অন দি ওরিজিন অফ স্পিশিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। তারপর থেকে এই ২০২৩ পর্যন্ত চার্লস ডারউইন এবং তাঁর আবিষ্কার ঠিক কী কারণে শাসকের অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে বারবার? ডারউইনের যুগান্তকারী বিবর্তনবাদ তত্ত্বের জন্য তো বটেই। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় তিনি এই তত্ত্বটি আবিষ্কার করেছিলেন তাও বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক বললে ভুল হয় না।

কিছুদিন ডাক্তারি এবং কিছুদিন ধর্মতত্ত্ব পড়ার চেষ্টায় ইতি টেনে বীগল জাহাজে সওয়ার হয়ে বাইশ বছরের ডারউইন পাঁচ বছর (১৮৩১-১৮৩৬) ধরে ভ্রমণ করলেন দক্ষিণ আমেরিকার বিরাট ভূখণ্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশ ও দ্বীপে। বিপুল পরিমাণ জীববৈচিত্র্যের গভীর পর্যবেক্ষণ ও নমুনা সংগ্রহ, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার বিশদ বিবরণ লিখে রাখা এবং ইংল্যান্ডে ফিরে সেই সংক্রান্ত আরও সুদীর্ঘ গবেষণা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল ওরিজিন অব স্পিশিস। এক তরুণ প্রকৃতিবিজ্ঞানীর এই প্রায় আড়াই দশকের যাত্রাপথ আসলে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে, হাতে কলমে শেখা জ্ঞানকে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবকে আজন্মলালিত বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে, অতীন্দ্রিয় কোনোকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার সংগ্রাম, যা বিজ্ঞানবোধের গোড়ার কথা।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

যে সময়ে বাইবেলের বিরোধিতা আর দেশদ্রোহিতা সমার্থক, সেইসময় দাঁড়িয়ে ডারউইন যত দেখেছেন যত লিখেছেন ততই তাঁর কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি ও বিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়ম। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, কোনোরকম ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই বহু যুগ ধরে জীবজগতে পরিবর্তন ঘটছে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। কাজেই সুদীর্ঘ গবেষণা আর অধ্যবসায়ের ফসল ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত মহাগ্রন্থ শুধু যে বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বর কর্তৃক ছদিনে পৃথিবী সৃষ্টির তত্ত্বকে নস্যাৎ করল তাই নয়, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ধারণার উলটো দিকে হেঁটে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কষ্টিপাথরে সবকিছু যাচাই করে নেওয়ার, বিশ্বাসের বদলে যুক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার এক ইতিহাস তৈরি করল, যা বহুকাল পথ দেখাবে সত্যসন্ধানী মনকে। সুতরাং ডারউইন পড়া আর অন্ধত্বের চাষ একসঙ্গে চলে না। একথা সম্যক বুঝেই কোনো আলাপ আলোচনা মত বিনিময়ের তোয়াক্কা না করে দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বই থেকে বিবর্তনবাদসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্প্রতি ছেঁটে ফেলেছে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং, অর্থাৎ এনসিইআরটি (পড়ুন বিজেপি সরকার)।

মুশকিল হচ্ছে, সিলেবাসের উপর যত সহজে কাঁচি চালানো যায়, মানুষের মনকে সেভাবে কাটছাঁট করা যায় না। শিক্ষক, বিশেষত ক্ষমতার দাসত্ব না করতে চাওয়া শিক্ষক, চাইলে বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলোর রেখার মত ক্লাসরুমে নিয়ে আসতে পারেন সিলেবাস বহির্ভূত নানা বিষয়, গল্পের ছুতোয় ছুঁয়ে যেতে পারেন সমাজ-সভ্যতা-রাজনীতির এমন অনেক প্রসঙ্গ, যা শাসকের অস্বস্তির কারণ হতে পারে। হাওয়ার্ড ফাস্টের সাইলাস টিমবারম্যান উপন্যাসে যেমন ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক সাইলাস, মার্ক টোয়েনের দ্য ম্যান হু করাপ্টেড হ্যাডলিবার্গ পড়িয়ে সরকারের চক্ষুশূল হয়েছিলেন, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব নিয়েও তেমনই সংঘাত বেধেছে বারবার। ১৯২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসিতে ডারউইনবাদ পড়ানোর ‘অপরাধে’ জন স্কোপস নামে এক স্কুলশিক্ষকের নামে মামলা হয় এবং তাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের উকিলের বাদানুবাদ ‘স্কোপস ট্রায়াল’ বা ‘মাঙ্কি ট্রায়াল’ নামে বিখ্যাত। এই মামলা নিয়েই ১৯৫৫ সালে লেখা হয় সাড়া জাগানো নাটক ইনহেরিট দ্য উইন্ড, ১৯৬০ সালে যার হলিউডি চলচ্চিত্রায়নে সরকারপক্ষের উকিলকে অভিযুক্তের উকিল প্রশ্ন করেন “আপনি এটা কী করে অস্বীকার করবেন যে, মানব মস্তিষ্কের ভাবার ক্ষমতা, যুক্তি করার ক্ষমতাই তাকে অন্য সব জীবের চেয়ে উচ্চাসনে বসিয়েছে? এছাড়া আর কী বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষের আছে? হাতি অনেক বড়, ঘোড়া অনেক বেশি দ্রুতগামী, প্রজাপতি অনেক সুন্দর, এমনকী মশাও অনেক বেশি পরিমাণে উৎপাদন করে। একটা স্পঞ্জও টিকে থাকে অনেক বেশি। কিন্তু একটা স্পঞ্জ কি ভাবতে পারে?”

