বারাসতের শেঠপুকুরের বাড়ির ছাদে, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা রমা দাশগুপ্তের মনে পড়ে অনেক কথা। উল্লাসকরদার কথা, নিজের পালিয়ে বেড়ানো ছোড়দা সনৎ দত্তের কথা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, তবু স্মৃতিবিভ্রম হয় না। বলেন, কী জানি? এই স্বাধীনতার জন্যই এত ত্যাগ, এত কিছু। সব কি তাহলে মিথ্যে হয়ে গেল? তবুও ভাল লাগে ছোড়দার কথা বলতে, ভাবতে। সত্যিই তো স্বাধীনতা আজ আমাদের কাছে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। তাই শব্দটির দ্যোতনা আমাদের অন্তঃস্থলে গিয়ে কোনো অনুরণন সৃষ্টি করে না। আমাদের পূর্বসূরীরা, যাঁরা তাঁদের জীবন যৌবন, ধন মান দেশের স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠে উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁরা আমাদের কাছে দূর নক্ষত্রলোকের বাসিন্দা। কিন্তু ইতিহাসবোধ ও চেতনার তাগিদে আমাদেরও কখনো কখনো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেখতে ইচ্ছে করে,উল্টাতে ইচ্ছে করে অতীত ইতিহাসের কিছু ছেঁড়া পাতা।
সিলেট এবং কাছাড় – এই দুটি অঞ্চল নিয়েই সুরমা উপত্যকা গঠিত। বঙ্গদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থান হলেও, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জনজাতির সংখ্যাধিক্যের কারণে বাঙালিয়ানা এই উপত্যকার সর্বাঙ্গে। তাই বাংলা ও বাঙালির রাজনীতি, তা স্বদেশি-বয়কট আন্দোলনই হোক, নরমপন্থী-চরমপন্থী বিভাজনই হোক কিংবা সশস্ত্র আন্দোলন – সবকিছুর উত্তাপই এই উপত্যকাতেও এসে পৌঁছেছে, উদ্দীপিত করেছে এই অঞ্চলে আন্দোলনরত শ্রী সংঘ, তরুণ সংঘ, শক্তি সংঘ এবং অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের শাখা সংগঠনগুলোকে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম বিপ্লব তো নিছক একটা ঘটনা নয়। এই সংগ্রামে মাস্টারদার উদাত্ত আহ্বান “টু আর্মস, টু আর্মস কমরেড” সারা ভারতবর্ষের সশস্ত্র আন্দোলনকে এক নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার হতাশা কাটিয়ে বিপ্লবীদের তরুণ হৃদয় আবার নতুন আশা ও সম্ভাবনায় উদ্বেলিত হয়েছিল। মাস্টারদার স্বপ্নকে সফল করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন সুরমা উপত্যকার এক ঝাঁক তরুণ বিপ্লবী। নেতৃত্বে ছিলেন চিন্তাশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক তরুণ – সনৎ কুমার দত্তগুপ্ত। বিপ্লবী মহলে যাঁর পরিচিতি সনৎ দত্ত নামে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিপ্লবী মতিলাল জায়গীরদার আত্মকথায় লিখেছেন, যদি সনৎবাবুর যাবতীয় পরিকল্পনা, বৈদেশিক যোগাযোগ, দেশের মুক্তি আন্দোলনকে ব্যতিক্রমী পথে চালানোর প্রচেষ্টা সফলভাবে রূপায়িত হত তবে তাঁর অনমনীয় সাহস ও চারিত্রিক দৃঢতায় তিনি দেশের প্রথম সারির একজন বিপ্লবী হিসাবে সমাদৃত হতেন।
সনৎবাবুর পিতৃপুরুষ ছিলেন কুমিল্লার বাসিন্দা। তাঁর বাবা ছিলেন রাজন্যবর্গ শাসিত ত্রিপুরার পুলিশ সুপার। বাল্যকাল থেকেই মেধাবী ছাত্র সনৎবাবু ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম দশজন স্থানাধিকারীর অন্যতম ছিলেন। তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন যুগান্তর দলের স্বনামধন্য বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ ধর। তিনিই সনৎবাবুকে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। দেওঘর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে উপেন্দ্রনাথ কারারুদ্ধ হবার পর যুগান্তর দলের দায়িত্বভার সনৎবাবুকে অর্পণ করা হয়।
নতুন দায়িত্ব, নতুন ভাবনা নিয়ে শুরু হয় তাঁর পথ চলা। তিনি হতে চাননি চলতি হাওয়ার পন্থী। প্রথমেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্ত বিপ্লবী সমিতিকে একই রাজনীতির ছত্রছায়ায় আনতে চাইলেন। তরুণ সংঘ এবং অনুশীলন সমিতির সংখ্যালঘু একটা অংশ ছাড়া সবাই তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন। দূরদর্শী সনৎ দত্ত শিবসাগর জেলার বাণিজ্যিক শহর তিনসুকিয়াকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করলেন। স্থির হল, সমস্ত বিপ্লবী কার্যকলাপ ওখান থেকেই পরিচালিত হবে।
সনৎবাবুর রাজনৈতিক ভাবনায় কোথায় যেন ইতালীয় জননেতা জোসেফ ম্যাৎসিনির ছায়া লক্ষ করা যায়। কারণ ম্যাৎসিনির মত তিনিও ভেবেছিলেন, শুধুমাত্র তরুণ বিপ্লবীদের আত্মবলিদানে নয়, দেশের মুক্তি আন্দোলনকে সফল করার জন্য বৈদেশিক সাহায্যেরও প্রয়োজন আছে। তাই তিনি তিব্বত, চীন, থিয়াম (থাইল্যান্ড) থেকে অস্ত্রসাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
