প্রথম দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা, দ্বিতীয় দিন প্রধানমন্ত্রীর পুলিসবাহিনীর জন্য এক দেশ এক উর্দির আহ্বান, সঙ্গে “কলমধারী মাওবাদী”-দের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা। দুদিনের চিন্তন শিবিরে আরও স্পষ্ট হল কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী চরিত্র। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক আয়োজিত এই চিন্তন শিবিরে বিভিন্ন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক, গোয়েন্দা প্রধান, আধাসামরিক বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেলরা উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) গুরুত্ব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের সব রাজ্যে এনআইএর দপ্তর খোলা হবে। একইসঙ্গে ফৌজদারি দণ্ডবিধি এবং আরও নানা আইন সংস্কারের ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন। দ্বিতীয় দিন প্রধানমন্ত্রী সব রাজ্যকে পুলিসের একই উর্দির কথা ভাবতে আহ্বান জানিয়েছেন। দুজনেরই যুক্তি হল, অপরাধের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক গণ্ডি আজ আর নেই। তাই রাজ্যগুলির সঙ্গে সমম্বয়ের মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তাকে আরও মজবুত করতে হবে।
প্রত্যাশিতভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই মানসিকতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই ভাবনা কেবল সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোই নয়, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর উপরেও আঘাত হানবে। ২০০৮ সালে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ইউপিএ সরকার এনআইএ গঠন করে। বিজেপি সরকার এনআইএ আইন সংশোধন করে তার ক্ষমতা বাড়িয়েছে। রাজ্যের অনুমতি বা আবেদন ছাড়াও এনআইএ এখন যে কোনো ঘটনার তদন্ত করতে পারে। সংস্থার কাজের এক্তিয়ার ও পরিধি বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে মাদক পাচার, মানুষ পাচার, বেআইনি অস্ত্র নির্মাণ বা ব্যবহার, সাইবার অপরাধ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তারা তদন্ত করতে পারে। রাজ্য সরকারের ক্ষমতা খর্ব করে এনআইএকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার অসংখ্য নজির দুবছরের মধ্যেই দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সংবিধান অনুসারে রাজ্যের হাতে থাকলেও কেন্দ্রের নাক গলানো আরও বাড়বে। এক দেশ এক উর্দির আহ্বানের মধ্য দিয়ে রাজ্যগুলোর পুলিসবাহিনীকে এক ছাতার তলায় বা সারা দেশকে এক সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার ভয়ঙ্কর মানসিকতা প্রকাশ পেল।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বিজেপি সরকার আট বছরের শাসনকালে রাজ্যগুলোর ক্ষমতা খর্ব করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করার জন্য একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গসহ তিনটে সীমান্তবর্তী রাজ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আয়ত্তাধীন এলাকা বাড়ানো হয়েছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, শ্রমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রের খবরদারি বেড়েছে। অতি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি সরকারি কাজে, শিক্ষায় জোর করে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান আদর্শে বলীয়ান বিজেপি তথা সংঘ পরিবার দেশের বহুত্ববাদকে শত্রু বলে মনে করে। দেশ হবে একমাত্রিক। ধর্ম, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা – কোনোকিছুতেই বৈচিত্র্য থাকবে না। স্বাভাবিকভাবেই তাদের কল্পনার একমাত্রিক ভারতে ভিন্ন মতেরও কোনো স্থান থাকতে পারে না। গণতন্ত্র নয়, একমাত্র সামরিক শাসনব্যবস্থাতেই এই স্বপ্ন সফল করা সম্ভব।
গোরক্ষার নামে নরহত্যা থেকে শুরু করে ধর্ষকের সমর্থনে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল, অতি সম্প্রতি বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়া এবং তাদের নিয়ে উল্লাস – সবেতেই এই মানসিকতা ফুটে উঠছে। ভারতে আজ মন্ত্রীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গুলি করে মারার হুমকি দিতে পারেন, বিদ্বেষমূলক ও প্ররোচনামূলক ভাষণ দিতে পারেন; সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এমনকি বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। এসবই দেশপ্রেম। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই দেশদ্রোহিতা।
