সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ব্যক্তিপুজোর থেকেও জাতপাত এবং পেটের টান বিষম বস্তু। সদ্য প্রকাশিত কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে একথা আবার স্পষ্ট হল। ২০২৪ সালের নির্বাচনও কি এভাবেই করা যাবে? রুখে দেওয়া যাবে নরেন্দ্র মোদীর রথ? কর্ণাটকে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পরে এই প্রশ্নটাই ঘুরে ফিরে আসছে। কাজটা কঠিন। ২০১৪ সাল থেকে সবাই দেখছেন বিধানসভা আর লোকসভা নির্বাচন এক জিনিস নয়।
কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। কর্ণাটকে কংগ্রেসের জয় বিরোধীদের রাজনীতির জন্য অনেক খোরাক দিয়ে দিল। এই নির্বাচন থেকে বিরোধীরা কতটা শিক্ষা নেবেন এবং কর্ণাটকে ফেল করা বিজেপি কত ভাল পড়াশোনা করে গত দুবারের কায়দায় লোকসভার বৈতরণী আবারও পার করে ফেলবে, তা বুঝতে আরও একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
কিন্তু কর্ণাটকের নির্বাচন রাজনীতির ছাত্রছাত্রীদের কী কী শিক্ষা দিল?
সাম্প্রদায়িকতাই শেষ কথা নয়
গত কয়েক বছর ধরেই কর্ণাটককে বিজেপির ‘সাম্প্রদায়িক গবেষণাগার’ হিসাবে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, এমনকি আসাম, পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে কর্ণাটকেই সাম্প্রদায়িক ইস্যু নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা শুরু হয়েছিল।
স্কুলে ছাত্রীদের হিজাব পরা চলবে না। মন্দিরের সামনে মুসলমান বিক্রেতারা দোকান চালাতে পারবেন না। টিপু সুলতানকে নিয়ে উৎসব করা চলবে না। টিপু সংক্রান্ত ইতিহাসের অংশ স্কুলপাঠ্য বই থেকে বাদ দিতে হবে। হালাল করা মাংস বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হবে। মাইক বাজিয়ে আজান দেওয়া চলবে না। এই ধরনের রকমারি খবর কর্ণাটক থেকে মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশে এবং বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে গত কয়েক বছর ধরে। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, কর্ণাটকের নির্বাচন সাম্প্রদায়িক ইস্যুতেই লড়া হবে।
বিজেপির ইশতেহারে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা, মুসলমানদের সংগঠন পিপলস ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া (পিএফআই) নিষিদ্ধ করার মত বিষয়ও ছিল। অন্য দিকে কংগ্রেস হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করে তাদের ইশতেহারে। সেই নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থরা হল্লা শুরু করে দেন। কংগ্রেসের এই ঘোষণার পরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণ শুরুই করতে থাকেন ‘জয় বজরংবলী’ স্লোগান দিয়ে। এর আগে কংগ্রেস সভাপতি ও কর্ণাটকের নেতা মল্লিকার্জুন খড়গে বিষধর সাপের সঙ্গে মোদীর তুলনা করলে প্রধানমন্ত্রী সেই সাপের সঙ্গে শিবের গলার সাপের সংযোগ টেনে আনেন তাঁর ভাষণে। অর্থাৎ ধর্ম ও কর্ণাটকের নির্বাচন আলাদা হয়নি কখনো।
প্রচারের শেষবেলায় আবার চলে এল দ্য কেরালা স্টোরি-র মতো ছবি। মোদী ও তাঁর সতীর্থরা কর্ণাটককে আসলে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর মতই ধরে নিয়েছিলেন। যেখানে ধর্ম-জাতীয়তাবাদ বিপুল রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড দেয়। কর্ণাটকেও যে সেই ডিভিডেন্ড বিজেপি পায়নি তা নয়। উপকূলবর্তী কর্ণাটকের ২০-২২ টা আসনের মধ্যে ১৪টাই বিজেপি নিজেদের দখলে রেখেছে। উদুপি, ম্যাঙ্গালোর, কোডাগুর মতো উপকূলবর্তী জেলাগুলোতেই কর্ণাটকের ১২-১৩ শতাংশ মুসলমানদের বেশিরভাগ থাকেন। সেখানে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বেশ কাজ করেছে।
