গত মঙ্গলবার (১৪ জুন) সেনাপ্রধানদের উপস্থিতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং যখন অগ্নিপথ স্কিমের কথা ঘোষণা করলেন তখন সরকার কেন, সম্ভবত বিরোধীরাও আশা করেননি এর ফলে সারা দেশের যুবকরা প্রবল রাগে পথে নেমে পড়ে ট্রেন পুড়িয়ে দেবেন, ভাংচুর করবেন, একজনের মৃত্যু হবে, এমনকি বিহারে বনধ ডাকা হবে। কেন এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া হল তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।
সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়া মানে একজন যুবকের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত। পরবর্তী কুড়ি-পঁচিশ বছর তার কোনো আর্থিক দুশ্চিন্তা থাকে না। সেনাবাহিনীতে যারা যায় তাদের অনেকেই আসে কৃষক পরিবার থেকে। অর্থাৎ তাদের চাষবাস থেকে কিছুটা রোজগার থাকে। পাশাপাশি পরিবারের একজন যদি সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়, তাহলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থায়ী রোজগার নিশ্চিত হয়। গ্রামে গঞ্জে এই আর্থিক নিরাপত্তা মানুষের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। এ তো গেল আর্থিক দিক। বিশেষ করে উত্তর ভারত ও মধ্য ভারতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার একটা সামাজিক উপযোগিতাও আছে। কুড়ি-পঁচিশ বছরের একজন যুবক যদি ভারতীয় সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরি পায়, তাহলে তার সামাজিক সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং আয়ের নিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কারণে বিয়ের জন্য যোগ্য পাত্রী পাওয়া সহজ হয়। স্বাভাবিকভাবেই মাত্র চার বছরের চাকরি বিপুল সংখ্যক যুবকের আশাভঙ্গের কারণ হয়েছে। যারা সেনাবাহিনীতে যাবে ঠিক করে, তারা অনেক আগে থেকেই শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। হঠাৎ অগ্নিপথ স্কিম এসে তাদের বহু বছরের আশা, আকাঙ্ক্ষা, পরিশ্রম ব্যর্থ করার উপক্রম করলে তারা কী করে মেনে নেবে?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সরকার বলছে প্রতিরক্ষা বাজেটের একটা বড় অংশ খরচ হয় সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন দিতে; অগ্নিপথ স্কিম চালু হলে সেই খরচের বোঝা কমবে। কিন্তু পেনশনের খরচ অন্যভাবেও কমানো যেত। চাকরির মেয়াদ পরিবর্তন না করে যারা নতুন যোগ দিচ্ছে তাদের চুক্তিপত্রেই পেনশন না দেওয়ার কথা রাখা যেত। সে জন্যে এরকম দুদিনের চাকরি সৃষ্টি করার দরকার ছিল না। ধরা যাক, এক যুবক ২১ বছর বয়সে অগ্নিপথ স্কিমে চাকরি পেল। সে যখন বেরিয়ে আসবে ততদিনে তার বয়স হবে ২৫। সেই বয়সে সে নতুন করে কোন কাজ শিখে কিসে আবেদন করবে? সরকার বলছে বটে অগ্নিবীরদের পুলিসে বা আধাসামরিক বাহিনীগুলোতে নিয়োগ করা হবে, কিন্তু এর গ্যারান্টি দেবে কে? সারা দেশে এখনই এই বাহিনীগুলোতে যথেষ্ট শূন্যপদ আছে। সেগুলো পূরণ করার কোনো উদ্যোগ তো দেখা যাচ্ছে না। খোদ সেনাবাহিনীতেই বহু শূন্যপদ রয়েছে। সেখানেই যখন এরকম স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তখন অগ্নিবীররা চার বছর পর অন্য বাহিনীতে চাকরি পাবে – এই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করা শক্ত। সেই কারণেই ক্রুদ্ধ যুবকদের ক্যামেরার সামনে বলতে দেখা যাচ্ছে “সরকার আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে।”
এ তো গেল চাকরিপ্রার্থীদের রাগের কারণ। অগ্নিপথ স্কিম সেনাবাহিনীর উপর কী প্রভাব ফেলবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার। সরকারের খরচ না হয় কমল, কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষতার উপর যে প্রভাব পড়তে পারে বলে বহু প্রাক্তন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তা উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, একজন সৈনিক মাত্র চার বছর সেনাবাহিনীতে থাকবে জেনে জীবনের ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? তার ভবিষ্যৎ, পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয় জেনে যেনতেনপ্রকারেণ যতটা সম্ভব টাকা রোজগার করে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। ফলে সেনাবাহিনীতে নানাবিধ দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
