ব্যারিকেড ভাঙার আগে নিজেদের মানসিক ব্যারিয়ার ভেঙেছি আমরা,
বলছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক
রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন ঠিক কীরকম? ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট বা ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে আদৌ কি বামপন্থীদের রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে? নাকি একইরকম বিপর্যয়ের সাক্ষী হবেন তাঁরা? নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি এবং মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূলের বাইনারি ভাঙতে কি তাঁরা সফল হবেন? নাগরিক ডট নেটের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্ক।
আপনাকে নাগরিক ডট নেটে স্বাগত। এখন তো প্রায়শই শিরোনামে উঠে আসছে সিপিএম। জেলায় জেলায় আপনারা বড় বড় জমায়েত করছেন, পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙছেন, জলকামানের মুখোমুখি হচ্ছেন, লাঠিচার্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। সবাই বলছে সিপিএম যেন নতুন করে অক্সিজেন পেয়ে গেছে। এর নেপথ্যে কি নতুন রাজ্য সম্পাদক?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এটাই তো কমিউনিস্ট পার্টির কাজ। এভাবেই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছে, বেড়ে উঠেছে এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গত দশ বছরে একটা সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। মিথ্যা মামলা তো ছিলই। পুলিসের গাঁজা, মদের কেস দেওয়ার চক্করে ছেলেমেয়েরা শুধু যে উদ্যমহীন হয়ে পড়ছিল তাই নয়, সরকারি নির্যাতন – সে কেন্দ্রীয় সরকার হোক বা রাজ্য সরকার – অ্যাক্টিভিস্টদের ধরে ধরে ভয় দেখানো, সোশাল মিডিয়ায় আক্রমণ করা, অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া, তাদের বাড়িতে পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া, বাড়িতে ঢুকে মারধর করা – এসবের ফলে বিভিন্ন আন্দোলন হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা দিকনির্দেশ খুঁজছি আমরা। মূলত নতুন প্রজন্ম, যারা গত এক দশকে অনেক হতাশা দেখেছে, অনেকে তাদের আগের ভুলগুলো দেখে বলছে ‘আমরা ভুল করেছি, একই ভুল আর করতে চাই না’। এদের সামনে সমূহ বিপদ। এমন একটা ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে না, যেখানে এরা কাজ পেতে পারে। আজকে যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দেখছ… রাজ্য সম্পাদক দ্যাখো বা ছাত্র যুবনেতাদের দ্যাখো, কি অন্য গণসংগঠনে যে নতুন নেতৃত্ব দেখছ… এরা কি একদিনে রাতারাতি পৌঁছে গেছে সংগ্রামের মঞ্চে? এরা গত দশ বছর ধরে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। পুলিসের মোকাবিলা করে, লাঠি খেয়ে, কাঁদানে গ্যাস খেয়েই এরা লড়েছে। এই গভীরতাটা মানুষের ভাল লেগেছে। ব্যারিকেড ভাঙার আগে নিজেদের মানসিক ব্যারিয়ার ভেঙেছি আমরা। এটা শুধু সিপিএম মেম্বার নয়, তার বাইরেও গণসংগঠনের সদস্যদের মধ্যে, জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে, একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে।
১৯৭৭ সালে যখন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল, ৭২ থেকে ৭৭ – এই সময়টা পেরিয়ে, তখন মূলত উদ্বাস্তু এবং কৃষকদের ভোটে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল এবং ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। তারপর ২০০৮-১১ আমরা দেখলাম উদ্বাস্তু এবং কৃষকরা আপনাদের থেকে সরে যাচ্ছেন। এখন যে নতুন ছেলেমেয়েরা আসছে, এরা কি ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন কেন্দ্রিক নয়? কৃষকসভাও কি নতুন করে সক্রিয় হচ্ছে, সেখান থেকেও কি অল্পবয়সীরা আসছে?
