লোকসভা না বিধানসভা, সবসে বড়া গ্রামসভা – দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনিবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠা আদিবাসী মহাসভার জগন্নাথ টুডুর গলায় এই স্লোগান শুনে নাগরিক সীমাবদ্ধতায় কেমন হ্যাঁচকা টান লাগে। গ্রামসভা শব্দটা শুনলে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্মৃতি সেই ছায়া সুনিবিড় গণদেবতার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে চায়। কিন্তু মালভূমির আদিবাসী গণচৈতন্য নিজেদের বোঝাপড়া ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এক অন্য ইতিহাস লিখে চলেছে, যা আমাদের শহুরে জানার অনেকখানি বাইরে থেকে গেছে। এদের দ্বন্দ্ব রাষ্ট্রের সঙ্গে, নগরসভ্যতার সঙ্গে, আবার নিজেদের সঙ্গেও।
গত দেড়-দুবছরে বাংলার এই পশ্চিম প্রান্ত আবার নতুন করে খবরে উঠে এসেছে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করলেন বীরভূমের দেউচা-পাঁচামি – হরিণশিঙা ও দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি প্রকল্প হতে চলেছে। ওই এলাকায় যারা জমির মালিক তাদের থেকে ন্যায্য দামে জমি কিনে নেওয়া হবে এবং যারা জমি দেবে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ উপযুক্ত মূল্য ও চাকরি বাঁধা। পরের মাসেই, অর্থাৎ ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকেই ‘কয়লা বন্ধ’ বলে খনির বিরোধিতা করে ওই এলাকার আদিবাসীরা ধর্নায় বসে যান। এই দলে মূলত মহিলারাই ছিলেন। এরপর এই বিরোধিতা পূর্ণতা পায় যখন এলাকার জমি দিতে অনিচ্ছুক আদিবাসীরা মিলে ‘বীরভূম জমি জীবন জীবিকা প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা’ গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের মূল আহ্বায়ক গণেশ কিস্কু জানান ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ‘কয়লাখনি হতে দেব না’ ধ্বনি তুলে তারা সরকারের বিরোধিতা শুরু করে। কিন্তু এই সংগঠনে ভাঙন ধরতে এক বছরও সময় লাগেনি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুরনো মহাসভা ভেঙে তৈরি হয় নতুন ‘আদিবাসী অধিকার মহাসভা’, যার কাণ্ডারী জগন্নাথ টুডু। এই মুহূর্তে এই নতুন মহাসভা বিভিন্ন মিছিল ও ধর্নার মাধ্যমে সরকারকে নিজেদের কয়লাখনি বিরোধী অবস্থান সম্বন্ধে জানান দিয়ে চলেছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে তারা রাজভবন অব্দি মিছিল করে রাজ্যপালের সেক্রেটারিকে চিঠি দিয়ে এসেছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
জগন্নাথের বক্তব্য মোটামুটি এরকম – এলাকায় খাদান বা ক্রাশার বহুদিন ধরেই আছে। তার জন্যে এই গোটা অঞ্চল ধুলোয় চাপা পড়ে রয়েছে। ভাতের হাঁড়িতে পর্যন্ত ধুলো ঢুকে যায়। সাদা রুমাল পকেট থেকে বের করলে কিছুক্ষণের মধ্যে তা কালো হয়ে যাবে। যেখানে সারা পৃথিবীতে পরিবেশ নিয়ে এত কথা হচ্ছে, সেখানে আমাদের জল-জঙ্গল সাফ করে কয়লাখনি করবে ভাবছে সরকার। তাও আবার আমাদের কারোর সঙ্গে কোনো কথা না বলে। কোনো গ্রামসভা হয়নি, মিটিং-মীমাংসা কিচ্ছু হয়নি। আমাদের জানানো পর্যন্ত হয়নি, সম্মতি নেওয়া তো দূরের কথা। হঠাৎ শুনতে পেলাম কয়লাখনি হবে, তার