এ বছরের মত নির্বাচনের মরসুম শেষ হয়েছে। মরসুমের প্রথম রাউন্ডটা যদি বিজেপি (উত্তরপ্রদেশ, গোয়া আর উত্তরাখণ্ডে ক্ষমতায় ফেরার কারণে) আর আম আদমি পার্টি (পাঞ্জাব জেতার জন্যে) জিতে থাকে, তাহলে বলতে হবে এই রাউন্ডে বিজেপি আর কংগ্রেস সমান সমান। বিজেপি গুজরাটে ক্ষমতা ধরে রেখেছে আর কংগ্রেস হিমাচল প্রদেশে ক্ষমতা দখল করেছে।

দুটো রাজ্যের ফলাফলই প্রত্যাশিত। অতি বড় কংগ্রেস সমর্থকও আশা করেননি যে গুজরাট বিজেপির হাত থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে। হিমাচলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ছিল, যা শেষপর্যন্ত ৪০ আসন নিয়ে কংগ্রেস স্বচ্ছন্দে জিতেছে। এই দুই রাজ্যের ফলাফল একটু খতিয়ে দেখা যাক।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

গুজরাট

বিজেপি জিতবে জানাই ছিল, তবে জয়ের ব্যবধানটা অনেককেই অবাক করেছে। বিজেপি কেবল আসন সংখ্যাই বাড়ায়নি (২০১৭ সালের ৯৯ থেকে ১৫৬ আসনে পৌঁছেছে), ৫৩% ভোটও পেয়েছে। একটা দল সাতাশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও এই সাফল্য নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে কংগ্রেস প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ৭৭ আসন, এবারে নেমে এসেছে ১৭ আসনে। আর ভোট পেয়েছে ২৮ শতাংশের একটু কম। রাজ্যে এই প্রথম পা রাখা দল আপ জিতেছে পাঁচটা আসনে আর পেয়েছে ১৩% ভোট। দিল্লি থেকে আপকে নিয়ে যেরকম হইচই করা হচ্ছিল সংবাদমাধ্যমে, তার তুলনায় এই ফল বেশ খারাপ।

তা গুজরাটের এই ফলের ব্যাখ্যা কী? এমন হতেই পারে না যে কোনো সরকারবিরোধী হাওয়া আদৌ ছিল না। বহুল প্রচারিত গুজরাট মডেল যে যতটা বাস্তব তার চেয়ে বেশি মিথ তা সবাই জেনে ফেলেছে। গুজরাটে এখন বেকারত্বের হার যথেষ্ট বেশি। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যে ভেঙে পড়ছে সেটা কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। গ্রামের মানুষ কষ্টে আছেন, বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্র বেহাল। মানব উন্নয়ন সূচকে গুজরাট শীর্ষস্থানের ধারেকাছে নেই। মরবী ট্র্যাজেডির মত ঘটনা পরিষ্কার দেখিয়ে দেয় দুর্নীতি কোথায় পৌঁছেছে। এতকিছু সত্ত্বেও এই রাজ্যে বারবার বিজেপিকেই জেতে। কেউ কেউ এর জন্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে দায়ী করেন। সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু নির্বাচনী কারচুপির কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

আরেকটা ব্যাখ্যা হল, গুজরাট অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক একটা রাজ্য। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্রেফ মুসলমানদের ‘টাইট দেওয়া যাবে’ ভেবেই বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। সত্যি কথা বলতে কি, একগুচ্ছ এমন ঘটনা ঘটেছে যার ফলে এই ব্যাখ্যাকে সঠিক মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার জন্য প্রকাশ্যে কৃতিত্ব দাবি করেছেন। তাতে যে তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি শুধু তাই নয়, নির্বাচনে লাভই হয়েছে বলা যায়। ওই দাঙ্গার জন্যে শাস্তিপ্রাপ্ত একজনের মেয়ে এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জিতেও গেছে। যে বিজেপি প্রার্থী বিলকিস বানোর ধর্ষকদের ‘সংস্কারী ব্রাহ্মণ’ বলেছিল, সে-ও বেশ ভাল ব্যবধানে জিতেছে। রাজ্যের পরিস্থিতি এমনই, যে কোনো বিরোধী দলই বিলকিসের ১১ জন ধর্ষককে রেহাই দেওয়াকে নির্বাচনী ইস্যু করল না। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ভয় তাদের মধ্যেও এত প্রবল।