এই যে ছাত্র যুবদের দেখছ, এরা কি খুব আলাদা? প্রথমত, কলেজ ক্যাম্পাস, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে দেবে না, ঢুকতে দেবে না, পরীক্ষা দিতে দেবে না, অ্যাডমিট কার্ড দেবে না, মার্কশিট ছিঁড়ে ফেলে দেবে – এগুলো তো কৃষক শ্রমিক পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও ভয়। আজ যে ছাত্রযুব নেতাদের দেখছ, এরা সকলেই কি মধ্যবিত্ত? না। অনেকেই প্রান্তিক পরিবার থেকে আসা। সাতাত্তরে শুধু কৃষক আর উদ্বাস্তুর ভোটে আমরা ক্ষমতায় এসেছিলাম – এই কথাটাও সঠিক নয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টগুলোতে আমরা জিতেছিলাম, আবার মালদা, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ সংখ্যালঘু এলাকার ভোট আমরা পেয়েছিলাম।
একটা বড় কোনো ঘটনা ঘটলে মানুষকে নানান খোপে ফেলে দেওয়ার একটা প্রবণতা কাজ করে। উদ্বাস্তু, তফসিলি, রাজবংশী, কোচ, মুসলমান, হিন্দিভাষী, উর্দুভাষী, বাংলাভাষী – গত ২০-২২ বছর ধরে তৃণমূল এবং বিজেপি এইভাবেই মানুষকে খোপে পুরে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখানকার মানুষকে বোঝানো হল যে উদ্বাস্তুদের যদি তাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাদের জমিজমা সব তোমরা পেয়ে যাবে। আবার একটা অন্য অংশে বলা হচ্ছে মুসলমানরা চলে গেলে তাদের বিষয়সম্পত্তি তোমরা পেয়ে যাবে। মানে কারোরই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পরিবর্তে এক দলকে বঞ্চিত করে আরেক দলকে দেওয়া হবে – এরকম একটা ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার রাজনীতি তৈরি করা চলছে। তার সঙ্গে রয়েছে দুষ্কৃতিরাজ। এই দুর্নীতি এবং দুষ্কৃতীর চক্র যদি ভাঙতে হয়, তার একমাত্র উপায় মানুষের জীবন জীবিকার সংগ্রামকে পুনরুদ্ধার করা।
বাংলার সাধারণ হিন্দু, মুসলমান তো দাঙ্গা চান না। শিক্ষকরা দুর্নীতির জন্য চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁদের চাকরি নিলাম হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষক, স্কুলের শিক্ষক – উভয়েরই এই সংকট। কিন্তু বিজেপি এসে বলল, স্কুল আর মাদ্রাসা আলাদা। এভাবে উর্দু আর বাংলাভাষীদের লড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। আসল দুর্নীতি যে নিয়োগে, সে কথায় গেল না। ২০১৯ সালে একটা লোকসভা ভোট হয়ে গেল দুজন ছাত্রের খুন ভাঙিয়ে, অথচ এখনো ঠিক নেই আরএসএস খুন করিয়েছে লাশের রাজনীতি করার জন্য? নাকি পুলিশ খুন করেছে, না গুন্ডারা? সিআইডি, সিবিআই কেউ কিছু করল না, কিন্তু ওই এলাকার মানুষকে আবেগতাড়িত করে ভাগ করে দিয়ে ভোট হয়ে গেল।
২২শে জুলাই যখন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম শোনা গেল প্রথম এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সি ব্যবস্থা নিল তাঁর বিরুদ্ধে, তারপর থেকে কি রাজ্যের রাজনীতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন আপনি?
না, মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আমরা দুর্নীতির কথা বলছিলাম। পঞ্চায়েত, পুরসভা, রাজ্য সরকার, স্বাস্থ্য দপ্তর, শিক্ষা দপ্তর, পুলিস নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ – সবেতেই। কিন্তু মানুষের তাও একটা ধারণা ছিল, যে মমতা খুব সৎ, সততার প্রতীক। মানুষকে হুজুগে মাতিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা এবং মিথ্যাচার করে খুড়োর কল দেখানো – তা মানুষ দেখেও দেখছিলেন না। তাই এই টাকার পাহাড় যখন মানুষের চোখের সামনে চলে এল, তখন মমতা রেগে গেলেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো সেকেন্ড ইন কম্যান্ড, আর তিনি একাও তো নন। রাজ্যের প্রায় সব মন্ত্রী, এমএলএ-ই তো এরকম দুর্নীতিতে যুক্ত। চারিদিক থেকে তো টাকার পাহাড় বেরোচ্ছে। যার বাড়িতে যাচ্ছে, যেখানে হাত দিচ্ছে সেখানেই। বাঙালি দুশো টাকার বাজার করতে গেলে দুবার ভাবে। তার পুজোর বাজার করার টাকার টানাটানি ছিল এবারে। আর সেখানে এই বিপুল টাকার খেলা চলেছে দিনের পর দিন ধরে।
‘শিক্ষকরা দুর্নীতির জন্য চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁদের চাকরি নিলাম হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষক, স্কুলের শিক্ষক – উভয়েরই এই সংকট। কিন্তু বিজেপি এসে বলল, স্কুল আর মাদ্রাসা আলাদা। এভাবে উর্দু আর বাংলাভাষীদের লড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল’
আর সিবিআই কী করছে? যথেষ্ট সময় দিচ্ছে টাকা সরানোর জন্য। কেউ বিদেশের ব্যাঙ্কে সরিয়ে দিচ্ছে, কেউ অন্য কোনোভাবে পাচার করছে টাকা। মার্চ মাসে বগটুই কাণ্ডের সময় গিয়ে ওখানে তৃণমূল নেতার যেরকম বাড়ি দেখেছিলাম, ওরকম বাড়ি তো প্রত্যেকটা জেলায়, প্রত্যেকটা ব্লকে। রাস্তার টাকা, পুকুরের টাকা, বাঁধের টাকা, একশো দিনের কাজের টাকা, বিধবা ভাতার টাকা। কত টাকা যে ওইসব বাড়িতে লেগে গেছে! এই দুর্নীতি এত বড় আকারের হয়ে উঠেছে যে এটাকে মমতা ব্যানার্জিও আর চাপা দিয়ে রাখতে পারছেন না।
একটা অন্য প্রসঙ্গে যাই। এই মুহূর্তে রাজ্যে সংযুক্ত মোর্চার কোনো অস্তিত্ব আছে কি?
ওটা তো আগেই আমরা বলেছিলাম নির্বাচনী আসন সমঝোতা। আবার যখন নির্বাচন হবে, (প্রয়োজনে) আবার সমঝোতা হবে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে তো বিজেপি পুরোদমে নামবে বলে দাবি করছে। বিজেপির অনেক এমপি, এমএলএ, যথেষ্ট শক্তি। আপনাদের একজন এমএলএ-ও নেই। এই অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষ তৃণমূলকে হারাবার জন্য বিজেপির উপর ভরসা না করে যাতে আপনাদের উপর ভরসা করেন, তার জন্য আপনাদের স্ট্র্যাটেজিটা কী?
বিজেপি বলেছে পুরোদমে নামবে। কিন্তু দম কি শুধু এমএলএ থাকলেই হয়? বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের তো অতগুলো এমএলএ ছিল। তারপর একটা করে এমএলএর দম ফুরোচ্ছিল আর তারা দম নেবার জন্য বিজেপিতে যাচ্ছিল। শ্বাস নিতে পারছে না, দমবন্ধ হয়ে আসছে – এসব তো দলবদলের একটা বাহানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিপিএমের দম আছে, আর সেটা এমএলএ এমপির দম নয়। আমাদের যে ছাত্রযুবরা টগবগিয়ে ছুটছে তারা কি কখনো এমএলএ, এমপি হয়েছে? বামপন্থীদের রাজনীতিটা মতাদর্শের জায়গা থেকে। মানুষের জন্য চিন্তা, মানবিকতা থেকে। দেশের কটা মন্ত্রী কটা এমএলএ ছুটেছিল করোনার সময়ে, গঙ্গায় যখন লাশ ভেসে যাচ্ছিল, মানুষ হাসপাতালে জায়গা পাচ্ছিল না, অসুস্থ বা মৃত পরিজনকে দেখতে যেতে পাচ্ছিল না? ছুটেছিল আমাদের রেড ভলান্টিয়াররা।
