১
দেশভাগের যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে স্বাধীন হয়েছিল ভারত। পশ্চিমবঙ্গে তখন বাস্তুহারা মানুষের ভিড়। কয়েক বছর আগেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু অধরা গণমুক্তির স্বপ্ন। ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মিছিলে গুলি চালাল স্বাধীন দেশের সরকার। কলকাতার রাজপথে শহিদ হলেন লতিকা, অমিয়া, গীতা, প্রতিভা- চার জন মহিলা। তার পরে গোটা পাঁচের দশক গণ আন্দোলনে বারে বারে উত্তাল হয়েছে এই রাজ্য। একদিকে উদ্বাস্তু আন্দোলন। মানুষের বসতি গড়া, বিদ্যালয় গড়ার লড়াই। সংঘর্ষ ও নির্মাণের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বামপন্থী দলগুলির নেতৃত্বে উদ্বাস্তু আন্দোলন সেদিন বাস্তুহারা মানুষদের বিরাট অংশকে লাল পতাকার সঙ্গী করে তুলেছিল। ইউসিআরসি, আরসিআরসি প্রভৃতি বামপন্থী উদ্বাস্তু সংগঠনের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। রক্তের বিনিময়ে মানুষ চিনছিলেন স্বাধীনতার স্বরূপ।
ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে রক্তাক্ত হয়েছিল কলকাতা। সেই আন্দোলন বামেদের জমি আরও শক্ত করেছিল। ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদের পাশাপাশি ব্রিটিশ ট্রাম কোম্পানির প্রতি তীব্র ক্ষোভও সেদিন প্রকাশ্যে এসেছিল। তার পরের বছরেই শিক্ষক আন্দোলন। পুলিশের গুলিতে শহিদ হলেন শিক্ষকরা। সারা কলকাতা জুড়ে আন্দোলন দমনের নামে তাণ্ডব চালিয়েছিল পুলিশ। একদিকে কংগ্রেস সরকারের আক্রমণ বাড়ছে, তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্য সঙ্কট। গড়ে উঠছে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি, ইস্টবেঙ্গল রিলিফ সোসাইটি। নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাদ সাহা, ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব। বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান বাংলা সেদিন লড়াইয়ের পথেই বন্ধু চিনে নিয়েছিল। রুটি রুজির লড়াই রুখে দিয়েছিল দেশভাগের যন্ত্রণাকে পুঁজি করে হিন্দুত্ববাদীদের জমি তৈরির অপচেষ্টা।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এমনই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট। খাদ্যের দাবিতে কলকাতায় সমাবেশের ডাক। বাংলায় তখন খাদ্যদ্রব্যের অগ্নিমূল্য। ফসল ফলিয়েও কৃষকরা নিরন্ন। লড়াই হাঁকলেন বামপন্থীরা। মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির ডাকে সে-দিনের সমাবেশে গ্রাম বাংলা থেকে কলকাতায় হাজির হয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বামপন্থী দলগুলিই এই ঐতিহাসিক সমাবেশের উদ্যোক্তা ছিল। শহিদ মিনার থেকে মিছিল যখন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে খাদ্য দফতরের দিকে এগোতে যায়, পুলিশ আক্রমণ করে। গ্রাম বাংলার অভুক্ত মানুষ কলকাতার অলিগলি চেনেন না। দিশেহারা অবস্থা। স্রেফ লাঠির ঘায়ে আশি জন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে স্বাধীন দেশের পুলিশ। পরের দিন ১ লা সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে শহিদ হলেন ছাত্ররা। পুলিশের নৃশংসতা সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল এই স্বাধীনতায় কারা ক্ষমতা লাভ করেছে। মানুষ আন্দোলনের পথেই বুঝতে পেরেছিলেন ভারতের রাষ্ট্র চরিত্র। ব্রিটিশ আমলের মতোই কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি করে মানুষকে সেদিন অভুক্ত রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্র ছিল মজুতদারদের পক্ষে।
১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনে আবার উত্তাল হয়েছে বাংলা। ততদিনে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়েছে। কেরোসিনের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে উত্তর চব্বিশ পরগণার স্বরুপনগরে শহিদ হন ছাত্র নুরুল ইসলাম। তার কিছুদিন পরে কৃষ্ণনগরে শহিদ হন ছাত্র আনন্দ হাইত। সেসময়ের খাদ্য আন্দোলনেও বাম ছাত্র সংগঠনগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। গণ আন্দোলনের পথেই পশ্চিমবঙ্গে জমি গড়ে তুলেছিল বামপন্থীরা।
