা হয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এগুলো তৈরীর সময় কোনো সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার ধার ধারা হয়নি।
যেমন আমাদের কলকাতায় যখন ২০০৪ সালের পরে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গড়ে তোলা হয়, সেই ফোর্সের হাতে কলকাতার সমস্ত থানার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে এই স্পেশাল টাস্ক ফোর্স পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো থানায় যে কোনো মুহূর্তে অভিযান চালাতে পারে এবং যে কোনো থানার ফোর্স ব্যবহার করতে পারে। এতখানি ক্ষমতা তাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ এনআইএ নিয়ে আমরা যখন কথা বলছি, তখন রাজ্যের এই প্রক্রিয়া নিয়েও কিন্তু আমাদের কথা বলা দরকার। কারণ এই এনআইএ, স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, কমব্যাট ফোর্স, রাষ্ট্রের সামগ্রিক পুলিশিকরণের এই প্রক্রিয়া গত দু দশক ধরে চলেছে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কোটি কোটি ডলার আর ফান্ড এর সঙ্গে যুক্ত এবং একেবারে কেন্দ্রীয়ভাবে এটা নিয়ন্ত্রিত হয়।
পি চিদম্বরম একসময় কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে যে ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টার গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার ধারাবাহিকতাতেই তো এনআইএ গড়ে তোলা হয়েছে। গোটা পৃথিবী জুড়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধে নেমেছিল আমেরিকা, তার ধারাবাহিকতাতেই তো আজ গণআন্দোলনের কর্মীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আজ না হয় বিজেপি অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়েছে, ধর্মের নামে মেরুকরণ করছে, জাতপাতের রাজনীতি করছে। কিন্তু অবস্থাটা কোন আমলে ভাল ছিল? মুসলিম, আদিবাসী, দলিত — কাদের বাকস্বাধীনতা ছিল? কথা বলার স্বাধীনতা কোন আমলে ছিল? আজ ইউএপিএ আইন নিয়ে সিপিএম নেতারা বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানাই। তাঁদের আজকের যে অবস্থান তাকে নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু এই বামফ্রন্ট সরকার ২০০১-০২ সালে কেন্দ্রে অটল বিহারী সরকার যখন ‘পোটা’ আইন আনে, তার ধারাবাহিকতায় এখানেও ‘পোকা’ আইন চালু করতে চেয়েছিলেন স্পেশাল অ্যাক্ট হিসাবে। কেরলে প্রতিবাদী ছাত্রদের তাঁরা বন্দী করে ইউএপিএ আইন প্রয়োগ করেছেন।
আসলে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল, যারা ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে, ঔপনিবেশিক চিন্তা কাঠামোকে ধারণ করে। কারণ যে কাঠামোর উপর আমাদের প্রশাসনিক ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে সেটা তো আইপিসি এবং সিআরপিসি। সেটা কোন সময় গড়ে তোলা হয়? ১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলিম যৌথ কৃষক বিদ্রোহ যখন ব্রিটিশ সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল তারপরেই প্রথম এই ঔপনিবেশিক ল অ্যান্ড অর্ডারের ভিত তৈরি হয়। যে ল অ্যান্ড অর্ডারের প্রক্রিয়ায় গণসম্মতির কোনো স্থান কোনোকালেই ছিল না। পুরোটাই হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকের প্রয়োজনে।
এই ল অ্যান্ড অর্ডারের ধারণার ধারাবাহিকতায় এসেছে অন্য সমস্ত আইন। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে রাওলাট আইন থেকে মিসা বা আজকের ইউএপিএ। আর ইউএপিএ-ও তো আজকের আইন নয়। একসময় শুধু মাওবাদী এবং মুসলিম বন্দীদের ক্ষেত্রেই ইউএপিএ প্রয়োগ করা হতো, আজ সাধারণ প্রতিবাদ করলেও ইউএপিএ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
শাহাবুদ্দিনের কথা আগে অন্য লেখায় লিখেছি। শাহাবুদ্দিন শেখ। জঙ্গিপুরের ছেলে। জঙ্গিপুর কলেজে পড়ত এবং অত্যন্ত মেধাবী ছেলে। যখন সাচার কমিটি পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট বার করে, ওরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিল এবং নিজেদের এলাকায় উদ্যোগ নেয় সাচার কমিটির এই রিপোর্টকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলবে। নিজেরা বন্ধুরা মিলে একটা সংগঠন গড়ে তোলে, নাম দিয়েছিল সংখ্যালঘু স্বাধিকার রক্ষা কমিটি। প্রথম দিকে অনেকেই ওদের সমর্থন করে এবং যথারীতি তৎকালীন শাসক দল বামেরা যেহেতু বিপদে পড়ছে, বিরোধী দলগুলোও কিছুটা সাহায্য করেছিল। কিন্তু যখন গোটা ব্যাপারটা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ জড়ো হচ্ছেন, সচেতন হচ্ছেন, তখন শাহাবুদ্দিন এবং আরো বেশ কয়েকজনকে হুজি জঙ্গি হিসাবে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কোনো দল পাশে থাকেনি।
বারো বছর বাদে সেই শাহাবুদ্দিন বেকসুর খালাস হয়ে প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরোয়। এই ছেলেটার মামাতো, খুড়তুতো, পিসতুতো ভাই বোন, যারা ঘটনাটা চোখের সামনে দেখেছে, যারা দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা সহ্য করেছে, যাদের বাড়িতে রাতবিরেতে পুলিশ এসে অত্যাচার করেছে, লাথি মেরে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে, সার্চ ওয়ারেন্ট আছে কিনা জানতে চাওয়ার পর মেরে দাঁত ভেঙে দিয়েছে, তারা যদি এরপর কোনো জেহাদি দলে নাম লেখায়, আমি অন্তত আশ্চর্য হব না।
কোনো বহুজাতিক কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সের মিটিংয়ে কী আলোচনা হয়, তাদের অন্দরমহলের খবর কি আপনি জানতে পারেন? পারেন না। অথচ বৃহৎ পুঁজি আর কোম্পানির প্রয়োজনে রাষ্ট্র আমার-আপনার মোবাইলে স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দিয়ে সমস্ত ব্যক্তিগত পরিসর উন্মুক্ত করে দিচ্ছে মুনাফার প্রয়োজনে। সেই মুনাফা লোলুপ কর্পোরেটের বিরুদ্ধে লড়াই হলে প্রয়োগ হচ্ছে ইউএপিএ-এনআইএ। আর আমরা প্রত্যেক বছর ভোট দিয়ে ‘গণতন্ত্রের জয়’ উদযাপন করছি।’গণতন্ত্র’ নিয়ে এই আত্মরতি আর মারণঘুম কি শেষপর্যন্ত গোটা রাষ্ট্রের পুলিশিকরণ সম্পন্ন হওয়ার পরই ভাঙবে?
(লেখক গণআন্দোলনের কর্মী, দীর্ঘদিন কারাবাস করেছেন। মতামতের ব্যক্তিগত। তথ্য লেখকের অবগতি অনুসারে)
ছবি NDTV ও The Telegraph India -র ওয়েবসাইট থেকে।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।