এই যে একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনপ্রতিনিধিরা – এতে কী হচ্ছে? আরে, বিধানসভায় আসল সমস্যাগুলো আলোচনা হচ্ছে না, মূল্যবৃদ্ধি বেকারত্ব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। সেখানে কে কার ছেলে, কে কার বান্ধবী এই নিয়ে মেতে উঠছে একটা ফেক অপোজিশন। তৃণমূলের মধ্যেই ভাগাভাগি হচ্ছে। ‘তুই ওদিকে যা, আমি এদিকে যাই’। তারপর ভোটের পর দেখা যাচ্ছে এদিক ওদিক সব মিলেজুলে যাচ্ছে।
দ্যাখো রাজনীতির লড়াইয়ে দুটো মূলধন – হয় নেটওয়ার্ক, নয় নেট ওয়ার্থ। আমাদের নেট ওয়ার্থ নেই। কালো টাকা, বিদেশের টাকা, দেশের জনগণের থেকে শুষে নেওয়া টাকা, কর্পোরেট বন্ড থেকে টাকা, চিটফান্ডের টাকা – এসব আমাদের নেই। এই জায়গাটায় আমরা ওদের সঙ্গে লড়তে পারব না। কিন্তু আমাদের আছে নেটওয়ার্ক, আর সেটাই ওরা ভাঙতে চায়। তাই ওরা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আক্রমণ করেনি, করেছিল আমাদের শাখা অফিসে। করেছিল একেবারে নিচুতলার কর্মী সমর্থকদের উপরে। শিক্ষক, ডাক্তার, কৃষক, শ্রমিককে আক্রমণ করেছে।
এছাড়া আছে আমাদের পার্টির বৃত্তের বাইরের মানুষের দুর্দশা। তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা আমাদের এসে বলেছে যে তারা অভিষেককে চিঠি দিয়েছে, মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি দিয়েছে, দিদিকে বলোতে বলেছে। অথচ তাদের সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। টাকা খরচ হয়েছে কিন্তু রাস্তা হয়নি। এবার আমরা যেন দেখি। তার মানে বিডিও থেকে, এক্সিকিউটিভ অফিসের থেকে সবাই টাকা খেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য আমরা ডাউনলোড করে দিই গরীব মানুষকে। সেই কাজটা করে দিতে ওরা পাঁচশো টাকা নিয়ে নিচ্ছে। কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশটা ঘর তৈরির টাকা এসেছে, কেন্দ্রীয় সরকারও তার কোনো ব্যবস্থা করেনি, রাজ্য সরকারও করেনি। টাকাটা মাঝখান থেকে অন্য কেউ মেরে দিয়েছে। আমরা আইন দেখে বললাম, যে তোমরা গ্রামসভা করছ না কেন? মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে চাকরি দেয়নি। সরকারি প্রকল্পের টাকা দেবার নাম করে ঘুষ খেয়েছে কিন্তু টাকা দেয়নি। এই মানুষ গিয়ে যখন পঞ্চায়েত ঘিরবে, তখনই বুঝতে পারবে দমটা কার।
‘আমাদের আছে নেটওয়ার্ক, আর সেটাই ওরা ভাঙতে চায়। তাই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আক্রমণ করেনি, করেছিল আমাদের শাখা অফিসে। করেছিল একেবারে
নিচুতলার কর্মী সমর্থকদের উপরে’
দেউচা পাঁচামি নিয়ে কী বলবেন? সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ভূত যদি আপনাদের তাড়া না করত, তাহলে কি আপনারা আরেকটু সক্রিয় হতে পারতেন? নাকি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আপনাদের পেছন থেকে টেনে ধরছে দেউচার আন্দোলনকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে?
