২০২৪ নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ভারতের রাজনীতিতে তত বেশি নাটকীয় মোড় এবং শক্তির পুনর্বিন্যাস দেখা যাবে। তবে সেখানে পৌঁছবার আগে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত আমাদের ব্যস্ত রাখা হবে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে। গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের নির্বাচনের ফলাফলের উপর অনেককিছু নির্ভর করবে। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রথমেই নির্বাচন নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহের নিজের রাজ্য গুজরাটে।

গুজরাটের ছবিটা কৌতূহলোদ্দীপক। যদিও এ রাজ্যে লড়াইটা দ্বিমুখীই রয়ে গেছে, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি (আপ) জোরালো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যম আর সোশাল মিডিয়ার এক ঝলক দেখলে মনে হবে গুজরাটের সবচেয়ে সক্রিয় পার্টি হল আপ। কেজরিওয়াল নিজে এবং দিল্লি আর পাঞ্জাবের আপ সরকারের প্রায় পুরো ক্যাবিনেট আমেদাবাদে ঘাঁটি গেড়েছে। আপ বিজেপির গড়ে তাদের বৃহত্তম এবং একমাত্র চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠেছে বলে দাবি করছে বা ভান করছে। এরকম বলার কারণ, মতামত সমীক্ষাগুলো কিন্তু অন্যরকম বলছে। বেশিরভাগ ওপিনিয়ন পোলই বলছে আপ ১৫% বা তার বেশি ভোট পেলেও খুব বেশি আসন পাবে না। কিন্তু দলটাকে ঘিরে রীতিমত হইচই হচ্ছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই হইচইটা কী করে তৈরি করতে পারল আপ? এর কৃতিত্ব একটা অতিসক্রিয় ইকোসিস্টেম আর বন্ধুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমকেই দিতে হবে। পাঞ্জাবে যেভাবে তাঁর দিল্লি মডেলের প্রচার করেছিলেন, গুজরাটেও কেজরিওয়াল ঠিক সেটাই করছেন। কিন্তু এখানে আরও একটা জিনিস করা হচ্ছে। আপ এমন কোনো বিষয়ে বিবৃতি দিচ্ছে না যেগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ভাবাবেগে ‘আঘাত’ দিতে পারে। একটা উদাহরণ দিই। মনীশ সিসোদিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বিলকিস বানোর ১১ জন শাস্তিপ্রাপ্ত ধর্ষককে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তাঁর পার্টি নীরব কেন? আপের দু নম্বর নেতা বলা হয় যাঁকে, সেই সিসোদিয়া ভাবলেশহীন মুখে উত্তর দেন, তাঁর দল বিলকিসের ইস্যু নিয়ে ভাবছে না। মনে রাখতে হবে, গুজরাট এমন একটা রাজ্য যেখানে মূলধারার রাজনীতিবিদরা সংখ্যালঘুর সম্প্রদায়ের লোকেদের সঙ্গে প্রকাশ্যে দেখাসাক্ষাৎ করতে অস্বস্তি বোধ করেন। সেরকম একটা রাজ্যে সিসোদিয়ার এই ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ। এখানেই শেষ নয়।

আরো পড়ুন বিলকিস বানো: ছাত্রীর সঙ্গে অসমাপ্ত আলোচনা

কয়েকদিন আগে কেজরিওয়াল এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে টাকার উপর লক্ষ্মী আর গণেশের ছবি ছাপানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। কেজরিওয়ালের মতে এই ব্যবস্থা নিলে ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রতিরোধ করা যাবে এবং অর্থনীতির হাল ফিরবে। তিনি আরও বলেছেন, ইন্দোনেশিয়া যদি এ কাজ করতে পেরে থাকে, ভারত কেন পারবে না?

অনেকের মতে এই কথাগুলো গুজরাটের বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী ভোটারদের কথা মাথায় রেখে বলা। তবুও এই কথা শুনে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কেজরিওয়ালের বহু নামকরা সমর্থক বিস্মিত। কেন বিস্মিত তা অবশ্য বেশি বিস্ময়কর। কেজরিওয়াল কি এই প্রথমবার হিন্দুত্ব কার্ড খেললেন? কয়েক মাস পিছিয়ে যাওয়া যাক। মিউনিসিপাল কর্পোরেশন অফ দিল্লি (এমসিডি)-র বুলডোজারগুলো যখন জাহাঙ্গীরপুরী গুঁড়িয়ে দিতে গিয়েছিল তখন কেজরিওয়ালের দল টুঁ শব্দ করেনি। তারপর আপ নেত্রী আতিশি মারলেনা জাহাঙ্গীরপুরীর বাসিন্দাদের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি বলে দেগে দেন।

তারও আগে ২০২০ সালে যখন দিল্লি দাঙ্গায় পুড়ছিল, তখন কেজরিওয়ালের নীরবতার কথাই বা কী করে ভোলা যায়? অথবা শাহীনবাগের আন্দোলনের সময়কার নীরবতা? শুধু তাই নয়, দিল্লি পুলিস তাঁর সরকারের অধীন হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে শাহীনবাগ খালি করে দেওয়া হত বলেও কেজরিওয়াল আস্ফালন করেছিলেন। গতবছর তো ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ্যে দিওয়ালি পূজনও করেছেন। দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ভোটারদের তীর্থ করতে নিয়ে যাওয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও নিশ্চয়ই সকলে ভুলে যাননি, কিম্বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সম্পর্কে আপের অবস্থান আর সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বিলোপ সমর্থন। অতি সাম্প্রতিককালে আবার কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রার প্রভাব খাটো করতে কেজরিওয়াল ‘মেক ইন্ডিয়া নাম্বার ওয়ান’ রোড শো করতে নেমেছিলেন।

