অনুপ রায়

২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি। সময় সকাল ৮ টা ৩০ মিনিট। ডানকুনিতে আমার ভাড়াবাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে দুটো খালি থলে আর পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে যাওয়ার সময়ে একজন সমবয়সী লোক আমাকে বলল, “আসুন”। আমি দেখলাম, ঘেরাও হয়ে গেছি। পরদিন ব্যাঙ্কশাল সিএমএম কোর্টে আমাকে তোলা হল। জানা গেল, আমাকে নাকি ধরা হয়েছে শিয়ালদা ফ্লাইওভারের নিচে সন্ধে ছটায় নিষিদ্ধ তিনটে দলিলসহ একটা রিভলভার আর দুটো গুলি নিয়ে। তারপরে বিভিন্ন জেলে চোদ্দবার বদলি করে মাত্র ছজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে লেগে গেল ন বছর সাত মাস। অবশেষে জামিনে মুক্তি। এই হল সংক্ষেপে আমার সংশোধনাগারের কাহিনি।

বহুবছর আগে সুপ্রিম কোর্টের কিছু রায় পড়েছিলাম। চুলচেরা বিশ্লেষণ আর শব্দের খেলা পড়ে কিছুটা মোহিতই হয়েছিলাম। পড়েছিলাম, “Bail is the rule and jail is an exception”। আরও পড়েছিলাম “Prosecution should not be allowed to make a persecution”। পড়েছিলাম “Court should dispense justice, not dispense with justice”। আর পড়েছিলাম “Justice delayed is justice denied”। গত প্রায় দশ বছরের অভিজ্ঞতায় পুলিস-হাজত-তদন্ত-আদালত-জেলখানার গোটা কক্ষপথে আমি এগুলোর কোনো চিহ্ন দেখতে পাইনি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ধান ভানতে শিবের গীত ছেড়ে এবার আসা যাক আসল কথায় – জেলজীবনের কথাকাহিনি। আগেকার ‘কারাগার’ এখন হয়েছে ‘সংশোধনাগার’। আমরা একটা গান বেঁধেছিলাম “হেথা কম্পিউটারে বোতাম টিপে তবেই দরজা পার/হেথা গাঁজা পাবে, পাতা পাবে, টেন নাইট্রোজেন কারবার/সরকার বলে সংশোধনাগার।” জেল হল অত্যাচারের আখড়া। বিপ্লবী আর জেলের সম্পর্ক নিয়ে পথের দাবী উপন্যাসের কথাগুলো আজও সত্য। জেল তৈরি হয় বিপ্লবী রাজনৈতিক বন্দিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে আর সাধারণ বন্দিদের ঘুঘু বানাতে। কারাগারকে সংশোধনাগার নামে ডাকলেই তার শাঁস বদলে যায় না। জেল বা সংশোধনাগার – যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তার আসল পরিচয় লৌহকপাট। অত্যাচার কক্ষ।

প্রিজনস অ্যাক্টে বলা হয় কারাগার। পশ্চিমবঙ্গে প্রিজনস অ্যাক্ট আর চালু নেই। চালু হয়েছে কারেকশনাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট। কিন্তু এ আইনের কোনো বিশদ নিয়মাবলী আজও তৈরি হয়নি, দীর্ঘ ২৫ বছর পরেও। তাই পুরনো প্রিজনস অ্যাক্টের নিয়মগুলোই আজও বহাল। নাম তার জেল কোড। তাই সংশোধনাগার আইন প্রয়োগ করতে হয় জেল কোড অনুযায়ী। নতুন বোতলে পুরনো মদ।

প্রিজনস অ্যাক্টে চাবুক মারার ব্যবস্থা ছিল, সংশোধনাগার আইনে নেই। কিন্তু গুরুতর কোনো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়াই আজও ধোলাই হয়, পেটাই হয়। সবার সামনে পেটাই হয় হয়, বারবার পেটাই হয়, দিনের পর দিন পেটাই হয়। লৌহকপাটের ঐতিহ্য বজায় রাখতেই পেটাই হয়। একই অপরাধ করে কেউ খায় মুনাফা, কেউ খায় লাঠি। দৈহিক শাস্তি না দেওয়ার নিয়ম পড়ে থাকে শুকনো আইনের কেতাবে। বাস্তবের মাটিতে চলে লাঠি আর লাল চোখের রাজ।