তুলনাটাই ভুল। সিঙ্গুরে একটা গাড়ি কারখানা প্রায় তৈরি হয়ে গেছিল। দেউচাতে কী হয়েছে? দেউচাতে মিথ্যাচার এমন যে সয়েল টেস্টিংয়ের জন্য যখন যাচ্ছে, তখনও ডিএমকে দিয়ে বলাচ্ছে যে নলকূপ খননের জন্য যাচ্ছে। সেটা এমন আদিবাসী এলাকায় যেখানে পানীয় জল দেবার ব্যবস্থাও করেনি সরকার। এটা [সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মত] মমতা গিয়ে হইচই পাকিয়ে করেছেন তা নয়, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীকে পাঠিয়ে করিয়েছে তা নয়, মাওবাদীদের ডেকে নিয়ে এসে খুনখারাপি করেছে তা নয়। ওখানকার মানুষজন, ওখানকার আদিবাসীরা ওখানে আন্দোলন সংগঠিত করেছে। আমরা বামপন্থীরা সেই স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছি, সমর্থন করেছি। মমতা ভেবেছিলেন এদের পুলিশ পাঠিয়ে, গুন্ডা পাঠিয়ে রাতারাতি উৎখাত করে দেবেন। আর আধা কৃষকদের সঙ্গে মমতা আর মোদী মিলে এগ্রিমেন্ট করে নেবেন। তা তো হয়নি। একটা বিস্তীর্ণ এলাকা, যেমন তিলাবনী পাহাড় – সেটাকে তারা কর্পোরেটের হাতে দিয়ে দিল।
মমতা বক্তৃতায় বলে দিয়েছেন এত লোকের কাজ হবে। মিথ্যে বলেছেন। আজকে তুমি কোল ইন্ডিয়ার মাইনিং দ্যাখো, বিদেশের মাইনিং দ্যাখো, সেখানে ক্যাপিটাল-লেবার রেশিও যা, তাতে করেই তো বোঝা যায় যে এসব মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কোনো মানে হয় না। আর ওখানে কয়লা বেরোবে কিনা সেটা কথা না। কর্পোরেটের হাতে এত টাকা যে তারা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকে তাকিয়েই বিনিয়োগ করতে পারে। অয়েল রিজার্ভ আম্বানির হাতে, গ্যাস রিজার্ভ আম্বানির হাতে, মিনারেলস রিজার্ভ আদানির হাতে। সেইরকম এটাকেও জমা রাখতে হবে। এটাই আসল উদ্দেশ্য। কুড়ি বছর, পঞ্চাশ বছর পরে হয়ত এখান থেকে কয়লা তোলা হবে, যেরকম আমেরিকায় হয়।
বিজেপি যে বিভিন্ন রাজ্যে একদম অগণতান্ত্রিকভাবে রাজ্যসরকারগুলোকে ফেলে দিচ্ছে, ধরুন পশ্চিমবঙ্গেও এরকম একটা চেষ্টা বিজেপি করল। সেক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী হবে?
কেন করবে? এখানে তো তাদের নকল যুদ্ধ। যে মুহূর্তে জাতীয় মিডিয়া বলে “মোদী ভার্সেস মমতা”, মোদী তো সুবিধা পেয়ে যায়। এটা আমরা নোটবন্দীর সময়ে দেখেছি, চিটফান্ড দুর্নীতির সময়ে দেখেছি। উল্টোদিকে তৃণমূলও খুব আরামে আছে। বিজেপি থেকে বার করে এনে তৃণমূল আর তৃণমূল থেকে বার করে এনে বিজেপি – এ তো ক্রমাগত রিসাইক্লিং চলছে। মেঘালয়ে, গোয়ায় কি তৃণমূল ফেলতে গেছিল বিজেপিকে, না বিজেপি ফেলতে গেছিল তৃণমূলকে? আমাদের রাজ্যের লোকের ট্যাক্সের টাকা ওখানে গিয়ে খোলামকুচির মত খরচ করেছে, যাতে ওখানকার নন-বিজেপি শক্তিগুলোর ভোট কেটে বিজেপির সুবিধে করে দেওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে আজ একটা কোনো ঘটনা ঘটলে মোদী কতবার আসছে? যোগী কতবার আসছে? ভোটের আগে কিন্তু ঘন ঘন আসছিল। কারণ এদের লক্ষ্যই ছিল কোনো না কোনোভাবে বামপন্থীদের বিধানসভার বাইরে রাখা। তৃণমূল না থাকলেই বরং বিজেপির অসুবিধে। কারণ পুরো লড়াইটা বামেদের সঙ্গে লড়তে হবে। একইভাবে, বিজেপি থাকলেও তৃণমূলের সুবিধা। সেজন্যেই মমতা ব্যানার্জি বলছেন আরএসএস খারাপ নয়, মোদীর প্রশংসা করছেন। বামশূন্য বিধানসভায় তো তৃণমূল আর বিজেপি আরামেই আছে।
আরো পড়ুন দুর্নীতির সুযোগ বিজেপি যেন নিতে না পারে: নওশাদ
পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়াকে নিষিদ্ধ করল কেন্দ্রীয় সরকার। আপনাদের সঙ্গে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক বিরোধিতা। কিন্তু এই নিষিদ্ধকরণ কি বিরোধী কণ্ঠ দমনের চেষ্টা নয়?
