বাংলায় একটা জনপ্রিয় প্রবাদ আছে “রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।” আমাদের রাজ্যের ভোট সংস্কৃতি, বিশেষ করে সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোট, এর উজ্জ্বলতম নিদর্শন। একদিনের ভোটের আগে পরে মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। কিন্তু ভোট উৎসবের রেশ এখনো মিলিয়ে যায়নি। গত কয়েকমাস সংবাদমাধ্যম জুড়ে ছিল পঞ্চায়েত ভোটের আলোচনা। এই মুহূর্তে এবং আগামী কয়েকমাস ধরে চলবে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন তথা মোদি বনাম ইন্ডিয়া যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার। কে ভাল কে মন্দের ব্যাখ্যা, চুলচেরা বিশ্লেষণ, উত্তপ্ত আলোচনায় ব্যস্ত থাকবে সবাই। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সমেত দেশজুড়ে আরও নানা গুরুতর সমস্যা রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশছোঁয়া দাম, বেলাগাম দুর্নীতি, অপরিসীম বেকারত্ব, জাতিদাঙ্গা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য – সবকিছু নিয়ে দেড়শো কোটি ভারতীয় বিধ্বস্ত, দিশেহারা। শাসক শিবির আর বিরোধী দলগুলো একে অন্যের প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলে নিজেকে ভালো প্রমাণের চেষ্টা করছে, কিন্তু সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রকৃত প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। আসলে ভোটে জেতা হয়ে দাঁড়িয়েছে কোটি টাকার লটারি জেতার সমান। ফলে লাভ যা হওয়ার জয়ী প্রার্থীর হয়, জনগণ যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যায়।
বছর বছর ভোট আসে কিন্তু বেকারত্ব কমে না, কর্মসংস্কৃতির উন্নতি হয় না। শহিদ মিনার চত্বর জুড়ে শুধু ধর্নামঞ্চের সংখ্যা বেড়ে যায় (বর্তমানে দশটি মঞ্চ)। নতুন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপনের দাবি জানিয়ে WB NEW SSC-SLST, Gr- C/D EKATA মঞ্চ ১০ ডিগ্রির শীতল দিন থেকে ৪২ ডিগ্রির উষ্ণ দিন পেরিয়ে এখন রোজ বৃষ্টিতে ভিজছে। কিন্তু ভোটের দামামা পেরিয়ে তাদের স্লোগান কোনো নেতা-নেত্রী, সংবাদমাধ্যমের কানে পৌঁছয় না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রচার পর্বে বলেছিলেন, “ডবল ডবল চাকরি হবে”। তাঁর দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে, মমতা ফের মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। ডবল কেন, সিঙ্গল চাকরিও উনি দিতে পারেননি। এখন তিনি ব্যস্ত লোকসভা ভোট এবং ইন্ডিয়া জোট নিয়ে। একমাস আগের পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও প্রচুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং ভুলেও গেছেন। এটাই যেন অলিখিত নিয়ম।
২০১৫ সালের আপার প্রাইমারির নিয়োগ আজও হয়নি। অথচ দুবার করে ইন্টারভিউ হয়েছে, দুবার করে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে পিএসসির মাধ্যমে সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছিল। তারপর আর হয়নি। ২০১৬ সালের এসএসসি-এসএলএসটি, যার দ্বারা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তার ৮০% নিয়োগ ভুয়ো প্রমাণিত। সদ্য জানা গেছে, ২০১৬ সালের একাদশ-দ্বাদশ পর্যায়ে ভূগোলে ২১৯ জন নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে ১৮১ জন সাদা খাতা জমা দিয়েছিলেন। প্রত্যেক বিষয়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ। এর প্রতিকার কবে হবে কেউ জানে না। বত্রিশ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরির ভবিষ্যৎ সুতোয় ঝুলছে আজও। নিম্ন আদালত রায় দেয়, সরকার তার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যায়, প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট অবধি চলে যায়। একের পর এক নিয়োগের ঘটনায় এমনটাই ঘটে চলেছে। অজস্র মামলা, দুর্নীতির দায়ে অসংখ্য নিয়োগ বাতিল, শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা হাজতবাস করছেন। কিন্তু সমস্যার সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