কিন্তু এইসব ব্যাখ্যার বাইরেও নিশ্চয়ই কিছু আছে। এক বাক্যে “গুজরাট সাম্প্রদায়িক” বলে উড়িয়ে দেওয়া তো সহজ কাজ। কথাটা সত্যি হলেও একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে এই ফলের ওটাই একমাত্র কারণ নয়। বিজেপি সফলভাবে এই নির্বাচনকে “বিজেপিই গুজরাট, বাকিরা বহিরাগত” – এই ছকে ফেলে দিতে পেরেছিল। ঠিক যে কৌশলে তৃণমূল কংগ্রেস ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে একঘরে করেছিল। এমনটা করা গেলে বেকারত্ব, দুর্নীতি, কৃষকদের দুর্দশা ইত্যাদি ইস্যুকে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।

কেউ বলতেই পারেন যে নির্বাচনটাকে এরকম বাইনারিতে ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও তো পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ৩৮% ভোট এবং ৭৭টা আসন জিততে পেরেছিল। গুজরাটে কংগ্রেস এর অর্ধেকও পারল না কেন? উত্তরটা খুব কঠিন নয়। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আর বিজেপি – উভয় পক্ষের হাতেই নিজেদের পছন্দের বয়ান প্রচার করার উপযুক্ত রসদ ছিল। রাজ্যের সংবাদমাধ্যম তৃণমূলকে তাদের বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল আর গোটা জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যম তার উল্টো বয়ান প্রচার করার কাজে লেগে ছিল। গুজরাটে কিন্তু এই সুবিধা কংগ্রেস পায়নি। বিজেপি, এমনকি আপের তারস্বর প্রচারেরও পাল্টা প্রচার করার কোনো উপায় ছিল না কংগ্রেসের। তাই কংগ্রেস এবার অন্য একটা জিনিস চেষ্টা করেছিল। তারা যথাসম্ভব কম কোলাহলে প্রচার চালিয়েছে একেবারে মাইক্রো স্তরে। ছোট ছোট মিটিং করেছে, আসল ইস্যুগুলোর উপরে জোর দিয়েছে। যেসব বিষয় ভোটারদের মেরুকরণ করে সেগুলো এড়িয়ে গেছে।

দেশের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টিকে একাধিক ফ্রন্টে অসম লড়াই লড়তে হয়েছে। গুজরাটে দলত্যাগের সমস্যায় জর্জরিত কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে বিজেপির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার অবস্থাতেই নেই। আর মিডিয়া যে গেরুয়া দলটার সম্পূর্ণ অধীন তা বলাই বাহুল্য। মিডিয়া যে ধারাবাহিকভাবে আপকেই প্রধান বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করে গেছে সেটা কংগ্রেসের কাজ আরও কঠিন করে তুলেছে। পার্টি ক্যাডার এবং ভোটাররা এতে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের তুলনায় এবারে ভোটদানের হারও অনেকখানি কমে গেছে। ভোটার তালিকা বিশ্লেষণ করলে হয়ত দেখা যাবে যাঁরা ভোট দিতে যাননি তাঁদের একটা বড় অংশ কংগ্রেস ভোটার।