কিন্তু সেখানেই শেষ। বিজেপি চেষ্টা করেছিল জাতপাতের ভিত্তিতে বিভক্ত কর্ণাটককে বৃহত্তর হিন্দুত্বের ছাতার তলায় আনার। সে চেষ্টা বিফল হয়েছে। চেষ্টায় অবশ্য কসুর করেনি বিজেপি। পুরনো মাইসোর বা মহীশূরের মতো এলাকায় ভোক্কালিগা জাতির মানুষের মন পেতে তাদের টিপু এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে চেয়েছে গেরুয়া শিবির। উরি গৌড়া ও নানজে গৌড়া – দুই ভোক্কালিগা ‘বীর’ টিপু সুলতানকে বধ করেছিলেন বলেও এক আলেখ্য তৈরি করে গেরুয়া শিবির। এঁরা দুজনেই ভোক্কালিগা সমাজের, কিন্তু এই দুই চরিত্র কাল্পনিক বলে বিতর্ক শুরু হয়।
আসলে অ-মুসলমান ও অ-খ্রীষ্টান ধর্ম এবং সমস্ত জাতের লোকজনকে বৃহত্তর হিন্দুত্বের ছাতার তলায় নিয়ে আসার জন্য সংঘ পরিবার অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে। উত্তরপ্রদেশে এই সামাজিক সমীকরণ কাজে এসেছে অনেকটাই, রাজনৈতিক ফায়দাও মিলেছে। অখিলেশ-মায়াবতীর যাদব-মুসলমান-দলিতদের জয় করে হিন্দুত্বের পতাকা তুলেছেন অমিত শাহ-যোগী আদিত্যনাথ।
কর্ণাটকেও সেই কায়দায় সামাজিক সমীকরণ বদলাতে চেয়েছে বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আর তাদের সহযোগী দলগুলো।
পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বা দেশভাগের ক্ষত কর্ণাটকে নেই। আর্থসামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মঠ সংস্কৃতিকে কাজে লাগিয়ে এখানে হিন্দুত্বের বিকাশ হয়েছে। সামন্ত্রতান্ত্রিক জমিদার শ্রেণি যেমন অর্থনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হিন্দুত্বের খাতায় নাম লিখিয়েছে, তেমনই কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা সামাজিক সিঁড়ির উপরে উঠতে চেয়েছেন। অন্যদিকে উপকূলবর্তী কর্ণাটকের মুসলমানরা বেশিরভাগ হলেন ব্যবসায়ী। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সময়ে এখানে একটা ‘হিন্দু জাগরণ’ দেখা দিয়েছিল। এই ভাবাবেগেই তা দিয়েছে সংঘ পরিবার।
তাদের পরিকল্পনাই হল প্রথমে জাতের সত্তা তৈরি করো। তারপর সেই সত্তাকে হিন্দু সত্তায় পরিবর্তন করো এবং শেষে সেই হিন্দু পরিচয়কে এক সার্বিক হিন্দুত্বে রূপান্তরিত করো। বহু জাতি, গোষ্ঠী ও দেব দেবীতে বিশ্বাসী হিন্দুদের এবং আদিবাসী, দলিতদের এভাবেই একমুখী হিন্দুত্বের প্যাকেজে বন্দি করতে চায় সংঘ পরিবার। তাই পশ্চিমবঙ্গ এবং আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যেও আদিবাসীদের ‘সারনা’ ধর্মের স্বীকৃতির দাবিকে আমল না দিয়ে “সারনা আসলে সনাতন ধর্মই” বলে চালানোর চেষ্টা করে সংঘ পরিবারের লোকজন। আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়গ্রামে হনুমান মন্দির গজিয়ে ওঠে মুড়ি-মুড়কির মত।
এই হিন্দুত্ব-সামাজিক সমীকরণের একটা মূল সমস্যা হল এতেও একটা ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। সেই বিভাজনের মাথায় রয়েছে ব্রাহ্মণরা। ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক এই সামজিক সমীকরণ কর্ণাটকে করা সম্ভব হয়নি। কারণ সেখানে ভোক্কালিগা ও লিঙ্গায়েতরা যথেষ্ট শক্তিশালী। কিছু অংশে তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং পিছিয়ে পড়া জাতির বিশেষ প্রভাব রয়েছে নির্বাচনের ফলাফলে।
ধর্মের থেকেও জাতপাত যেখানে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সেখানে মোদীর মহাদেবের সাপ বা বজরংবলী ধ্বনি বা অন্যান্য সাম্প্রদায়িক আলেখ্য এই নির্বাচনে কাজে আসেনি।