অবশ্য আপকে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল শক্তি ভাবার ভুল কেবল উদারপন্থী সাধারণ মানুষ বা সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাই করেছিলেন তা নয়। বিভিন্ন দলের পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদরাও ঠকে গিয়েছিলেন। যেমন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম। ২০২০ সালে আপ দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আপ জয়লাভ করার পর তিনি টুইট করেছিলেন, এই জয় মিথ্যাচার এবং মেরুকরণের বিরুদ্ধে এবং ২০২১ ও ২০২২ সালে যেসব রাজ্যে ভোট আছে সেখানকার ভোটারদের সামনে দিল্লিকে সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

প্রণব মুখার্জির মেয়ে, কংগ্রেস নেত্রী শর্মিষ্ঠা মুখার্জি তখন জানতে চান কংগ্রেস বিজেপিকে হারানোর কাজটা আঞ্চলিক দলগুলোর হাতেই ছেড়ে দিল কিনা।

এমনকি এ বছর মার্চ মাসেও চিদম্বরম বলেছিলেন, কংগ্রেস আপের সঙ্গে জোটে জুনিয়র পার্টনার হতে পারে।

এতগুলো দৃষ্টান্ত দেখে কী বোঝা যায়? আপ যে উদারপন্থী বামমনস্ক (লিবারাল লেফট) মানুষের প্রতিনিধি নয় তা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আসলে দলটা কখনোই তা ছিল না। তাহলে তারা কি দক্ষিণ ঘেঁষা মধ্যপন্থী শক্তি, যাদের উদ্দেশ্য বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে কংগ্রেসের ভোট ভাগ করে বিজেপিকে সাহায্য করা? বহুদিন ধরে অনেকেই এমনটা মনে করে আসছেন। এই যুক্তিকে সমর্থন জোগানোর মত উদাহরণও রয়েছে। তবুও বলা চলবে না যে আপ বিজেপির বি টিম। তারা ৬এ, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের নির্দেশ পালন করে না। নাগপুরের নির্দেশে চলে এমন সম্ভাবনাই বেশি।

আরএসএস আর কেজরিওয়ালের সম্পর্ক সেই ইন্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন (আইএসি) সংগঠনের সময় থেকেই বেশ পরিষ্কার। আন্না হাজারে এবং তাঁর কুড়িয়ে বাড়িয়ে তৈরি সংগঠন যে রামলীলা ময়দানের ধরনা সংগঠিত করতে বা চালিয়ে যেতে পারত না তা যদি কেউ না-ও জানেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘই যে সবরকম সাহায্য সহযোগিতা জোগাচ্ছিল সেকথা মোটেই গোপন নেই। পরবর্তীকালে আপের দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যোগেন্দ্র যাদব এবং প্রশান্ত ভূষণও একথা বলেছেন। তাঁরা অবশ্য অনেককাল আগেই দল থেকে খসে পড়েছেন।

কিন্তু আপের এমন কী আছে যা আরএসএসের কাজে লাগে?

প্রথমত, বিজেপি যা যা করে আপ তার সবকটাই করতে পারে অনেক সূক্ষ্মভাবে। দ্বিতীয়ত, সিএএ এবং ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সম্পর্কে তাদের অবস্থান আপের জাতীয়তাবাদী পরিচয়কে পাকা করেছে। তৃতীয়ত, আপ উদারপন্থীদের অনেককে আকর্ষণ করতে পারে। ঠিক যে কাজটা অটলবিহারী বাজপেয়ী পারতেন। চতুর্থত, বিজেপির একটা সাংস্কৃতিক সমস্যা আছে যা আপের নেই। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে বিজেপিকে এখনো উত্তর ভারতীয় ‘হিন্দি’ পার্টি বলে মনে করা হয়। ফলে বেশকিছু রাজ্যে বিজেপি এখনো সুবিধা করতে পারছে না। কিন্তু আপ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা প্রচলিত না থাকায় সহজেই স্থানীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পারে।

এককথায় আপ অপ্রিয় খবর তৈরি না করা বিজেপি বা দুর্নামবিহীন বিজেপি হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আপের উত্থান কি দেশের পক্ষে ভাল?

একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আগামীদিনে আমরা বিপুল পরিমাণ প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্ব দেখতে পাব। গুজরাটে বিজেপির অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্তই তার প্রমাণ। এসব আরও বাড়বে এবং তাতে ভারতের সংখ্যালঘুরা আরও কোণঠাসা হবেন। আপ হয়ত প্রকাশ্যে সংখ্যালঘুদের প্রতি অমানবিক ব্যবহার, আইন প্রণয়ন ইত্যাদিকে সমর্থন করবে না, কিন্তু তারা চুপ করেই থাকবে, যা আসলে নীরব সমর্থন। ভারতবর্ষের পক্ষে তা দুর্ভাগ্যজনক।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.