খাবারের ব্যবস্থা কাগজে-কলমে খুব ভালো। প্রতি বেলা ২৫০ গ্রাম চাল, ৫০ গ্রাম ডাল, ২০০ গ্রাম আলু-সবজি। সপ্তাহে একদিন সয়াবিন, একদিন ডিম, একদিন ৭৫ গ্রাম মাছ, একদিন ৭৫ গ্রাম মাংস। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া যায় শুধু পাতলা ডালের জল, মাছ বা মাংসের ছোট একটা টুকরো। সয়াবিনের দিন সবজি-আলু উধাও হয়ে যায়। মাছ বা মাংস কোনো কোনো দিন বিনা নোটিসেই বন্ধ হয়ে যায়। মেডিকাল ডায়েটে প্রতিদিন ১৫০ গ্রাম মাছ বা ১০০ গ্রাম মাংস দেওয়ার কথা, দেওয়া হয় একটা বা দুটো টুকরো। অন্যদিকে মেট (mate)-দের ‘হোটেলে’ (বেআইনি) মোটা টাকার বিনিময়ে খাওয়ানো হয়। ডায়েটের মাছ-মাংস-ডাল ভাগ বাঁটোয়ারা হয় কর্তৃপক্ষ আর ঠিকাদারের মধ্যে, অথবা বিক্রি হয় মেটদের হোটেলে। মোটা টাকাওয়ালা বন্দিদের ‘স্পেশাল’ রান্নার জন্যেও চলে যায়।

চিকিৎসার অবস্থা তথৈবচ। একমাত্র প্রেসিডেন্সি জেল ছাড়া অন্য সব কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারেই একজন বা দুজনের বেশি ডাক্তার নেই। দমদম সংশোধনাগারে কখনো ৫০০০ বন্দি থাকলেও ডাক্তার মাত্র একজন, মেদিনীপুর সংশোধনাগারে মাত্র দুজন। বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে একজন মাত্র ডাক্তার মাত্র আধঘন্টার জন্য রোগী দেখেন, অথচ সেখানে বন্দি থাকে ১২০০ থেকে ১৪০০। এরপর আছে জীবনদায়ী আর নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের একান্ত অভাব। জেলা হাসপাতালে বন্দিদের পাঠানোর ব্যাপারেও আছে নানা বিধিনিষেধ। পুলিস এসকর্টও প্রায়ই অমিল হয়। ফল অসুস্থ বন্দিদের মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বগামী। প্রতি বছর প্রত্যেক কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বেশকিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

চিকিৎসার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য নিয়েও আছে চরম অবহেলা। পরিচ্ছন্নতা, মশা, মাছি, ড্রেন, পায়খানা – সবেরই সাংঘাতিক অবস্থা। দমদম সংশোধনাগারে আমি প্রতিদিন নালিতে নিয়মিত মলের স্রোত বয়ে যেতে দেখেছি। কোনো কোনো ঘরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে। দুর্গন্ধময় নালা, অসহ্য মশা, অপরিচ্ছন্ন ওয়ার্ড-সেল-পায়খানা, এমনকি জেল ওয়ার্ডারদেরও যত্রতত্র পেচ্ছাপ করার জন্য দাঁড়িয়ে পড়া রোজকার ব্যাপার।

দমদমে ২নং বাড়ি বা বর্ধমানের ২নং আর ৩নং ওয়ার্ড বা প্রেসিডেন্সি জেলের যে কোন ওয়ার্ড – সর্বত্রই একজন বন্দির বিছানা আরেকজন বন্দির বিছানার ঘেঁষাঘেঁষি অথবা আরেকজনের বিছানার উপরে উঠে যায়। এমনকি পায়খানার ধারেও মানুষকে শুতে হয়, জায়গা নিয়ে শুরু হয় পয়সার লেনদেন। মাঝে মাঝে কেউ বা কারা জেল থেকে পালালে শুরু হয় তল্লাশির বাড়াবাড়ি বা মাঝরাতে “জাগতে রহো” আওয়াজ। তারপর যে কে সেই, এমনকি ছোট ছোট খুপরি সেলের মধ্যেও পুরে দেওয়া হয় তিন থেকে পাঁচজন লোককে।