আমরা ইউএপিএ প্রয়োগের বিরুদ্ধে। অন্যায় কেউ করলে আমাদের সিআরপিসি আছে, আইপিসি আছে। হেন অপরাধ নেই যার ভারতীয় দণ্ডবিধির কোনো না কোনো ধারায় বিচার করা যায় না। যখন স্ট্যান স্বামীকে, সুধা ভরদ্বাজকে ধরেছিল, তখনও আমরা এই কথাই বলেছিলাম। মাওবাদীরা আমাদের খুন করেছে পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেও মিলিটারি ব্যবস্থার আমরা বিরোধিতা করেছিলাম।
কিন্তু আপনারাও ইউএপিএ ব্যবহার করেছেন তো। ইতিহাসকে কি অস্বীকার করা যায়?
আমি আজকের কথা বলছি। তোমাদের নাগরিক তো একটা আধুনিক মাধ্যম। তুমিও আধুনিক। আমরা ইতিহাসে ফিরে যেতে পারি না। আমরা ইতিহাস থেকে শিখি। প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থীরা আমাদের ইতিহাসে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। কখনো বাবরি মসজিদের তলায় কী ছিল সে প্রশ্ন তুলে, কখনো তাজমহলের তলায় কী ছিল, কুতুব মিনারের তলায় কী ছিল, মৌর্য সাম্রাজ্যে কী ছিল। আমরা বলছি আজকের চৌর্য সাম্রাজ্যে কী আছে সেটা নিয়ে কথা বলো।
কিছুদিন আগে লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সার্বিক বাম ঐক্য গড়ে তুলে আন্দোলন করতে হবে এবং প্রধান বিরোধীর জায়গায় বিজেপিকে সরিয়ে বামপন্থীদের নিয়ে আসতে হবে। দীপঙ্করবাবু তো নো ভোট টু বিজেপির পক্ষে ছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?
এই কথা তো আমরা আমাদের পার্টি কংগ্রেসে বহুদিন ধরে বলে আসছি। আমরা তো বলেছি যে সিপিএমকে মজবুত করতে হবে, এছাড়া পথ নেই। সিপিএমের যত গণসংগঠন আছে – ছাত্র, যুব, শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, কর্মচারী, শিক্ষক – সবাইকে মজবুত করতে হবে। তার ভিত্তিতে আমাদের বামদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তার জন্য বামফ্রন্ট আছে। যারা বৃহত্তর বাম ঐক্যের কথা বলছে, তাদের আগে জিজ্ঞেস করো তারা বামফ্রন্টকে স্বীকার করে, না অস্বীকার করে? দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বামফ্রন্ট গড়ে উঠেছে। এটা একটা লাগাতার পদ্ধতি। বামফ্রন্টের বাইরেও যে বাম দলগুলো, ব্যক্তি, গোষ্ঠী – তাদের সবাইকেই আমাদের জড়ো করতে হবে। দীপঙ্কর আর কবিতা [কৃষ্ণণ] একসঙ্গে এলে ভাল লাগত। যদি দীপঙ্কর একা আসেন তাও স্বাগত।
‘প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থীরা আমাদের ইতিহাসে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। কখনো বাবরি মসজিদের তলায় কী ছিল সে প্রশ্ন তুলে, কখনো তাজমহলের তলায় কী ছিল, কুতুব মিনারের তলায় কী ছিল, মৌর্য সাম্রাজ্যে কী ছিল’
শেষ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা ঠিক সিপিএমের রাজ্য সম্পাদককে নয়, রাজনীতির একজন ছাত্রকে। বাংলায় যে রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারা, সেখানে তো কমিউনিস্ট আন্দোলন একটা বিরাট জায়গা নিয়েছিল বা এখনো আছে। কিন্তু বাংলার সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে একজন সংখ্যালঘু নাম পরিচয়ের মানুষের আসতে এত সময় লাগল কেন? তাহলে কি হিন্দুত্ববাদ সকলের ভিতরেই কমবেশি ঢুকে রয়েছে?