১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনের পর অনেকগুলি দশক কেটে গিয়েছে। এখন দেশজুড়ে চলছে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব। আমাদের দেশ নাকি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। দেশের শিল্পগোষ্ঠীগুলি অন্য দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও বিশাল সংখ্যক মানুষ ভুখা পেটে থাকেন। গত ২০২২ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭ তম। এই বছরেই প্রকাশিত, অক্সফ্যামের ‘সারভাইভাল অফ দ্য রিচেস্ট’ শিরোনামের রিপোর্টেও সেই তথ্য ধরা পড়েছে। ভারতের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ নব্বই কোটির বেশি মানুষ পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত। অপুষ্টিজনিত রোগে এই দেশে প্রতি বছর ১৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যান। রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের প্রকৃত আয় অতিমারির বছরে (২০২০-২১) কমেছে। অথচ, কর্পোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা বেড়েছে ৭০ শতাংশ। অতিমারির দুই বছরে ভারতে বিলিওনারের সংখ্যা ৬৪ জন বেড়ে হয়েছে ১৬৬ জন। দেশে ১০০ জন ধনী ব্যক্তির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। ভুললে হবে না, ২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৪০ লক্ষ কোটি টাকারও কম। আর ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১১৫ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন।
২
বিগত শতকের নয়ের দশক থেকে নয়া উদারনীতির পথে বাজার অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে দেশের অর্থনীতি। আমাদের শেখানো হতে থাকে উন্নয়নের নতুন সিলেবাস। যেখানে ভর্তুকি, রেশন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ। সব নিয়ন্ত্রিত হবে বাজারের চাহিদা-জোগানের খেলায়। নয়া উদারনীতিতে সর্বজনীন গণ বন্টন ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। দেশে এই গণবন্টন ব্যবস্থার ইতিহাস অনেক দিনের। ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৯ সালে বোম্বেতে প্রথম এই ব্যবস্থা চালু হয়। স্বাধীন ভারতে প্রথমে শহরাঞ্চলে এই ব্যবস্থা শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে অত্যাবশকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। সে ব্যবস্থা যে ত্রুটিমুক্ত ছিল না, তার প্রমাণ ১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন। ১৯৯১ সালের নয়া উদারনীতিতে সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থার বদলে আনা হল টার্গেটেড গণবন্টন ব্যবস্থা। রেশন দোকানের নাম বদলে হল ন্যায্য মূল্যের দোকান। ভর্তুকি মূল্যে পাওয়া দ্রব্যের সংখ্যা কমল। ১৯৯৭ সালে শুরু হল এপিএল-বিপিএল বিভাজন। ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনে সেই টার্গেটেড গণবন্টনকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রথমেই রেশনে সস্তায় খাদ্যদ্রব্য দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হল। গ্রামাঞ্চলে ৭৫ শতাংশ ও শহরে ৫০ শতাংশ মানুষ রেশনে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যশস্য পাবেন। অধিকার সংক্রান্ত আইনে এমন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল।