জলবসন্তের মত ছোঁয়াচে অসুখের রোগীকেও অনেক জেলে রাখা হয় সুস্থ বন্দিদের সঙ্গে একই ব্লকে। একই স্নানের জায়গা, পানীয় জল, জামাকাপড় ধোয়া কাচা, বাসন মাজা সবই হয় একসাথে। এটা সবচেয়ে চোখে পড়ে বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। যেখানে কোন টিবি ওয়ার্ড নেই অথচ গোটা সার্কলের সমস্ত রোগীই আসে বর্ধমানে। বর্ধমানে আমি এইচআইভি আক্রান্ত রোগীকেও টিবি রোগীর সঙ্গে পাশাপাশি সেলে থাকতে দেখেছি। নিজেও থেকেছি একই সেল ব্লকে।

অনেক বড় বড় কথা লেখা আছে আইনে, বাস্তবটা একেবারে উল্টো। জেলের পক্ষ থেকে বাইরের দুনিয়ায় নাটক-গান-নাচ মঞ্চস্থ করা হয়। বন্দিরাই করে সবকিছু, অঢেল মুনাফা হয়। কিন্তু বন্দি কুশীলবরা শুধু প্যারোলে বাড়ি ঘুরে আসা ছাড়া কিছুই পায় না। এটা বিনোদনের নামে শোষণ। এমনকি খবরের কাগজ পড়ার বিনোদনটুকুর ব্যবস্থাও করা হয় না। যে নিজের পয়সায় কিনে পড়ে, তার কথা আলাদা।

সংশোধনাগার আইনে আছে, জেলের ভিতরে যদি কোনো অপরাধ হয়, তাহলে সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছাড়া আর কেউ শাস্তি দিতে পারবে না। শুনানির সুযোগ না দিয়ে কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না, কোনোরকম দৈহিক শাস্তিও দেওয়া যাবে না। বাস্তবে শুনানির কোনো বালাই থাকে না। যে কোনো অফিসার বা কর্মীই শাস্তি দেয়। আর পেটাই বা দিনের পর দিন সেলে লকআপ করে রাখাটাই শাস্তি হিসাবে সবচেয়ে চালু নিদান। আর একটা চালু শাস্তি হল দূরের জেলে বদলি করে দেওয়া।

বন্দিদের আত্মীয় আর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থার কথা আইনে আছে। আছে উকিলের সঙ্গে মোলাকাতের ব্যবস্থাও। বাস্তবে মোলাকাতের নামে চলে চরম হয়রানি আর যথেচ্ছাচার। অন্তত দু ঘন্টা আত্মীয় বন্ধুদের তীর্থের কাকের মত বসে থাকতে হয় কখন শিকে ছেঁড়ে সেই অপেক্ষায়। মোলাকাতের সময়ে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন লোক একইসঙ্গে নিজের নিজের বন্দির সঙ্গে মোলাকাত করে। চিৎকার না করলে কোনো কথাই শোনা যায় না। আত্মীয়, বন্ধুরা বন্ধুদের মুখটুকুও পরিষ্কার দেখতে পান না। যা কিছু তাঁরা বন্দিদের জন্য দিয়ে যান, তার কোনটা বন্দিকে দেওয়া হবে আর কোনটা দেওয়া হবে না, সে ব্যাপারে চলে যথেচ্ছাচার। মোটা টাকা যারা খরচ করতে পারে, তাদের পোয়া বারো। না হলেই মুশকিল। রাজনীতি করে যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের বন্ধুদেরও দেখা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবেই।