কমিউনিস্ট পার্টিতে এগুলো বিবেচ্য নয়। কোনো পার্টিতেই বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। আজকাল মঞ্চ আলো করার জন্য একটু গেরুয়াধারী, একটু টুপি, একটু দাড়ি – এরকম রাখা হয়। এগুলো প্রতীকী। টোকেনিজ্ম। কমিউনিস্ট পার্টি টোকেনিজমে বিশ্বাস করে না। সংখ্যালঘু বলে তো সিলেক্টেড হইনি, ইলেক্টেড হয়েছি। এখন যেখানে আমরা বসে আছি এটা মুজফ্ফর আহমেদ ভবন। আরএসএস বলতে পারে যে মুসলমান ভোট পাওয়ার জন্য মুজফ্ফর আহমেদের নামে ভবনটা করেছে। কিন্তু তিনি আমাদের পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলেই তো তাঁর নামে নামকরণ।
‘মমতা ব্যানার্জির পদবী ব্যানার্জি বলে তো আমি তাঁর বিরোধিতা করি না। আমি যখন কাস্ট এবং কমিউনিটি দেখছি, তখন পরোক্ষে সংখ্যাগুরুর দৃষ্টিভঙ্গীকেই পুষ্ট করছি’
তার উপর দেশ ভাগ হয়েছে, ধর্মের নামে হানাহানি হয়েছে, একটা বিশাল অংশের উদ্বাস্তু মানুষ এখানে এসেছেন, একটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অংশ দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যারা রয়ে গেছিল তারা অধিকাংশই প্রান্তিক মানুষ। তারপর ভূমিসংস্কার হয়েছে, শিক্ষার প্রসার হয়েছে। ওপারে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। যখন মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলেছে মানুষ, তাঁর ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে? এমনকি মওলানা ভাসানীর নামের আগে মওলানা কেন আছে – সে প্রশ্নও উঠেছে কি? আজ নরেন্দ্র মোদীর কাস্ট নিয়ে প্রশ্ন হয় না, কিন্তু বহুজন সমাজ পার্টির একজন নেতা উঠে এলে তার কাস্ট নিয়ে প্রশ্ন হবে। এটাই সমস্যা। এটা হিন্দুত্ব বলে নয়, সব জায়গায় হয়। পশ্চিমবঙ্গে আগে এটা ততটা ছিল না। মমতা ব্যানার্জির রাজনীতির সুবাদে এই প্রশ্নগুলো উঠছে। যখন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়ো, তখন তাঁর নামের শেষে ইসলাম আছে বলে পড়ো না। বা নামের আগে কাজী আছে বলে পড়তে অস্বীকার করো না। মমতা ব্যানার্জির পদবী ব্যানার্জি বলে তো আমি তাঁর বিরোধিতা করি না। আমি যখন কাস্ট এবং কমিউনিটি দেখছি, তখন পরোক্ষে সংখ্যাগুরুর দৃষ্টিভঙ্গীকেই পুষ্ট করছি। এই দৃষ্টিভঙ্গীকে সমূলে বিনাশ করাই বরং কমিউনিস্ট পার্টির কাজ। মানুষের পরিচিতি একটা থাকবেই। পরিচিতির রাজনীতিও থাকবে, কিন্তু তার বিষয়বস্তু কী হবে, তার উদ্দেশ্য কী হবে – বিভেদ বাড়ানো নাকি ঐক্য বাড়ানো – সেটাই আসল কথা।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।