আপ কি বিজেপির কাজ সহজ করে দিয়েছে? ভোট শতাংশের হিসাব দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। আপ আর কংগ্রেসের ভোট যোগ করলেও বিজেপি অনেকখানি এগিয়ে। তবে হয়ত কিছু আসনে আপ না থাকলে বিজেপি কংগ্রেসের কাছে হারত। কিন্তু সার্বিক ফলাফল একই থাকত। যেখানে আপের ভূমিকা সত্যিই প্রভাব ফেলেছে সেটা হল বিরোধিতার পরিমণ্ডল তৈরি করা। আপ সফলভাবে নিজেদের বিরোধী হিসাবে তুলে ধরায় কংগ্রেসের ক্ষতি হয়েছে। মাসের পর মাস টিভি চ্যানেলগুলো বলে গেছে, কংগ্রেস লড়াইতেই নেই। সত্যি কথা বলতে কংগ্রেসও এই ধারণা বদলানোর জন্যে কোনো চেষ্টাচরিত্র করেনি। গুজরাটের ফল যা করল সেটা হল আপকে জাতীয় পার্টির প্রতীকী তকমা পাইয়ে দিল। কিন্তু সে তকমা তারা ধরে রাখতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। আপের বেশিরভাগ প্রার্থীই বলতে শুরু করেছেন যে তাঁরা নিজেদের কৃতিত্বে জিতেছেন। খবরে প্রকাশ, একজন সদ্য নির্বাচিত আপ বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এবং বাকি চারজনও পা বাড়িয়েই আছেন।

হিমাচল প্রদেশ

হিমাচল পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলে ফেলার প্রথা বজায় রেখেছে। রাজ্যে প্রবল সরকারবিরোধী আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল এবং কংগ্রেস তার ফায়দা তুলেছে। বিজেপি কিন্তু আটকানোর প্রবল চেষ্টা করেছিল। তাদের প্রচার ব্যক্তিগতভাবে দেখাশোনা করেছেন সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নয় নয় করে দশবার রাজ্যে এসেছেন এবং প্রত্যেকবার কোনো না কোনো নতুন নাটক দেখিয়েছেন। কিন্তু বিজেপিকে ঝামেলায় ফেলে দিল দুটো জিনিস।

প্রথমত, হিমাচল হল ভারতের সবচেয়ে “হিন্দু” রাজ্য। সংখ্যালঘুরা জনসংখ্যার মাত্র ৩%, মুসলমানরা মাত্র ২%। মানে জুজু হিসাবে দেখানোর মত যথেষ্ট পরিমাণ মুসলমান নেই হিমাচলে। ফলে বিজেপি হিন্দু-মুসলমান কার্ড খেলতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, হিমাচল থেকে বড় অংশের মানুষ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ফলে অতীতে এখানে বহুবার জাতীয় নিরাপত্তা বিজেপির তুরুপের তাস হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওয়ান র‍্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন আর অগ্নিবীর প্রকল্পের ঠ্যালায় এবার বিজেপি নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই পড়েছে।

আরো পড়ুন অগ্নিপথ: বেকারত্বের আগুন নেভাতে পারছে না জাতীয়তাবাদ

এইসব কারণে রাজ্যে কোনো মেরুকরণ কাজ করেনি, নির্বাচন হয়েছে মৌলিক ইস্যুগুলোর উপর ভিত্তি করে। তার উপর ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং বিক্ষুব্ধ প্রার্থীরা। অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে স্বয়ং মোদীকে এক বিক্ষুব্ধ প্রার্থীকে ফোন করে অনুরোধ করতে হয়েছে তিনি যেন ভোটে না দাঁড়ান। সে কাজে মোদী ব্যর্থ হন। আপও এ রাজ্যে ছাপ ফেলতে চেয়েছিল। প্রতিবেশী রাজ্যে পাঞ্জাবে ক্ষমতায় এসেই হিমাচলে প্রচার শুরু করেছিল। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কিছুটা লাভ হবে বলে আশাও করা গিয়েছিল। কিন্তু মাঝপথেই তাদের প্রচার নেতিয়ে পড়ে এবং তারপর থেকে তারা লড়াইয়ে ছিলই না।