জন্যে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। পুনর্বাসন হলেই বা কোথায় নিয়ে ফেলবেন আমাদের? এখানে আমাদের শালগাছের গুঁড়ি বসানো জাহেরথান। পূর্বপুরুষের আমল থেকে সেখানে আমাদের বাহা পরব হয়। প্রত্যেক আদিবাসী গ্রামে রয়েছে মাঝহিথান, যেখানে বাদনা পরব থেকে গ্রামসভা – সব করি আমরা। পুনর্বাসন হলে এই থান কোথায় পাব? আমাদের এই বিস্তীর্ণ এলাকা – পাঁচামি ব্লকের দেওয়ানগঞ্জ, হরিণশিঙা, কেন্দ্রপাহাড়ি, পাথরচাল কি হারমাডাঙা গ্রাম জুড়ে যত আদিবাসী আছে সবাই মিলে প্রতিবাদ করছি, এখানে কয়লাখনি হতে দেব না।
আদিবাসীদের এই আন্দোলনে এখন বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক কর্মী এসে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের কারো কারো সঙ্গে কথা বলে মনে হল, প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য সৎ। অর্থাৎ তাঁরা সকলেই তাঁদের মত করে আদিবাসীদের অধিকারের লড়াইয়ে সামিল হতে চান। এঁদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
প্রথমজন শৈলেন ভট্টাচার্য, যিনি বন্ধু মহলে ক্যাপ্টেন বলে পরিচিত। ক্যাপ্টেনদা দীর্ঘদিন ধরে খনি শ্রমিকদের জীবনযুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। শুধু হালের দেউচা-পাঁচামি নয়, উনি রানীগঞ্জ, আসানসোল জুড়ে কয়লাখনি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শৈলেন জানালেন, দেউচা এলাকার কয়লাখনির সঙ্গে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চাপান উতোরের দীর্ঘ ইতিহাস। খাদান-ক্রাশার তো এলাকায় আজকে নতুন নয়, দীর্ঘদিন। ছয়ের দশকে প্রথম পাথর খাদান করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। নয়ের দশকের আগে শুধুমাত্র টাটা স্টিল ও সেইলের জন্য কয়লাখনির অধিকার বরাদ্দ ছিল। ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর আরও দুটো শিল্প ক্যাপটিভ মাইনের অনুমোদন পায় – বিদ্যুৎ আর সিমেন্ট। জ্যোতি বসুর আমলে ভারতে প্রথম বিদ্যুতের জন্য ডব্লিউবিপিডিসিএল (ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড) চুরুলিয়াতে ক্যাপটিভ মাইনের বরাত পায়। তারপর থেকে আরো চারটে কয়লাখনি মালভূমি অঞ্চলে হয়েছে। বীরভূমে বড়জোড়া, গঙ্গারামচক-ভাদুলিয়া, বাঁকুড়ায় বড়জোড়া নর্থ ও ঝাড়খণ্ডে পাঁচওয়ারা নর্থ। আর এইসব খনি তো হয়েছে আদিবাসীদের থেকে জমি নিয়েই। অধিগ্রহণ না হলেও দু তরফের সুবিধাজনক মূল্যে জমির হাত বদল হয়েছে। কয়লার গুঁড়ো লেগে থাকা কপালে ভাঁজ তুলে ক্যাপ্টেনদা বললেন, হঠাৎ দেউচা নিয়ে সবাই সরব হয়ে উঠলেন সেটা খুবই আশার কথা। বীরভূমের এই কয়লা আর ব্যাসল্টের ভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে অতীতে কত যে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। নকশাল আমলে গোটা বীরভূম জেলা, পুলিশ আর সিআরপিএফের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। ৭১-৭২ সাল নাগাদ যখন নকশাল পুনর্বাসন প্রকল্প চলছে, তখন সিউড়ির সুশান্ত ব্যানার্জি বা শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সুদেব বিশ্বাসের মত নকশাল ছাত্রনেতারা পাথর খাদানের বরাত পায়। তখনকার খাদানে তবু আদিবাসী শ্রমিকরা কাজ পেত। এখনকার আধুনিক ক্রাশার নিজেরাই সব করে নিতে পারে, তার অদক্ষ আদিবাসী শ্রমিকের দরকার নেই। কাজেই যতদিন যাচ্ছে কয়লাখনি হলে সেই খনিতেই আদিবাসীদের কাজের ব্যবস্থা হবে, এমন প্রতিশ্রুতির উপর সন্দেহ থেকেই যায়।
