মাত্র বারো ঘন্টায় তেরোজন খুন, পঞ্চাশজন আহত। এটা কোনো যুদ্ধ বিধ্বস্ত জনপদের বিবরণ নয়। এটা ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের একটিমাত্র দিনের বিবরণ। প্রথম খুন হয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার আমডাঙ্গায়, শেষ খুন নন্দীগ্রামে। এই পর্বেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সিপিএম কর্মী দেবু দাসকে ভোটের আগের দিন রাতে সস্ত্রীক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভোটের দিনের দৃশ্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায় পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া, মনোনয়ন জমা দেওয়া, প্রচারপর্ব কতটা ভয়াবহ ছিল। আরামবাগে বিরোধী দলের এক মহিলা প্রার্থীর শাড়ি পর্যন্ত খুলে নেয় শাসক দলের মদতপুষ্ট লুম্পেনরা।
এমন নয় যে অতীতে পশ্চিমবঙ্গে কোনো নির্বাচন রক্তাক্ত হয়নি, বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচন। নিশ্চিতভাবে পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ রক্তপাতহীন নির্বাচনই বিরল। তবে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয়। রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করে ১০০ শতাংশ পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখলের মরিয়া চেষ্টার ফলাফল ছিল গতবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন। শাসক তৃণমূলকে এর খেসারত দিতে হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। নিঃশব্দ বিপ্লবের মত ১৮ লোকসভা আসন জিতে নেয় বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে নতুন বিরোধী শক্তি হিসাবে বিজেপির উত্থান হয় পঞ্চায়েত ভোটে শাসকের হিংসার সুযোগ নিয়েই।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
২০২১ সালে পুনরায় ক্ষমতা দখলের আগে পরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, বিবৃতি দিয়েছেন যে ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে অতখানি গা জোয়ারি কাম্য ছিল না। দল কড়া হাতে আগামী নির্বাচনে হিংসা নিয়ন্ত্রণ করবে।
বাস্তবে কিন্তু তেমনটা হয়নি। গত পৌর নির্বাচনে শাসক দলের হিংসা নিয়ন্ত্রণ, দলীয় অনুশাসন মুখের কথা হয়েই রয়ে গেছে। হিংসা, রক্তপাত স্বমহিমায় ছিল। বিরোধী তো প্রায় নেই বললেই চলে, তাই সংঘাত হয়েছে নিজেদের মধ্যেও। প্রতিপক্ষ না থাকলে লড়াইয়ের অনুশীলন নিজেদের মধ্যে করার মত ব্যাপার। কিন্তু কেন এই সর্বগ্রাসী, ‘সব আসনেই জিততে হবে’ মনোভাব?
উত্তরে বলতে হয়, পঞ্চায়েত পশ্চিমবঙ্গে লুঠতরাজের মৃগয়াক্ষেত্র। একশো দিনের প্রকল্প, আবাস যোজনা, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের টাকা লুঠ করে এক একজন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। কোনোকিছু না করে স্রেফ পঞ্চায়েত দখল করতে পারলেই যখন অফুরান রত্নভাণ্ডার হাতের মুঠোয় এসে যায়, তখন সর্বগ্রাসী মরিয়া আগ্রাসন আর আশ্চর্য কী? একথা লিখতে দ্বিধা নেই, এই লুঠ অনেকটাই তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রশ্রয়, ৭৫ শতাংশ, ২৫ শতাংশ কাটমানি ফরমুলা এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার ফসল।
তা ২০২৩ সালের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন কি রক্তপাতশূন্য, স্বচ্ছ, অবাধ হবে? তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব তেমন আশ্বাসই দিচ্ছেন। যদিও তাতে ভরসা করার কোনো কারণ নেই। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হলে আর মাত্র চার মাস বাকি আছে। এর মধ্যেই তৃণমূলের বিধায়ক, জেলা সভাপতি, মায় অনেক মন্ত্রীর ভাষণে ভয়াবহ রক্তাক্ত নির্বাচনের ছবি ভেসে উঠছে। অনেকে বলছেন, ভোট হবে ১০০ শতাংশ শাসক দলের। কেউ বলছেন সকাল সকাল ভোট শেষ হয়ে যাবে। কেউ আবার ভোটে বিরোধীদের চরমভাবে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে রাখছেন।
আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ রামপুর বাগটুই। গত ২৫ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত রাজ্যে বোমা বিস্ফোরণের প্রত্যেকটা বিবরণ যদি সংবাদমাধ্যম সবিস্তারে প্রকাশ করত, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আঁতকে উঠতেন। ২৫ অক্টোবর জগদ্দলে রেললাইনের পাশে বোমা বিস্ফোরণে শিশু নিখিল প্রামাণিক মারা যায়। ২৮ অক্টোবর জগদ্দলেরই নরেন্দ্রপুরে ছোড়া বোমার আঘাতে পাঁচ শিশু আহত হয়, মারাও যেতে পারত। ৩০ অক্টোবর নৈহাটি শিবদাসপুরে শুটআউটে খুন হন তৃণমূল নেতা জাকির হোসেন, অভিযুক্ত তৃণমূলেরই নেতা হাসিবুল রহমান।
আরো পড়ুন বগটুই গোটা রাজ্যের জন্য অশনি সংকেত
১৬ নভেম্বর বোমা বিস্ফোরণে মিনাখাঁয় খুন কিশোরী সোহানা খাতুন। ওইদিনই গোষ্ঠী সংঘর্ষে বোমা বিস্ফোরণে এক তৃণমূল নেতার হাত উড়ে যায়। ২২ নভেম্বর খেলতে গিয়ে বোমা বিস্ফোরণে মালদার মানিকচকে আহত হয় দুই শিশু। ২৪ নভেম্বর নদিয়ার তৃণমূল নেতা মতিরুল ইসলাম খুন হন মুর্শিদাবাদে। এক্ষেত্রেও মৃতের পরিবারের অভিযোগ, খুনের কারণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। অভিযুক্তরা প্রত্যেকেই শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত।
৩ ডিসেম্বর পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগর অর্জুনপুর নারুয়া বিলা গ্রামে নিজের বাড়িতে বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে তৃণমূলের বুথ সভাপতি রাজকুমার মান্না মারা যান, সঙ্গে প্রাণ হারান আরও দুজন। ৬ ডিসেম্বর বসিরহাটে তৃণমূল নেতার বাড়িতে মজুত বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় ১১ বছরের রফিকুল ও তার বৌদি সোনিয়া বিবি।
এবার যদি আপনি প্রশ্ন করেন, এত বোমা কেন? উত্তর হবে – সামনে যে পঞ্চায়েত নির্বাচন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।