জাতপাতের জাঁতাকলে বিজেপি
বরং লিঙ্গায়েত নেতা ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পাকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে খেলতে নেমে বিপাকেই পড়তে হয়েছে বিজেপিকে। একে তিনি কর্ণাটকে বিজেপির সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। অন্যদিকে তিনি লিঙ্গায়েত সমাজের প্রতিনিধি। সেই ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পাকে বয়স এবং পরবর্তী প্রজন্মকে তুলে আনার দোহাই দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে খাল কেটে যে কুমির এনেছিলেন মোদী-শাহ-জে পি নাড্ডারা, সেই কুমিরই গিলে ফেলল বিজেপিকে। শেষ মুহূর্তে মুসলমানদের সরিয়ে লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগাদের জন্য সংরক্ষণের ঘোষণা করেও শেষরক্ষা হল না।
কর্ণাটকের ভোটারদের প্রায় ১৭% লিঙ্গায়েত গোষ্ঠীর। এঁদের প্রায় ১০০টি আসনে ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা ছিল। ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পার সৌজন্যে লিঙ্গায়েতদের ভোট বিজেপির ঝুলিতেই পড়ছিল, কিন্তু সেখানে এবার ভাগ বসিয়েছে কংগ্রেস।
রাজ্যের ১১% ভোক্কালিগার সমর্থন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়ার জনতা দল সেকুলারের দিকেই থেকেছে বরাবর। কিন্তু ক্ষমতালোভী হিসাবে পরিচিত হয়ে যাওয়া জেডিএসের দিক থেকে এবার তাদের সমর্থন কংগ্রেসের দিকে গেছে। কর্ণাটক কংগ্রেসের সভাপতি ডি কে শিবকুমারও ভোক্কালিগা। সুতরাং দক্ষিণ কর্ণাটকে এই ভোট পরিবর্তনে বিশেষ সমস্যা হয়নি কংগ্রেসের। ভোটাররা ঠিক করেই ফেলেছিলেন, বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকেই তাঁরা ভোট দেবেন। পুরনো মহীশূর অঞ্চলে যেখানে কংগ্রেস প্রায় ৪০টি আসন জিতেছে, সেখানে জেডিএস পেয়েছে ১৪টির মত আসন আর বিজেপি খান ছয়েক।
কিট্টুর কর্ণাটক বা মহারাষ্ট্র সংলগ্ন কর্ণাটকেও ভাল ফল করেছে কংগ্রেস। সেখানকার পিছিয়ে পড়া জাতির ভোটও কংগ্রেসের ঝুলিতে গেছে। কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও জনপ্রিয় নেতা সিদ্দারামাইয়ার কুরুবা গোষ্ঠীও কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। কংগ্রেসের জাতীয় সভাপতি খড়গেও ওবিসি ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে এনেছেন। তবে হায়দরাবাদ কর্ণাটক বা কল্যাণ কর্ণাটকের কয়েকটা জেলাতে ভাল ফল করেছে বিজেপি। কংগ্রেসের থেকেও তারা আসন ছিনিয়ে নিয়েছে এখানে।
ধর্মের চেয়েও জাতপাতের সমীকরণ বেশি কাজ করেছে কর্ণাটকের নির্বাচনে। ভোক্কালিগা-লিঙ্গায়েত-কুরুবা-অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিকে এক করে ‘হিন্দুত্ব ব্রিগেড’ এখনো তৈরি করতে পারেনি সংঘ পরিবার।
জাতপাতের থেকে পেটের রাজনীতি বড়
এই জাতপাতের সমীকরণের থেকেও কর্ণাটকে বড় ইস্যু হয়েছে বিজেপি সরকারের দুর্নীতি ও কংগ্রেসের জনকল্যাণমূলক প্রতিশ্রুতি।
সন্তোষ পাটিল নামে ৪০ বছরের এক কনট্রাক্টর বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রী কে এস এশ্বারাপ্পার বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। অভিযোগ ছিল, সরকারি কাজের জন্য এই মন্ত্রী ৪০% কমিশন চেয়ে সন্তোষকে হেনস্থা করছেন। এশ্বরাপ্পাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই। কিন্তু সেই অভিযোগ পিছু ছাড়েনি। বোম্মাই সরকারকে ‘৪০% সরকার’ বলে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে গেছে কংগ্রেস।