পুরনো ‘বীরভূম জমি জীবন… মহাসভা’-র গণেশ কিস্কুও একই সুরে বলেছেন, খনিতে কোনো আদিবাসী কাজ পায় না। আমরা কাজ চাইতে গেলে শুনতে হয় প্রশাসনের তরফে নাকি জানানো হয়েছে আদিবাসীদের খনিতে কাজ করানোর ব্যাপারে এখনো কোনো নোটিস আসেনি।
যাই হোক, এবার আসি দ্বিতীয়জন, প্রসেনজিৎ বসুর কথায়। আদিবাসী মহাসভা, অর্থাৎ গণেশ কিস্কুদের সংগঠন ভেঙে যে নতুন দল হয়েছে, প্রসেনজিৎ তার অন্যতম পুরোধা। কয়লাখনিবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁকে দশদিন জেল খাটতেও হয়েছে। আদিবাসী মহাসভা খুব সম্প্রতি একটা অডিও-ভিজুয়াল তথ্যায়ন করেছে, সেখানেও প্রসেনজিতের বক্তব্য শোনা যাবে।
তিনি আমায় যা বললেন, তাতে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে বেজায় সন্দেহ জাগে। বললেন, কয়লাখনি কয়লাখনি করে এত যে হুজ্জতি, আদৌ কয়লাখনি হবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ। কয়লা অব্দি পৌঁছনোর আগে ১০০ থেকে ২৫০ মিটারের বেশি ব্যাসল্টের স্তর। সেসব ভেদ করে কয়লা পর্যন্ত পৌঁছতে বছর দশেক সময় লাগবে এবং ভারতের কোনো কোম্পানি সেই প্রযুক্তির জোগান দিতে পারবে না। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগ করতেই হবে এবং তাতে বিস্তর খরচ। তাই প্রসেনজিতের সন্দেহ, হতেই পারে আদিবাসীদের হাত থেকে জমি নিয়ে ওই বিরাট ব্যাসল্টের ভাণ্ডার তৃণমূল সরকার আদানির হাতে তুলে দিল। রাস্তা তৈরির কাজ ব্যাসল্টের বিপুল চাহিদা। তার উপর ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণ প্রকল্পে পানাগড় থেকে পালশিট অংশের বরাত পেয়েছে আদানি রোড ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড। কাজেই এই আশঙ্কা অমূলক তা বলা যায় না। তাছাড়া মমতা ব্যানার্জি বলেছেন দেউচায় কয়লাখনি হলে নাকি আগামী ১০০ বছর পশ্চিমবাংলাকে আর তাপবিদ্যুতের চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু ১০০ বছর তো দূরের কথা, আর ২০-২৫ বছর পরেও কি কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকবে? মুখ্যমন্ত্রী ২০২১ সালের নভেম্বরে দেউচা নিয়ে যে ঘোষণা করেছিলেন তার কিছুদিন আগেই স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু সম্মেলন COP26 অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিশ্বের তাপমাত্রা কমাতে দুনিয়া জুড়ে কয়লা, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও ভারত ও চীনের অনুরোধে এই কর্মকাণ্ড একেবারে বন্ধ না করে ধীরে ধীরে লাগাম টানার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। তবু একথা অনস্বীকার্য যে আগামী দশকে নিশ্চয়ই কয়লানির্ভর তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনকে এত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে না, কাজেই ১০০ বছরে বিদ্যুৎ জোগানের ভরসা নেহাতই দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা।