দ্বিতীয়ত, অগ্নিপথ স্কিমের মাধ্যমে যাদের নেওয়া হবে তাদের মাত্র ছ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অথচ বিদেশি শক্তির সাথে পুরোদস্তুর যুদ্ধের কথা বাদ দিন, দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ার উপযুক্ত হতেই প্রায় দু বছরের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অনেকে মনে করেন ঝানু গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য দু বছরের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট নয়। তার মানে পাকাপোক্ত হতে হতেই চাকরির অর্ধেক মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে এবং ছ মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে কমব্যাট রোলে ঠেলে দেওয়া মানে দেশের পক্ষে বিরাট ঝুঁকি নেওয়া, এদেরও বিপদে ফেলা।
এখন আমরা যাদের ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দিতে দেখছি, বিভিন্ন জায়গায় ভাংচুর চালাতে দেখছি, তাদের নেহাত বোকাসোকা গেঁয়ো ভূত মনে করলে ভুল হবে। এরা হল সেইসব ছেলে, যারা বছরের পর বছর একসঙ্গে এক জায়গায় থেকে পড়াশোনা এবং শরীরচর্চা করে সেনাবাহিনীর পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এদের অনেকের পরিবার বংশানুক্রমে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। ফলে সরকারের এই স্কিমের ত্রুটিগুলো এদের কাছে একদম পরিষ্কার। এরা জানে, চার বছর পরে কর্পোরেট চাকরির যে গাজর ঝোলানো হচ্ছে তা-ও স্রেফ ভাঁওতা। গত কয়েক বছরে কর্পোরেট জগতে কটা চাকরি হয়েছে? বরং সর্বত্র ছাঁটাই চলছে। এমনিতেই বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতি ভাল অবস্থায় নেই, তার উপর রয়েছে অতিমারীর প্রভাব। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতে কর্মসংস্থানের অভূতপূর্ব অবনতি হয়েছে। সুতরাং সরকারের কথায় কেউ ভুলছে না। এমন তো নয় যে কেন্দ্রীয় সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রের সাথে কোনো মউ স্বাক্ষর করেছে, যেখানে বলা আছে চার বছরের টুর অফ ডিউটির পরে অগ্নিবীরদের তারা চাকরি দেবে। আজকের পরিস্থিতিতে সরকারের মুখের কথায় কে বিশ্বাস করবে?
গত কয়েক দিনে সারা দেশে অগ্নিপথ স্কিম নিয়ে আলোচনায় আরও একটা আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। সেটা হল যারা চার বছর পরে সেনাবাহিনীতে থেকে যাওয়ার সুযোগ পাবে না (ঘোষণা অনুযায়ী, ২৫% অগ্নিবীরকে থেকে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে), তারা বেরিয়ে এসে আইনশৃঙ্খলার পক্ষে বিপদ হয়ে দাঁড়াবে। আশঙ্কাটা অমূলক নয়। প্রাক্তন পুলিসকর্মী বা সেনাবাহিনীর সদস্য অপরাধী হয়ে গেছে এমন বহু উদাহরণ আছে। উপরন্তু অগ্নিবীররা অত্যাধুনিক অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর বেরিয়ে এসে চাকরি বাকরি না পেলে হতাশ যুবকে পরিণত হবে। ব্যাপারটা সমাজের পক্ষে তো বিপজ্জনক বটেই, সরকারেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গ্যাংস্টার, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা নিষিদ্ধ নকশালপন্থী সংগঠনগুলো এদের কাজে লাগাতে পারে।
আরো পড়ুন এক রাষ্ট্র এক পুলিশবাহিনী
বিজেপি যা-ই বলুক, যাদের চোখের সামনে বর্তমান অশান্তি চলছে তারা জানে এই যুবকদের পিছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। যা হচ্ছে তার পুরোটাই আশাহত কর্মহীন যুবকদের ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং দিল্লির কৃষক আন্দোলনে বিভিন্ন বামপন্থী দল, সামান্য পরিমাণে কংগ্রেস এবং অন্য নানা ছোট বড় রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু অগ্নিপথ নিয়ে যা ঘটছে তা অসংগঠিত, রাগী যুবকদের কাণ্ড। ফলে এর কোনো দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রভাব পড়বে কিনা বলা মুশকিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনেরও দেরি আছে। কিন্তু চটজলদি এই স্কিম যে নিয়ে আসা হয়েছে দেশে কর্মসংস্থানের অভাব নিয়ে বেড়ে চলা অসন্তোষ সামাল দিতে, তাতে সন্দেহ নেই। লক্ষণীয়, যেদিন অগ্নিপথ স্কিম ঘোষিত হল, তার পরদিনই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন আগামী ১৮ মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ১০ লক্ষ কর্মী নিয়োগ করবে। এই প্রতিশ্রুতি পূরণ হোক বা না হোক, প্রধানমন্ত্রীকে যে চাকরির কথা বলতে হল, এটা প্রমাণ করছে যে জাতীয়তাবাদের ধুয়ো দিয়ে আর চলছে না। সরকার বলেছে অগ্নিপথ স্কিমে যারা কাজ করবে তাদের অগ্নিবীর বলা হবে, তারা দেশের সেবা করার জন্য বিশেষ সম্মান পাবে। কিন্তু সে সম্মান দিয়ে যে চার বছর পরে পেট ভরবে না, তা এই যুবকরা বুঝে ফেলেছে। তাই সারা দেশে আগুন জ্বলছে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।