সারা দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিজেপির জাতীয় নেতারা সরব হন। ইডি, সিবিআই সর্বক্ষণ সেইসব দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করে চলেছে, চলছে ধরপাকড়। এমনকি কর্ণাটক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শিবকুমারের বিরুদ্ধেও হিসাব বহির্ভূত সম্পত্তির তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে তিনি জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু সেই বিজেপির বিরুদ্ধেই কর্ণাটকে দুর্নীতি-অস্ত্র কাজ করেছে বলে দাবি কংগ্রেস নেতাদের। ভোটের ফলও তাই বলছে।
অন্যদিকে কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে পাঁচ জনমোহিনী অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল – ১. গৃহলক্ষ্মী (মহিলাদের মাসে ২,০০০ টাকা করে অনুদান। পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আদলে), ২. যুবনিধি (স্নাতক বেকার যুবকদের মাসে ৩,০০০ টাকা ও ডিপ্লোমাধারী বেকারদের মাসে ১,৫০০ টাকা অনুদান), ৩. অন্নভাগ্য (গরীবদের জন্য মাসে ১০ কেজি করে চাল), ৪. গৃহজ্যোতি (২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিলে ছাড়। দিল্লির আম আদমি পার্টি সরকারের আদলে), ৫.সখী (মহিলাদের জন্য বিনামূল্যে বাসে চড়ার ব্যবস্থা। এটাও দিল্লির আদলে)।
নির্বাচনের ফল প্রকাশ হতেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ঘোষণা করে দিয়েছেন, নতুন কংগ্রেস সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই এই প্রতিশ্রুতিগুলো সরকারি স্বীকৃতি পাবে এবং প্রকল্পগুলো চালু হবে। কংগ্রেসের প্রতি বিপুল সমর্থন দেখে মনে করা হচ্ছে এই জনমোহিনী ঘোষণায় প্রভাবিত হয়েছেন কর্ণাটকের ভোটাররা। বিজেপি এই ধরনের জনকল্যাণমূলক প্রতিশ্রুতিকে কটাক্ষ করে এলেও, ভোটারদের এগুলোই যে বেশি আকর্ষণ করে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
কংগ্রেস একইসঙ্গে বেকারত্ব, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলার মত ইস্যুকেও সামনে রেখে এই নির্বাচনে লড়েছে। বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের তত্ত্ব খাটেনি কর্ণাটকে। কেন্দ্রেও বিজেপি এবং রাজ্যেও বিজেপি সরকারে থাকলে কতটা সুবিধা হয় বা হয় না, তা কর্ণাটকবাসী দেখে নিয়েছেন।
স্থানীয় ভোটে জাতীয় নেতা নয়
তবে কর্ণাটকে বিজেপিবিরোধী হাওয়ার আভাস পেয়েই মোদীরা শেষ চেষ্টা করে গেছেন। যতটা কাজে লাগে। কিন্তু কর্ণাটক কখনই গুজরাট নয়। আর এটা লোকসভা নির্বাচন নয়, বিধানসভা নির্বাচন। ২০১৪ সাল থেকে কোনো রাজ্যের নির্বাচন মোদী একার ক্যারিশমায় বিজেপিকে জেতাতে পারেননি উত্তরপ্রদেশ আর গুজরাট ছাড়া। যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে সেখানে স্থানীয় কোনো শক্তিশালী নেতা উপস্থিত থেকেছেন বা কোনো জোটসঙ্গীর হাত ধরতে হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের সাংসদ হিসাবে তিনি ২০১৭ সালে প্রচার করেছেন, তারপর ব্যাটন আদিত্যনাথের হাতে। আসামে হিমন্ত বিশ্বশর্মা। মধ্যপ্রদেশে প্রথমে বিজেপি হেরেছে, তারপর শিবরাজ সিংহ চৌহানের নেতৃত্বে কংগ্রেস ভাঙিয়ে, কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে দলে টেনে বিজেপি সরকার হয়েছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার গড়তে পারেনি, পরে শিবসেনাকে ভেঙে সরকারে এসেছে। ত্রিপুরা কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। বিহারে নীতীশ কুমারের হাত ধরে সরকার গড়েছে, পরে নীতীশ ভোল পালটে ফেলায় সেই সরকারও হাতছাড়া হয়েছে। উত্তর-পূর্বে জোটসঙ্গীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারে থাকতে হচ্ছে। গুজরাটে ঘরের ছেলের তকমা নিয়ে শাহ-মোদীরা ভোট করিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু রাজস্থানে বিজেপি সরকার থাকা সত্ত্বেও বিজেপিকে জেতাতে পারেননি মোদী। ছত্তিশগড়েও তাই হয়েছে গত নির্বাচনে।