জেল থেকে অন্য জেলে বদলি নিয়ে আরও কিছু কথা বলা দরকার। সাধারণ বন্দিদের ক্ষেত্রে অত্যাচার আর হুমকি হিসাবেই এটার ব্যবহার হয়। কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতি করার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আছে, তাদের ক্ষেত্রে বদলির ব্যবহার হয় লাগাতার আর পৌনঃপুনিক অত্যাচারের মাধ্যম হিসাবে। বছর বছর বারবার এক জেল থেকে অন্য জেলে নিশ্চিত বদলির যে ব্যবস্থা তাদের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়, তার উদ্দেশ্য লাগাতার অত্যাচার আর সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এক অবস্থার সামনে তাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া। সে অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য দরকার হয় বুকের পাটা, আদর্শের শক্তি আর জনতার প্রতি ভালবাসার টান।

তাই মৃত্যু, আত্মহত্যা আর ঠান্ডা মাথায় খুন সংশোধনাগারে সংশোধনের নিত্য সঙ্গী। আমি সব মিলিয়ে পাঁচটা কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে মোট ১৪ বার বদলির (প্রায় ১০ বছরে) সময়ে প্রত্যেকটা জেলেই একাধিক মৃত্যু দেখেছি। জেলে কঠোর মেহনত, অখাদ্য খাবার, অনিশ্চিত জীবন, অমানবিক ব্যবহার, থিকথিকে নোংরা পরিবেশ আর চিকিৎসার নামে প্রহসন – এগুলোই মৃত্যুমিছিলের কারণ। মৃত্যুর আগে বন্দিরা ছিটেফোঁটা যত্নও পান না, আর মৃত্যুর পরে শুরু হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তের নামে হইচই। এ যেন সেই “জীবনে গরিবী, আর মৃত্যুতে সম্মান”।

মৃত্যুর পাশাপাশি আছে আত্মহত্যা। জেলজীবনের প্রথম বছরেই আমি প্রেসিডেন্সি জেলে তিনটে আত্মহত্যা আর একটা আত্মহত্যার চেষ্টা দেখি। আর খুন? প্রেসিডেন্সি জেলে বিকৃত মস্তিষ্ক বন্দি নিজামের হাতে আরেক বন্দি হ্যাপি সিংয়ের খুন থেকে শুরু করে ধর্ষকাম জেলকর্মীদের হাতে পেটানির চোটে খুন, শেষপর্যন্ত দুদিন ধরে লাগাতার গুলি চালিয়ে পুলিসের বন্দিদের মৃতদেহের স্তূপ বানানো – সবই দেখার সুযোগ হয়েছে আমার।

আরো পড়ুন একটি আত্মহত্যার প্রচেষ্টা ও দেশের বেহাল কারাব্যবস্থা

বিচারের বাণীকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফরিয়াদকে কবরে পাঠানোর জায়গা হল সংশোধনাগার। দুটো উদাহরণ দেওয়া যায়। লালবাজার সেন্ট্রাল লকআপে ১৮ দিন কাটিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে প্রেসিডেন্সি জেলে আসার পরেই আমি ঠিক করি, পুলিস হেফাজতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আলোয় আনতে একটা রিট পিটিশন জেল থেকেই কলকাতা হাইকোর্টে পাঠাব। রিট পিটিশন সুপারিন্টেন্ডেন্টের অফিসে পাঠানোর পরে পিটিশন টাইপ করতে পর্যন্ত রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। পিটিশনও পাঠানো হয় হাইকোর্টে নয়, জেল আইজির কাছে। সেখান থেকে সেই পিটিশনের নকল পাঠানো হয় তাদের কাছে, যাদের আমি পিটিশনের রেসপন্ডেন্ট করেছিলাম। বারবার তাদের কাছে রিমাইন্ডার পাঠান আইজি। শেষপর্যন্ত সাতমাস পরে আমি অনশন করলে অনশনের ১৩ দিনের মাথায় হাইকোর্টে রিট পিটিশন পাঠানোর একটা ফরোয়ার্ডিং মেমোর নকল আমাকে দেওয়া হয়। চারমাস পরে আমি হাইকোর্টে তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী আবেদন করলে হাইকোর্টের এসপিআইও আমাকে জানায়, কোনো ফরোয়ার্ডিং মেমো বা রিট পিটিশন হাইকোর্ট পায়নি।