এ তো গেল সোজাসাপটা হিসাবের কথা। সরকার গ্রামবাসীর জমি নিয়ে শিল্প করতে চাইছে, অধিকাংশ গ্রামবাসী তার বিরোধিতা করে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এ নিয়ে গত দুবছরে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। তাই খননের প্রযুক্তিগত জটিলতা, ২১,০০০ গ্রামবাসীর উচ্ছেদ যার মধ্যে প্রায় ১০,০০০ আদিবাসী, তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জটিলতা এবং তা নিয়ে আদিবাসীদের অনিচ্ছা, পরিবেশ রক্ষা ও ২০১৩ সালে পাস হওয়া জমির অধিকার আইন লঙ্ঘন – এসব কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ এই লেখায় আর বেশি আলোচনা করলাম না। আমরা বরং শুরুর প্রতিপাদ্যে উল্লেখ করা আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও তার ইতিহাস একটু তলিয়ে দেখি। কারণ গত পরশু বা গতকাল যা হয়েছে তার সুস্পষ্ট কারণ বিশ্লেষণ আজ করতে না পারলে আগামীকালকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। আমরা যারা দেউচা-পাঁচামি এমনকি বীরভূম-মানভূম পেরিয়ে গোটা ভারতভূমি নিয়ে আগ্রহী তাদের সেই কৈফিয়ত দেবার জন্য প্রস্তুত থাকাও প্রয়োজন।
আরো পড়ুন রাজনৈতিক বিকল্প নেই বলেই দেউচা-পাঁচামি সিঙ্গুর হবে না
এই অঞ্চলের খাদানগুলো মূলত ঝাড়খণ্ডের দিকে। আধুনিক ক্রাশারগুলো পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূমসহ বাকি মালভূমি এলাকায়। আদিবাসীদের গাঁওতা-বন্ধ আন্দোলন শুরু হয়েছে অনেকদিন। দশ-বারো বছর আগে এই আন্দোলনের দুই নাম করা নেতা ছিলেন রবিন সোরেন আর সুনীল সোরেন। ২০১১ নাগাদ সেই আন্দোলনের পিঠে ছুরি মেরে এঁরা দুজন কয়লাখনি হবার পক্ষে দাঁড়িয়ে বর্তমান সরকারের হয়ে গলা মেলাতে শুরু করেন। হরিণশিঙা-দেওয়ানগঞ্জ জুড়ে মানুষের মনে এই বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস রয়ে গেছে। তাই আন্দোলনের ঘনত্ব যেমনই হোক, নেতৃত্ব নিয়ে জনমানসে খিঁচ আছে। শৈলেন ভট্টাচার্য তাঁর মত ব্যাখ্যা করে বললেন যে ভারতের অন্যান্য আদিবাসী এলাকায় জল-জঙ্গল-জমি নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে দেউচার আর্থসামাজিক মানচিত্র ও আন্দোলনের চরিত্র তার চেয়ে আলাদা। নব্বই শতাংশ আদিবাসী হয়ত কয়লাখনি চান না, কিন্তু গত কয়েক দশকে খাদান-ক্রাশারের উপস্থিতি এলাকার দশ শতাংশের মানসিকতা পালটে দিয়েছে। কিছু কিছু খাদান বা ক্রাশারের মালিক আদিবাসী, তাছাড়া এসব থেকে তৈরি হওয়া কাঁচা টাকা যাদের পকেটে ঢুকেছে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক নতুন মধ্যশ্রেণী। এরা শহরমুখী। তারা তাদের জমি বিক্রি করে দিতে চায়। এরা সংখ্যায় ১০% হলেও এদের প্রভাব নিশ্চই বিস্তীর্ণ। ফলে ‘জমি দিব না বটে’ এই উচ্চারণের দৃঢ়তায় মাঝেমধ্যে টান পড়তেই পারে। ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী, কারণ এদের মধ্যে শ্রেণিগত ঐক্যের চেতনা সেভাবে প্রবল নয়। এজন্যে নিশ্চয়ই বামপন্থী রাজনীতির কাণ্ডারিরা দায়ী।