এই ভাবার ক্ষমতা, যুক্তিবোধ ধ্বংস করার প্রয়োজন যখনই পড়ে, তখনই বিজ্ঞানের উপর আক্রমণ হয়। দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে যতই বিরোধিতা থাকুক, বিজ্ঞানকে আক্রমণের প্রশ্নে, অন্ধ বিশ্বাসে মদত দেওয়ার প্রশ্নে দেখা যায় তাদের আশ্চর্য মিল। পাকিস্তান, লেবানন, তিউনিশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্ডন সমেত বেশ কিছু ইসলামিক রাষ্ট্রে ডারউইন পড়ানো নিষিদ্ধ অথবা রাষ্ট্রের দ্বারা সমালোচিত। পাশ্চাত্যের গির্জাতন্ত্রের সঙ্গে সাথে ডারউইনের বিরোধ তো সেই গোড়া থেকেই।

ডারউইন
১৮৭১ সালে ‘দ্য হর্নেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত ডারউইনের ব্যঙ্গচিত্র। সূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স

ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্বঘোষিত ধারক ও বাহক আরএসএস-বিজেপি’ও চলছে একই লাইনে। ২০১৮ সালে মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সত্যপাল সিং বলেছিলেন, ডারউইনের তত্ত্ব ভুল, কারণ কেউ বানরকে মানুষ হতে দেখেনি। তখনই তিনি স্কুল, কলেজে ডারউইন পড়ানোর ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং নিজেকে বানরের নয়, ঋষিদের বংশধর বলে দাবি করেন।

এরপর ২০১৯ সালের বিজ্ঞান কংগ্রেসে নাগেশ্বর রাও পুষ্পক রথকে বৈদিক বিমান বলে বসলেন, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রকে গাইডেড মিসাইলের সঙ্গে তুলনা করলেন। একইসঙ্গে দশাবতার তত্ত্ব উল্লেখ করে দাবি করলেন, সেটা ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের চেয়ে উন্নত। এর পাশাপাশি চলছে মৌলিক গবেষণায় বরাদ্দ কমিয়ে ফেলা, বৈদিক ক্যালেন্ডার, বৈদিক গণিত, ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম ইত্যাদি নামে অবৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যবাদ প্রচার করা। এ জিনিসগুলো কারোর নির্বুদ্ধিতা বা খামখেয়ালিপনার কারণে ঘটছে ভাবলে ভুল হবে। যুক্তিবাদী মানসিকতাকে সমাজ থেকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে। স্কুলপাঠ্য বই থেকে ডারউইন বাদ দিয়ে এই অন্ধত্বের চাষে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হল। যারা এ জিনিস করছে, তারা ভবিষ্যতে নিউটন, আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে না বা নাজি জার্মানির অনুসরণে সিলেবাসে ‘জাতিবিজ্ঞান’ ঢুকিয়ে হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব শেখাতে চাইবেন না, এমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া অসম্ভব।

আরো পড়ুন সবই ব্যাদে আছে ক্যালেন্ডার: একটি গর্বের মৃত্যু

আশার কথা, ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরা এই ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। পাঠক্রম থেকে ডারউইন বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ব্রেক থ্রু সাইন্স সোসাইটি শুরু করেছে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ আন্দোলন। দেশের ১,৮০০ বিজ্ঞানী সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে বলেছেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ শুধুমাত্র জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই অপরিহার্য নয়, সিলেবাস থেকে এর অপসারণ সমাজের বিজ্ঞানমনস্কতাকে এবং চিন্তার যুক্তিনিষ্ঠতাকে ধ্বংস করবে।

ডারউইন তাঁর জীবদ্দশায় থমাস হাক্সলির মত সমর্থক পেয়েছিলেন। লন্ডনের এক বিতর্কসভায় বিশপ উইলবারফোর্স বিদ্রুপ করে হাক্সলিকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কোন দিক থেকে নিজেকে বানরের উত্তরাধিকারী মনে করছেন, বাবার দিক থেকে নাকি মায়ের দিক থেকে? শোনা যায়, হাক্সলির সপাট উত্তর ছিল, নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে সত্য আড়াল করার কাজে ব্যবহার করেন এমন কোনো ব্যক্তির চেয়ে একটা বানর তাঁর কাছে পূর্বপুরুষ হিসাবে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।

আজ সত্য আড়াল করার চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, এবং উগ্র দক্ষিণপন্থার হাত ধরে দেশে দেশে চলছে অবিজ্ঞান আর অন্ধত্বের চাষ। সত্যের হয়ে লড়ার জন্য একজন হাক্সলি যথেষ্ট নন, জোট বাঁধা প্রয়োজন।

~ মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.