বর্তমানে রয়েছে নানা নাম ও রঙের ডিজিটাল রেশন কার্ড। তা নিয়ে রাজনৈতিক প্রচারের শেষ নেই। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই ঢাক পেটাচ্ছে। বাস্তবে বেশিরভাগ মানুষ সামান্য চাল ও গম ছাড়া কিছু পাচ্ছেন না। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় বাজেটে চালের পরিমাণ কমেছে। রাজ্য সরকারের আর কে এস ওয়াই ১ এবং ২ কার্ডে গম বা আটা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ৭০ শতাংশ ভুখা মানুষের দেশে এভাবেই ডিজিটাল রেশন কার্ডের নামে চলছে রেশন নিয়ে প্রহসন। অথচ, কিছু পরিমাণ চাল, গম দিয়ে গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। প্রত্যেক নাগরিকের পেটভরা পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তা দেওয়া সরকারের কর্তব্য। স্বাধীন দেশে কোনো সরকারই সেই দায়িত্ব পালন করে নি। এখন তো বাজার অর্থনীতিতে এসব ভাবনাই বাতিল, পুরনো বস্তাপচা, উন্নয়ন বিরোধী। রান্নার গ্যাসসহ পেট্রোজাত পণ্যের ভর্তুকি কমিয়ে, সরকারি রাজস্ব বাড়িয়ে দাম ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে। কেন্দ্র বা রাজ্য কোনো সরকারই খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয় না।
খাদ্য নিরাপত্তা আসলে এখন বিশ্বজোড়া বাণিজ্যিক স্লোগান। যার আড়ালে রয়েছে কৃষি সরঞ্জাম সহ গোটা কৃষি ব্যবস্থায় কর্পোরেট সংস্থাগুলির আধিপত্য বিস্তারের নীল নকশা। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রসংঘ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল নামে একটি কর্মসূচি নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, বিশ্বব্যাঙ্ক, আই এম এফ সহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই কর্মসূচির উদ্ভাবক। দারিদ্র দূর করা ও ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমানো ছিল যার অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য। আসল লক্ষ্য বেসরকারিকরণ। এই কর্মসূচিতে মাইক্রোফিন্যান্সের কারবারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার আগেই ১৯৯৪ সালে এই ব্যবস্থার অন্যতম পথ প্রদর্শক মহ. ইউনুস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। মনস্যান্টো, কার্গিলের মতো ৭৪ টি সংস্থা এই পুরস্কারে আর্থিক সাহায্য দেয়। সার, বীজ, কীটনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামের বাজার মনস্যান্টো, কার্গিলের মতো কোম্পানিগুলির দখলে চলে গেছে। ফলন বাড়ানোর প্রলোভনে কৃষকদের এইসব কোম্পানির দ্রব্য কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। চাষের খরচের সঙ্গে বেড়েছে কৃষকদের ঋণের বোঝা। আর সেই ঋণের চাহিদা মেটাতে ব্যবসা বাড়িয়েছে মাইক্রো ফিন্যান্স কোম্পানিগুলি। সবই চলেছে দারিদ্র দূর করা, খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর নামে।
আজ ঋণের জালে জড়িয়ে কৃষক আত্মহত্যা দেশে মহামারির আকার নিয়েছে। কৃষি অলাভজনক হওয়ায় অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। আর সেই সুযোগে চুক্তি চাষের নামে বাজারে হাজির হচ্ছে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা। খাদ্যদ্রব্যের খুচরো ব্যবসাতেও তাদের দখল বাড়ছে। বিপন্ন হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, কৃষি সঙ্কট –এসবই তার ফল।
বিভেদ, ঘৃণার রাজনীতির মধ্য দিয়ে সেই সঙ্কটকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আজ দেশের সামনে বড় বিপদ দারিদ্র, ক্ষুধা। লাল ঝান্ডার নেতৃত্বে রুটি রুজির লড়াই পারে এই বিপদের মোকাবিলা করতে। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও তাই ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয় না। বরং তাকে স্মরণ করেই আজ ক্ষুধার দেশে আরেক গণ আন্দোলনের প্রয়োজন।
আরো পড়ুন :
ফিরে দেখা : খাদ্য আন্দোলন থেকে যুক্তফ্রন্টের দিকে
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
প্রিয় পাঠক,
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
রেজিস্টার করুন আমাদের ওয়েবসাইটে
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।