যেখানে আঞ্চলিক দলগুলির অবস্থা ভাল, সেখানেও মোদীর ক্যারিশমা কাজ করেনি আগের বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে। যেমন পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল. পাঞ্জাব, দিল্লি।
কর্ণাটকেও ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পাকে সরিয়ে বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রী করে দিল্লি থেকেই রিমোট কন্ট্রোলে সবটা করে দেবেন বলে ভেবেছিলেন শাহ-মোদীরা। বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষও নাকি নিজের ঘাড়ে কর্ণাটকের সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাতেও শেষরক্ষা করে উঠতে পারেননি। আসলে গ্রামীণ ভোটারদের কাছে জাতীয় স্তরের নেতারা ভিনগ্রহের মানুষ। স্থানীয় ভাষা ছেড়ে হিন্দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ভাষণে চিঁড়ে ভেজেনি কর্ণাটকে। বিশেষত যে রাজ্যে প্রবল হিন্দি আগ্রাসনবিরোধী মনোভাব রয়েছে, সেখানে এই স্ট্র্যাটেজি দিয়ে কিস্তিমাত করা আরও কঠিন।
কংগ্রেসের জন্য এই নির্বাচনে রাহুল গান্ধীর ইতিবাচক ইমেজকে তুলে ধরার একটা চেষ্টা ছিল ঠিকই। রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রার প্রভাব এই রাজ্যে কতটা পড়ল, স্বাভাবিকভাবে তার হিসাব করতে চেয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। কিন্তু কোনোভাবেই রাহুল বা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী স্থানীয় সিদ্দারামাইয়া-শিবকুমার জুটিকে ছাপিয়ে যাননি। জাতীয় ইস্যুকে রাজ্যের ইস্যুগুলোর উপরে চাপিয়ে দেননি রাহুলরা।
মোট কথা কর্ণাটকে নির্বাচন ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়নি।
মোদী যেমন করেন প্রত্যেক নির্বাচনে, এবারও তেমনই করেছেন। নিজেকে তুলে ধরেছেন সবার উপরে তিনিই সত্য চরিত্র হিসাবে। সবাই তাঁকে কত গালাগাল করে কিন্তু তিনি নিরীহ গোবেচারা – এই আলেখ্য তিনি বরাবরই তৈরি করেন, এবারও করেছেন। কিন্তু এটা বিধানসভা নির্বাচন। এখানে ব্যক্তি নয়, ইস্যু কাজ করেছে।
এছাড়াও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মোদীর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজের কাছাকাছি কোনো বিজেপিশাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা নেতাকে আসতে দিতে চায় না। তাই আদিত্যনাথ ছাড়া কেউই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। শিবরাজকে বিজেপির পার্লামেন্টারি বোর্ড থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পাকে সেই বোর্ডে রাখা হলেও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে তো মোদী-শাহের মোটেই পটে না।
কংগ্রেসের মত বিজেপিতেও মোদী-শাহেরা একটা ‘হাইকমান্ড’ সংস্কৃতি আনতে চেয়েছেন। কিন্তু রাজ্যস্তরে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নেতাকে রেখে কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়ে সবসময় বাজিমাত করা যে সম্ভব হয় না, তা সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলেই পরিষ্কার।

তাহলে, ২০২৪ সালে কী হবে?