এমসিডি

গুজরাট আর হিমাচল প্রদেশ ছাড়া মিউনিসিপাল কর্পোরেশন অফ দিল্লির (এমসিডি) নির্বাচনও হয়েছে। সেটা নিয়েও সংবাদমাধ্যমের বিস্তর আগ্রহ ছিল। তার অবশ্য কারণও আছে। দিল্লি দেশের রাজধানী হওয়ার কারণে সবসময়েই অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। এমসিডির নির্বাচনে এবার আপ বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। প্রত্যাশিতভাবেই কংগ্রেস অনেক কম আসন পেয়ে তৃতীয় হয়েছে। দিল্লির বিভিন্ন স্তরের লোকের সঙ্গে কথা বললে যে কথাটা উঠে আসছে সেটা হল রাজ্য সরকারেও নেই, কেন্দ্রীয় সরকারেও নেই এমন দলকে ভোট দিয়ে কোনো লাভ নেই বলে তাঁরা মনে করেন। দিল্লির নাগরিকদের জন্যে কংগ্রেসের কাছে হয়ত একটা বার্তা ছিল, কিন্তু তারা নির্বাচনী বয়ানে কোনো জায়গা করে নিতে পারেনি। কংগ্রেস বরং মেয়র পদপ্রার্থী হিসাবে একজনের নাম ঘোষণা করতে পারত। এমন কারোর নাম যিনি পরিচিত মুখ এবং মিডিয়ার নজর টানতে পারেন। তাতে পার্টির বার্তা মানুষের কাছে কিছুটা পৌঁছতে পারত এবং হয়ত ফলাফলের কিছুটা তারতম্য হত। অবশ্য এই ফলেরও একটা আশাব্যঞ্জক দিক আছে। মুসলমান ভোটারদের একটা বড় অংশ, যাঁরা আপকে ভোট দিচ্ছিলেন গত কয়েক বছর ধরে, তাঁরা আবার কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। এ থেকে আপ আর কংগ্রেস – দুটো দলেরই শিক্ষা নেওয়া উচিত।

তাহলে এমসিডি আর দুটো রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল থেকে আমরা কী কী সিদ্ধান্ত নিতে পারি?

প্রথমত, মোদী জনপ্রিয় তো বটেই, কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা সারা ভারতে সমান নয়, অনতিক্রম্যও নয়। তিনি হিমাচল প্রদেশের পাঁচ বছরের সরকারবিরোধী আবহাওয়া বদলে দেওয়ার মত জনপ্রিয় নন। বারবার ওই পাহাড়ি রাজ্যেও গিয়ে তিনি প্রতি নির্বাচনে সরকার বদল করার যে ধারা তা বদলাতে পারেননি।

দ্বিতীয়ত, সংবাদমাধ্যম যে গুজরাট নিয়েই পড়ে ছিল তাতে ভালই হয়েছে। হিমাচলের নির্বাচন সেভাবেই হয়েছে যেভাবে একটা নির্বাচন হওয়া উচিত। সংবাদমাধ্যম আসল ইস্যুগুলোকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো বয়ান তৈরি করতে পারেনি।

আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, হিমাচলের রায় বিজেপি এবং মোদীকে আঘাত করেছে এমসিডির ফলের চেয়েও বেশি। হিমাচলের হার বিজেপি একেবারেই মেনে নিতে পারছে না। এমনি এমনি সংবাদমাধ্যম মোদী গুজরাটে কতখানি জনপ্রিয় তা নিয়ে বকবক করে চলছে না। ভান করছে হিমাচলে যেন কিছুই ঘটেনি। যখন একটু-আধটু ওই রাজ্যটা নিয়ে কথা বলছে, তখন কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান যে মোটে ১% সে কথাই বারবার বলছে। অথচ যে রাজ্যে মাত্র ৫৫ লক্ষ ভোটার, প্রায়শই একেকটা আসনে হারজিত নির্ধারিত হয় শ খানেক ভোটে, সেখানে ওই শতাংশের হিসাবটার কোনো মানেই নেই। মনে রাখা ভাল, ২০২০ সালে বিহারের মত রাজ্যে (৭.২০ কোটি ভোটার) রাজ্যে কে ক্ষমতায় আসবে তার ফয়সালা হয়েছিল .২০% না ৮৫,০০০ ভোটের ব্যবধানে। মোদী যে হিমাচলে মাত্র কয়েক হাজার ভোট এদিক ওদিক করাতে পারেননি তা নিয়ে বরং বিজেপির দুশ্চিন্তায় থাকা উচিত।

এছাড়া হিমাচল, আর কিছুটা গুজরাটও, দেখিয়ে দিল যে দিল্লির বাইরে আপের বৃদ্ধি স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অনেকটাই টাকা এবং মিডিয়ার মত বাহ্যিক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এই কারণেই আপ দিল্লির পার্শ্ববর্তী হরিয়ানা বা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে এখনো সুবিধা করতে পারেনি।