দ্বিতীয় উদাহরণটা জেলজীবনের শেষ বছরের। দেশের সামাজিক অর্থনীতির উপরে ‘দেশের মাটি’ নাম দিয়ে একটা লেখা লিখে তার নকল আইজির কাছে পাঠানো হয় সেটা আমার স্ত্রীর কাছে পাঠানোর অনুমতির জন্য, যাতে লেখাটা প্রকাশ করা যায়। বারবার খেয়াল করিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে প্রত্যেক সংশোধনাগারে চলছে গাঁজা, ড্রাগ, মাদকের মোচ্ছব। লোকদেখানো তল্লাশি আর পেটাই সত্ত্বেও মাদক সরবরাহ, বাঁটোয়ারা, সেবন চলছে পুরোদমে। মুনাফা কামিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে অফিসার, কর্মী আর সেয়ানা বন্দিরা। মাঝে মাঝে কোনো কোনো কর্মী ধরা পড়ে মাদকসহ। আলিপুর জেলের একজন ডাক্তারের (অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি ডাক্তার) কাছ থেকে টাকা-মোবাইল-মাদক পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ ওঠায় তাকে একমাস জেল খাটতে হয়েছিল জামিন পাওয়ার আগে পর্যন্ত।

জেল হল নতুন নতুন জেল ঘুঘু বানানোর আখড়া। এই জেল ঘুঘুদের দাপট মারাত্মক। তাদের সঙ্গে বেশকিছু কর্মীর দোস্তি থাকে। তাদের জন্য আলাদা রান্না হয়, তারা মাদক ব্যবসা করে, ‘প্রসাদ’ বিতরণও চলে। এসব তৈরি হয় কিছু সেয়ানাদের চেলারা। নতুন নতুন বন্দি চেলার খাতায় নাম লেখায়, ‘ট্রেনিং’ পায়। অন্ধকার ভবিষ্যৎ তাদের টেনে নামায় অন্ধকার জগতে। তারা হয়ে যায় ‘দাদা’ বা ‘ভাই’ বা ‘ভাইয়া’-র ‘ছেলে’। সংশোধনাগার হল অপরাধজগতে নতুন লোক ঢোকানোর কেন্দ্র।

সেলেই যেহেতু রাজনৈতিক কারণে ধৃত বন্দিদের রাখা হয়, তাই সেল সম্বন্ধেও কয়েকটা কথা বলা দরকার। একেক জেলের সেলের মাপ একেকরকম। কোথাও কোথাও একই জেলে বিভিন্ন সেলের মাপ একেকরকম। প্রেসিডেন্সি জেলে সেলের সঙ্গে ঘেরা আঙিনা আছে, যা অন্য জেলে প্রায় নেই। আবার অন্য অনেক জেলে যেমন বাতাস চলাচল করার ব্যবস্থা আছে, প্রেসিডেন্সিতে তা একেবারেই নেই, বর্ধমানে আছে নামমাত্র। রাজনৈতিক বন্দি বা অধ্যয়নরত বন্দিদের জন্য ‘ভাল’ সেলের কথা আছে আইনে, কিন্তু বাস্তবে সবই গড়পড়তা ব্যবস্থা। রাজনৈতিক বন্দি, অধ্যয়নরত বন্দি, ফাঁসির আসামি, জেল অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত আসামি আর ছোঁয়াচে রোগগ্রস্ত আসামি – সবাই পাশাপাশি সেলে থাকে। প্রায়ই লাগাতার সেলে বন্ধ করে রাখা হয় কোনো কোনো আসামিকে।