দীর্ঘকাল বাম রাজনীতি করা শৈলেন ভট্টাচার্য এবং প্রসেনজিৎ বসু (যদিও ভিন্ন সংগঠনের) – দুজনেই তাদের মতাদর্শের সমালোচনা করলেন। দুজনেই এককথায় স্বীকার করলেন, ভারতের বামপন্থী রাজনীতি চিরকাল সংকীর্ণ ও যান্ত্রিকভাবে শ্রেণিসংগ্রামের প্রশ্নটাকে দেখে এসেছে। প্রসেনজিৎ জোর দিয়ে বললেন যে শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সংখ্যালঘু, দলিত, লিঙ্গবৈষম্য সব প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে – এমন ভাবনা তাত্ত্বিকভাবেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শৈলেন বললেন ভারতের বাস্তবতায় ও তার বৈচিত্র্যের মধ্যে শ্রেণির প্রশ্নকে বোঝা দরকার ছিল। একদিকে এই ব্যর্থতা আর অন্যদিকে নিপীড়িত পরিচয়ের রাজনীতিতে তৈরি হওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যশ্রেণির সুবিধাবাদ। এই দুয়ে মিলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন সহজেই বিপথগামী হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে আরেক অস্বস্তিকর বাস্তব। এলাকায় আদিবাসী, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান – সকলেই আছেন। তবে জগন্নাথ টুডুর বক্তব্য, মুসলমানরা অনেকেই জমি আর খাদানের মালিক। তাদের অনেক জুলুম আদিবাসীদের সইতে হয়। সেসব রিপোর্ট করতে গেলে প্রশাসন কানে নেয় না, কারণ ওদের হাতে কাঁচা টাকা আছে। তাই ওরা পুলিশ প্রশাসনকে হাতে রাখতে পারে। তাছাড়াও তৃণমূল সরকার আমাদের চেয়ে ওদের কথা বেশি ভাবে। গ্রাম্য আঞ্চলিকতার এই বিক্ষোভকে শহুরে উদাসীনতা ও সীমিত বোধ দিয়ে নিছক মুসলমানবিদ্বেষ হিসাবে পাঠ করলে অত্যন্ত ভুল হবে। রাজ্য প্রশাসনের আদিবাসী সত্তাকে তার বঞ্চনার জায়গা থেকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। দেশে মুসলমান যেমন বিপন্ন, তেমনি আদিবাসীদেরও রয়েছে দীর্ঘ লাঞ্ছনার ইতিহাস। তাদের এই কোণঠাসা অবস্থান থেকে ভারতের মুসলমানের বিপদের কথা অনুভব করার কথাও নয়। বরং তাদের কাছ থেকে অমন আশা করা আমাদের উন্নাসিক মূঢ়তা। ঈর্ষার কারণ খুঁজে তার সুরাহা না করলে হিংসা দূর করা যাবে না। দেশের দুটি বঞ্চিত সত্তার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও দ্বন্দ্বের কারণে যে ফাটল তৈরি হচ্ছে, সেখান দিয়েই দুর্বৃত্তের মত বহিরাগতরা প্রবেশ করছে। এই ফাটলের সদ্ব্যবহার করে ভারতের প্রতিটি জাতিসত্তা ও পরিচয়ের রাজনীতির পরিসরে ঢুকে ফায়দা লুটে চলেছে বিজেপি এবং আরএসএস। মণিপুর, আসাম সহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে তাকালেই একথা বোঝা যায়।
শেষ করার আগে সবিনয়ে জানাই, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ না থাকলেও প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বা দিলীপ চক্রবর্তীর গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে এই অঞ্চলই বাংলার প্রাচীন ভূমি। গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গ্রামবাংলার গড়ন ও ইতিহাস বইতে দেখিয়েছেন যে “প্রান্ত রাঢ়ের এই পুরাভূমিতেই প্রাথমিক স্তরের কৃষিচর্চা শুরু হয়েছিল – গ্রামবাংলার পত্তনও সেখানেই হয়েছে।” প্রায় চার হাজার বছর ধরে যাঁরা এই প্রত্নসাক্ষ্য বহন করে চলেছেন, আশা করব তাঁরা এই উন্নয়ন এবং নিজেদের ভিতরের জটিলতা কাটিয়ে টিকে যাবেন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।