যে অঙ্কে মোদী বিধানসভা নির্বাচন হারেন, ঠিক সেই অঙ্কেই বিরোধীরা মোদীকে হারাতে পারেন।
বিধানসভা নির্বাচনে মোদী ‘বহিরাগত’ হলেও, লোকসভা নির্বাচনে তিনিই সম্রাট। সেইসময় তিনি নিজের নামে ভোট চাইতে ভারত-ভ্রমণ করেন। তাতে বিপুল সমর্থনও তিনি পেয়ে যান। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে মোদী একনায়ক হিসাবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন, তাঁর কোনো বিকল্প বিরোধীদের কাছে ছিল না। রাহুল তাঁর ‘পাপ্পু’ ইমেজ নিয়ে মোদীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেননি।
এই কর্ণাটকে ২০১৩ সালে ১২২ আসনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন সিদ্দারামাইয়া। কংগ্রেস বিধানসভা নির্বাচনে ৩৬ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল। কিন্তু এক বছরের মাথায় লোকসভা নির্বাচনে সেই কংগ্রেসই ৪% ভোট বাড়ালেও আসন পেয়েছিল মাত্র নটা। বিজেপি প্রায় ২০% ভোট বাড়িয়ে ১৭টা আসন পেয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজেপি ৩৬% ভোট পেলেও ২০১৯ লোকসভায় সেই ভোট শতাংশ ৫১ ছাড়িয়ে যায়। বিজেপি যেতে ২৫টা আসন, কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছিল মাত্র একটা।
সেবার নির্বাচনের কয়েক মাস আগে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হারিয়েও মোদী লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই বিধানসভা নির্বাচন ও লোকসভা নির্বাচন এক নয় এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কর্ণাটকের ফল থেকে বিরোধীরা যে শিক্ষা নিতে পারেন, তা হল, ব্যক্তিচালিত নির্বাচন থেকে ইস্যুচালিত নির্বাচনে যাওয়া জরুরি।
এটা ঠিক যে এই নির্বাচনের ফলে কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে বল পাবে। রাহুলও ভারত জোড়ো যাত্রার পরে এবং এই নির্বাচনে জয়ের পরে, তাঁর পাপ্পু ইমেজ থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু সেই রাহুলকে যদি মোদীর বিরুদ্ধে মুখ করে কংগ্রেস লড়তে চায়, তাহলে একইরকমের ভুল হবে।
শিবকুমার-সিদ্দারামাইয়া জুটি বা পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি বা দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা তেলেঙ্গানায় চন্দ্রশেখর রাও বা ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক মোদীর বিজেপিকে নিজেদের রাজ্যে ম্লান করে দিতে পারেন। কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে এককভাবে কোনো আঞ্চলিক নেতা সেই খেলার রিপিট টেলিকাস্ট করতে পারেন না। ইমেজের দৌড়ে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর থেকে বিজেপির মোদী শত আলোকবর্ষ দূরে।