লাঠি আর টাকা জেলখানার দুই স্টিয়ারিং, লাল চোখ আর দুর্নীতি জেলের দুই মিনার। দুর্নীতি উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। মেট-রাইটার থেকে রক্ষী, কেরানি থেকে অফিসার – সর্বস্তরে চলছে লুঠপাট। থাকার জায়গা, খাওয়া, ওষুধ, হাসপাতাল, মাদক – সবকিছু নিয়ে। আলিপুর জেলের সমস্ত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বেচে দেওয়া হয়েছিল চুপিসাড়ে। প্রেসিডেন্সির এক অফিসারের কৃষ্ণনগর জেলে বদলির সময়ে দেখা গিয়েছিল তার তত্ত্বাবধানে রাখা বন্দিদের সম্পত্তির কোনো হিসাব নেই। দুর্নীতি নিয়ে যে ফিরিস্তিই দেওয়া হোক, তা হবে সমুদ্রে জেগে থাকা হিমবাহের চুড়ো মাত্র। অলমতি বিস্তরেন।

যেখানে অত্যাচার, সেখানেই প্রতিরোধ। লাঠি-টাকা-জেল-জেল ঘুঘুদের দুনিয়া, জেল-ফাঁসির দুনিয়া বা gaols and gallows-এর দুনিয়া ছাড়াও আছে প্রতিরোধের দুনিয়া। জেল যদি শাসকের ঘাঁটি আর দমনের আখড়া হয়, তবু উঁচু দেওয়ালের ঘেরাটোপের ভিতরেও দেখা যায় প্রতিরোধের ঝলক। ঝুমুর গানের কলি একটু বদলে নিয়ে বলা যায় “বতরে লড়াইয়ের ফুল ফোটে।”

আমার জেলজীবনে সাধারণ বন্দিদের দুটো বড় লড়াই দেখেছি। হয়ত খুবই ছোট বিষয় নিয়ে শুরু হয়েছে, কিন্তু পুঞ্জীভূত ঘৃণার বারুদে সেই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গই ঘটিয়েছে বিদ্রোহের বিস্ফোরণ। দুটোই হয়েছে দমদমে। প্রথমটার ফলশ্রুতিতে বদলি হতে হয় সুপারিন্টেন্ডেন্টকে, দ্বিতীয়টা আরও বড়। বন্দিদের ঘৃণার আগুনে জ্বলে ছাই হয়ে যায় সুপার-জেলার-ওয়েলফেয়ার অফিস, ক্যাশ অফিস, ডিসপেনসারি, রেডিও দমদম, সমস্ত কম্পিউটার। বিনা নোটিসে বিদায় নিতে হয় ইন্সপেক্টর জেনারেলকে, কিন্তু প্রাণ দিতে হয় ২৫ জন বন্দিকে। গুলির আঘাত নিয়ে কেন্দ্রীয় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় বহু বন্দিকে। দুদিন ধরে  গুলি চালিয়ে র‍্যাফ শেষমেশ দমন করতে পারে বিদ্রোহকে। সাময়িকভাবে।

বিপ্লবী রাজনীতি করার অভিযোগে ধৃত বন্দিদের পক্ষ থেকেও বহু সংগ্রাম হয়েছে। আমি নিজে একবার ২৫ দিন অনশন করে হাওড়া থেকে হাওড়ার জেলে বদলির আদেশ বাতিল করে মেদিনীপুর জেলে বদলির আদেশ করিয়েছিলাম। জেলের বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও সাধারণ রাজনৈতিক বিষয়ে রয়েছে বহু প্রচার এবং সংহতিমূলক কর্মসূচি।

জেলরক্ষীদের সংঘবদ্ধ সংগ্রামের কোনো নিদর্শন না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে তাদের উপর দমন বা হয়রানির বিরুদ্ধে দেখা গেছে ব্যক্তিগত প্রতিরোধের উত্তাপ। কখনো কখনো বেশ চড়া পর্দাতেই। আমরা এগুলোকে বলতাম সিপাহী বিদ্রোহ। শাসকের ঘাঁটিতে প্রতিরোধের ঝলক।

“আমরা দা-কাটা তামাকের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিই প্রমেথিউসের ডাক/রক্তিম দিগন্তে উন্মুখ হয়ে খুঁজি অগ্নিময় চোখ”।

মোদ্দাকথা, নাম বদলালেও জেলখানা আছে সেই জেলখানাতেই।

লেখক রাজনৈতিক কর্মী। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন। তথ্য লেখকের, মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.