এবার ভবিষ্যতের আলোচনায় আসা যাক।

২০২৩ সালে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে নির্বাচন আছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর কর্ণাটকের উপর কংগ্রেসকে জোর দিতে হবে। এই রাজ্যগুলোতে রসদের জোগানে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রাজস্থানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সম্পর্কে সাবধান হতে হবে। বিজেপি আর মিডিয়া সামান্যতম মতপার্থক্যকেও খুঁচিয়ে ঘা করতে তৈরি থাকবে। এই রাজ্যগুলোতে সাম্প্রদায়িক অশান্তি লাগানোর চক্রান্তও করা হতে পারে। কর্ণাটকে আপ থাকবে, আসাদুদ্দিন ওয়েসির দল এআইএমআইএমও থাকবে। বিশেষ করে উপকূলের সেই এলাকাগুলোতে ওয়েসিদের প্রভাব আছে যেখানে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া এসডিপিআইয়ের প্রভাব ছিল। হায়দরাবাদ-কর্ণাটক বলে যে অঞ্চলটা পরিচিত সেখানেও ওই দলের বেশ প্রভাব রয়েছে। আর জনতা দল এস তো তাদের অবশিষ্ট শক্ত ঘাঁটিগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করবেই।

এই রাজ্যগুলোর নির্বাচনে ভাল ফল করতে পারলে শুধু যে কংগ্রেস ক্যাডাররা ২০২৪ সালের লড়াইয়ের জন্য উজ্জীবিত হবেন তাই নয়, যেসব ভোটার ভোট দেওয়া ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরাও ফের উৎসাহিত হবেন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য কংগ্রেসের পরিকল্পনা হওয়া উচিত আসনভিত্তিক, রাজ্যভিত্তিক নয়। মানে ধরা যাক ২৫০টা আসনকে চিহ্নিত করা হল, তারপর তাদের তিন ভাগে ভাগ করা হল – ক) ধরে রাখার মত আসন, খ) দ্বিতীয় হওয়া সম্ভব এমন আসন, গ) গা ঘেঁষে তৃতীয় হওয়া/ভাল সংগঠন গড়ে তোলা/ভাল প্রার্থী দেওয়ার মত আসন। সমস্ত মনোযোগ এবং যাবতীয় রসদ এই আসনগুলোকেই দেওয়া উচিত। এখন থেকেই। চেষ্টা করতে হবে সাফল্যের হার যেন ৫৫ শতাংশের বেশি হয়। যদি এমন কোনো প্রার্থী থাকেন যিনি এই তালিকার বাইরের আসন থেকেও জিততে পারেন, তাঁর আসনকে ব্যতিক্রম হিসাবে চিহ্নিত করা উচিত। সেরকম আসনের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। একটা উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ কেন্দ্রের আলি ইমরান রামজ ভিক্টর। সবমিলিয়ে লক্ষ্য হওয়া উচিত ১৩০-এর বেশি আসন জেতা।

শুধু কংগ্রেস নয়, অন্য বিরোধী দলগুলোরও নির্বাচনের একটা দিকে নজর দেওয়া খুব দরকার। সেটা হল জনমত সমীক্ষা। এই সমীক্ষাগুলোর উদ্দেশ্য হওয়ার কথা মানুষের মর্জির আভাস দেওয়া। কিন্তু ভারতে এই সমীক্ষাগুলোকে সংবাদমাধ্যম যাদের নিয়ন্ত্রণে আছে সেই দল ব্যবহার করে। সমীক্ষাগুলোকেই করে তোলা হয় প্রচার বা প্রোপাগান্ডার অস্ত্র। ফলে ভোটের আগের জনমত সমীক্ষা প্রায়শই জনমত তৈরি করার কাজ করে বসে। পাশ্চাত্যে এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবং সেসব গবেষণার ফল এই আশঙ্কাকে পুষ্ট করেছে। বিরোধী দলগুলোর উচিত জনমত সমীক্ষার সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার দাবি তোলার এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর জনমত সমীক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়া। এটা করতে পারলে খেলাটা অনেকখানি সমানে সমানে হবে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.