২০১৬ সালের পর যারা স্নাতক, স্নাতকোত্তর, বি এড ডিগ্রি অর্জন করেছে তারা কেউ আজ পর্যন্ত একটা এসএসসি পরীক্ষাতেও বসতে পারেনি। মাদ্রাসার ফর্ম পূরণ হয়ে থাকলেও কবে পরীক্ষা হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারপর আদৌ সঠিক ফল বেরোবে তো? যদিও নতুন নিয়োগে কোনো স্থগিতাদেশ বা বাধা নেই।
২০২২ সালের ৩ মার্চ যখন কলেজ স্ট্রিটে নতুন নিয়োগের দাবিতে মিছিলসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছিলম তখন পুলিশি তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। চাকরিপ্রার্থীদের পাঁচ মিনিটও দাঁড়াতে না দিয়ে গ্রেফতার করে লালবাজারে আটকে রাখা হয়েছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপরেও যতবার আন্দোলন বা প্রতিবাদ করতে চেয়েছে চাকরিপ্রার্থীরা, তাদের সঙ্গে বর্বরের মত আচরণ করেছে পুলিস। গতবছরেই ৫ মে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন বেরোতে পারে – এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তারপর একবছর কেটে গেছে। এর মধ্যে বহু ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে এসএসসি চেয়ারম্যানের কাছে। কিন্তু তিনি প্রতিবারই আমাদের নিরাশ করেছেন, একবারও সদুত্তর দিতে পারেননি। ফলে চাকরিপ্রার্থীদের জীবনের অন্ধকার আজও কাটেনি।
তবে নিয়োগ দুর্নীতি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ – একথা ভাবলে ভুল হবে। এর শিকড় বহুদূর ছড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা সকলেই বুঝে গেছে পড়াশোনা করে, ভালো রেজাল্ট হাতে নিয়ে পুলিসের মার খাওয়া এবং রাস্তায় বসে থাকা ছাড়া আর কিছু হবে না। আসলে শাসক দল বুঝে গেছে “এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।” তাই অন্ধ আনুগত্য সৃষ্টির প্রথম ধাপ হিসাবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া দরকার।
এসব করে আসলে যা করা হচ্ছে তা শুধু শিক্ষার বেসরকারিকরণ নয়, শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অর্থনির্ভর করে তোলা। যার পয়সা আছে কেবল সেই-ই পড়াশোনা করতে পারবে। মেধার কোনো মূল্য নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নামমাত্র মাইনেতে অনিশ্চিত চাকরি করতে বাধ্য হবে শিক্ষিত যুবসমাজ। সেখানে কতটা স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হয় তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
আরো পড়ুন পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতি: অভূতপূর্ব নয়, সমর্থনযোগ্যও নয়
দেশ জুড়ে চলা গদির লড়াইয়ে শিক্ষার কথা কোথাও নেই, নেই বেকারত্বের কথা। শুধু আছে জনসেবার আড়ালে নিজের আখের গোছানোর খেলা।
মহামান্য আদালত শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহু কঠোর পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছেন। বহু ভুয়ো প্রার্থীর চাকরি বাতিল করা হয়েছে, ওএমআর শিট প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রক্রিয়ার শম্বুক গতি চাকরিপ্রার্থীদের জীবনে কোনো আশার আলো ফোটাতে পারেনি। তারা দুবছর আগে যেখানে ছিল, আজও সেখানেই আছে। এই দুবছরে প্রত্যেকের বয়স বেড়েছে, কিন্তু নিয়োগ সংক্রান্ত বয়ঃসীমার পরিবর্তন হয়নি।
শিক্ষিত যোগ্য প্রার্থীরা এখন মাঝ সমুদ্রে ডুবন্ত, সামান্য খড়কুটোও নেই যা ধরে বাঁচার আশা করা যায়।
প্রশ্ন কখনো একা আসে না। এখন প্রশ্ন হল, আজকের শিক্ষিত প্রজন্ম কী করবে, কোথায় যাবে? গত শতকের নয়ের দশকে জন্মানো একটা গোটা প্রজন্মের দোষ কোথায়? এই অসহনীয় বেকারত্ব সহ্য করতে না পেরে যারা আত্মঘাতী হতে পারে বা অন্ধকারে জগতের দিকে চলে যেতে পারে, তাদের কীভাবে সামলানো হবে?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।