আর যে ইস্যুতে মূলত বিজেপি বাজিমাত করে তা হল জাতীয়তাবাদ, মুসলমান তোষণ-বিরোধিতা, শক্তিশালী নেতৃত্ব, বিকল্পের অভাব ইত্যাদি। সঙ্গে থাকে নিপুণ সংগঠন। কিন্তু সব কিছুই যে মোদী সরকার ঠিক করছে তা তো নয়। সুতরাং বিরোধী দলগুলো যদি একজোট হয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে গরীব-মধ্যবিত্ত মানুষের ইস্যুগুলোতে একমত হয়ে সেই ইস্যুগুলো নিয়ে নিজের নিজের রাজ্যে প্রচার করে এবং লোকসভা নির্বাচনে যায়, তাহলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক থেকে নির্বাচনকে ইস্যুকেন্দ্রিক করতে পারে তারা। সঙ্গে অবশ্যই প্রত্যেক রাজ্যে যে দল শক্তিশালী, তাকে নিপুণ সংগঠন ও প্রচারযন্ত্র কাজে লাগিয়ে মোদীর মোকাবিলা করতে হবে। উদ্দেশ্য হতে হবে বিজেপির আসন কমানো।
অবশ্য মোদীর সামনে কাউকে নেতা হিসাবে খাড়া করলেও বিপদ, না করলেও “বিরোধী মুখ কে?” – এই প্রশ্নের বিপদ। তাই কাজটা কঠিন। বিরোধীরা যদি এক সুরে বিজেপি সরকারের জনবিরোধী ইস্যুগুলো নিয়ে প্রচার করে, তারা সরকারে এলে কী করবে তা জনগণের সামনে স্পষ্ট করে রেখে প্রচারে যায়, তাহলে ২০২৪ সালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা থাকে।
কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, কংগ্রেসের যেখানে সংগঠন রয়েছে, সেখানে নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে থেকে একটু নাড়াচাড়া দিলে তা ঠিক কাজ করবে। বিজেপিকে বেগ দেবে। কর্ণাটক নির্বাচনের আগে রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা সেই কাজটা করেছে। আঞ্চলিক দলগুলো এ কাজ সহজেই করতে পারে। তার আগে এ বছরের শেষেই তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থানে ভোট রয়েছে। সেখানে বিজেপিকে রুখে দিতে পারলে বিরোধীদের মনোবল আরও বাড়বে। সংগঠনে শান দেওয়াও হয়ে যাবে বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে।
এদিকে বিজেপির আই টি সেলের প্রধান (যিনি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাও বটে) অমিত মালব্য কর্ণাটকের ফলাফল নিয়ে বলছিলেন যে তাঁরা হেরে যান বা জিতুন, হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ইস্যু থেকে এবং মুসলমান তোষণের বিরোধিতা থেকে সরে আসবেন না। স্বাভাবিক। ২০২৫ সালে আরএসএসের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আগে মোদীর বিজেপি ভারতকে কংগ্রেসমুক্ত করতে চেয়েছিল। আসলে বামমনস্কতা মুক্ত ভারত করতে চায় তারা। উল্টে দাক্ষিণাত্যে বিজেপির ঢোকার দরজা কর্ণাটক থেকেই বন্ধ হয়ে গেল আবার।
আরো পড়ুন হিন্দুরাষ্ট্র: বিজয়বর্গীয়ের প্রোপাগান্ডা সরিয়ে সাদা চোখে
কিন্তু যেভাবে বজরং দলকে নিষিদ্ধ করা হবে ঘোষণা করে বিপাকে পড়ে কর্ণাটকের কংগ্রেস নেতারা হনুমান মন্দিরে ছুটলেন বা ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরে দিল্লিতে কংগ্রেস সদর দপ্তরে গদা নিয়ে হনুমান বেশে কংগ্রেস সমর্থকরা লাফালাফি করলেন, তাতে বোঝা যায়, সংঘ পরিবার কংগ্রেস বা বামমনস্ক মুক্ত ভারত গড়তে না পারুক, হিন্দুমনস্ক ভারত গড়েই ফেলবে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।