দেশের নিরাপত্তার নামে, অপরাধ দমনের নামে গণতন্ত্রের পরিসর ক্রমশ ছোট করে দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মকাণ্ডের অস্ত্র হল ইউএপিএ (বেআইনি কার্যকলাপ নিবারক আইন), এনআইএ, রাষ্ট্রদ্রোহিতাবিরোধী আইনের মত বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক আইন। এখন এনআরসিবিরোধী আন্দোলন করলে উমর খালিদ, শার্জিল ইমামদের জেল খাটতে হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরলে সাংবাদিকদের ইউএপিএ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতাবিরোধী আইনে কারারুদ্ধ করা হয়। “আর্বান নকশাল” তকমা দিয়ে সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীদের বছরের পর বছর বন্দি রাখা হয়, ফাদার স্ট্যান স্বামীকে শহিদ হতে হয়। দিল্লি গণহত্যায় যুক্ত অপরাধীরা বীরের সম্মান পায় আর দাঙ্গাবিরোধীরা দেশদ্রোহী তকমা পান। এ এমন এক সময় যখন গান্ধীবাদী সমাজকর্মীকেও মাওবাদী বলা হয়। সন্দেহ নেই, “কলমধারী নকশাল” শব্দবন্ধ ব্যবহার করে আগামীদিনে প্রতিবাদী লেখক, সাহিত্যিকদের ওপর সন্ত্রাসকে আরও পাকাপোক্ত করার ইঙ্গিত দেওয়া হল।
শুধুমাত্র সরকার নয়। বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যমসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন অন্য স্তম্ভগুলোর ভূমিকাও কিন্তু কম ভয়ানক নয়। মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত রাজনৈতিক কর্মীরা বছরের পর বছর জামিন পান না। স্ট্যান স্বামী, ভারভারা রাও, গৌতম নওলাখাদের চিকিৎসার সুযোগ পেতেও আলাদা করে আদালতে আবেদন করতে হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের যুক্তি খাড়া করে রাম মন্দির-বাবরি মসজিদের মত সংবেদনশীল মামলায় রায় দেওয়া হয়। কর্পোরেট মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমও রাষ্ট্রের সুরে সুর মেলায়।
আরো পড়ুন স্ট্যান স্বামী হত্যা: আমাদের কিছু যায় আসবে কি?
দেশের নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক হল ক্ষুধা, অপুষ্টি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকার সমস্যা। দেশের পয়লা নম্বর শত্রু হল ক্রমশ বেড়ে চলা বৈষম্য। যে দেশে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তির বাস, সেই দেশই বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১ দেশের মধ্যে ১০৭তম স্থান পায়। যে রাষ্ট্রনীতি এই বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেই নীতিই গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে। হিন্দুত্ববাদীদের সামরিক আস্ফালনকে তাদের কর্পোরেট তোষণের নীতি থেকে আলাদা করে দেখলে লড়াইটাই করা যাবে না। ২০০৮ সালেই এনআইএ গঠনের পাশাপাশি ইউএপিএ সংশোধনের মাধ্যমে আরও কঠোর করা হয়েছিল। অপারেশন গ্রিন হান্ট, যৌথ বাহিনী ইত্যাদি সামরিক শব্দবন্ধের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলায় কেন্দ্রের খবরদারি বাড়ানো হয়েছিল। এসবই হয়েছিল দেশের নিরাপত্তার নামে, সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে। তা নিয়ে বাম দলগুলোর একাংশের উল্লাস ভোলবার নয়। ভুলে যাওয়া হয়েছিল এসবের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার, অতিকেন্দ্রীভূত এবং সামরিক শাসনব্যবস্থার বীজ বপন করা হচ্ছে। সেই বীজই আজ ফ্যাসিবাদীদের অস্ত্র। জমি অধিগ্রহণ, জল, জঙ্গল, খনি, পাহাড়ের উপর কর্পোরেট আধিপত্যের বিরুদ্ধে দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমনই ছিল সেদিন ইউপিএ সরকারের আসল উদ্দেশ্য। আজ সেই আইনগুলোকেই আরও কঠোরভাবে কর্পোরেট তোষণের কাজে লাগানো হচ্ছে। সেদিন এই রাজ্যের বিরোধী দল ইউএপিএর বিরোধিতা করলেও, আজ শাসক হিসাবে তারা এই আইন প্রয়োগ করে চলেছে।
একটা দক্ষিণপন্থী দলের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেদিন যে বামেরা এসব সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা কি ভুল স্বীকার করবেন? বিজেপি প্রতিবাদীদের নকশাল তকমা দিয়ে আজ যে গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ করে চলেছে, তার ভিত কি সেদিনই গড়ে তোলা হয়নি? বামেরা যদি রাজনৈতিক কৌশলের শ্রেণি অভিমুখ ভুলে যান, তাহলে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করা যায় না। নিছক ভোটের ময়দানে ফ্যাসিবাদীদের পরাস্ত করাও যায় না। ভোটের পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে অবশ্যই সংঘ পরিবার তাদের লক্ষ্যপূরণের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু ভোটে তারা পরাজিত হলেও ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির উপাদান থেকেই যায়। তাই নির্বাচনী রাজনীতির পাশাপাশি সংসদ-বহির্ভূত একটা সংগ্রামও থেকে যায়। শ্রেণি রাজনীতির সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলন, পুঁজির আধিপত্যবিরোধী আন্দোলনের সখ্য গড়ে তুলে সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সংঘ পরিবারের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান কর্মসূচির মোকাবিলা করার অন্য কোনো পথ নেই।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।