উপজাতি অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কোনো আন্দোলনই উপজাতিদের সমর্থন ছাড়া সফল হতে পারে না — এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি আরব, মিশমি, খামতি এবং তিব্বতীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ শুরু করেন এবং সাহায্যের আশ্বাস পান। তাদের ভাষা, আচার ব্যবহার, মানসিকতা এবং ইতিহাস সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল হন এবং এই ধারণায় উপনীত হন, যে ব্রিটিশ রাজের প্রতি তারা আদৌ আস্থাশীল নন। তাদের এই ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। উপজাতি বিক্ষোভ, বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান ধারার সাথে যুক্ত হোক – এটাই তিনি চেয়েছিলেন। তেমনই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের মধ্যেও সরকারবিরোধী মনোভাব, অসন্তোষ সঞ্চারিত হোক – এটা তাঁর অভিপ্রায় ছিল।
তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী মতিলাল জায়গীরদার এবং অনিল দাস এই কাজের ভার নিয়ে সদিয়ায় উপনীত হন এবং উপজাতি প্রধানদের সাথে মিলিত হন। ইতিমধ্যে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে বার্মার সাহায্যপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে সনৎবাবু বার্মা পাড়ি দেন, কিন্তু বার্মা সীমান্তে গ্রেপ্তার হন।
তাঁর আরব্ধ কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জায়গীরদার সদিয়ায় থেকে যান। অনিল দাস থাইল্যান্ড থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সদিয়ায় পাঠান। এই সময় সনৎবাবু জেল থেকে ছাড়া পান এবং নেফা কাণ্ডে চীনের সীমান্ত শহর রীমায় অবস্থান করেন। সেখান থেকেই জায়গীরদারকে নেফার ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভ সংগঠিত করতে নির্দেশ দেন। আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে বিদ্রোহের প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, গোলা বারুদ অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতেও সফল হন।
বিপ্লবী আন্দোলন তখন শতধারায় প্রবাহিত। এই প্রবহমানতা সনৎবাবুর বিপ্লবী চেতনাতেও বিদ্যমান ছিল। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৩৪ সালের ১০ জুলাই তিনসুকিয়া মেল ডাকাতি সংগঠিত হয়। তিনসুকিয়ার অনতিদূরে এই দুঃসাহসিক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও এর ছক কষা হয়েছিল শিলচর শহরে। সেখানকার তরুণ বিপ্লবী উমাশংকর পাটোয়া, বিপুলানন্দ কর, রমাকান্ত দাস, শচীন্দ্রনাথ দাস ছিলেন এই ঘটনার কুশীলব। এই পরিকল্পনার অন্যতম সহযোগী ছিলেন সনৎবাবুর বড় ভাই অজিত দত্ত, যিনি প্রথম জীবনে কলকাতার অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ কলেজের চিকিৎসক ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন এবং তিনসুকিয়ায় প্র্যাকটিস শুরু করেন। এই ডাকাতির ঘটনায় এঁরা সকলেই অভিযুক্ত হন। পাটোয়া এবং অজিত কিছুদিন পরে ছাড়া পান।
আরো পড়ুন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর: এক রোম্যান্টিক বিপ্লবী
ঠিক এইসময়, যখন সদিয়াতে উপজাতি প্রধানদের নিয়ে ওয়ার কাউন্সিল গঠনের পরিকল্পনা প্রায় পাকা, সেই সময় চাঁদপুর মেল ডাকাতির ঘটনায় মতিলাল জায়গীরদার গ্রেপ্তার হন এবং সনৎবাবুর দলের একাংশের নাম গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় ব্রিটিশ পুলিশবাহিনীর অত্যাচার, ব্যাপক ধরপাকড়। দলের অধিকাংশ সদস্যই গ্রেপ্তার হন। তিনসুকিয়া মেল ডাকাতির ব্যর্থতা এবং বিপ্লবী বন্ধুদের সংখ্যাগরিষ্ঠের, সর্বোপরি বিশ্বস্ত সহযোগী সনৎবাবুর যাবতীয় কর্মপরিকল্পনার সিংহভাগ একক দায়িত্বে বহন করার ক্ষমতায় বলীয়ান জায়গীরদারের গ্রেপ্তার সনৎবাবুকে এক চরম বিপর্যয়ের সামনে দাঁড় করায়। সাংহাই থেকে তিনি নিজেও গ্রেপ্তার হন। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণাদির অভাবে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেন। ১৯৫৬ সালে কলকাতা থেকে জোড়হাটগামী এক বিমান দুর্ঘটনার সম্মুখীন সহযাত্রী এক পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষেও উত্তর-পূর্বাঞ্চল বঞ্চিত। অনাদৃত, অনালোকিত তার ইতিহাসও। আর সনৎ দত্তের মত বিপ্লবীরা, যাঁরা দেশের মুক্তি আন্দোলনে এক ব্যতিক্রমী স্বাক্ষর রাখতে চেয়েছিলেন, ইতিহাস তাঁদের মনে রাখেনি। সঠিক মূল্যায়ন হয়নি তাদের কর্মকাণ্ডের। কিন্তু জীবনের কথা, মানুষের কথা বলে যাওয়াই তো ইতিহাসের কাজ। আশা রাখি, ভাবীকালের হাতে সুবিচার পাবেন আঞ্চলিক ইতিহাসের নায়করা। উদ্ঘাটিত হবে প্রকৃত ইতিহাস।
সূত্র:
On the path of Masterda, the leader of the Chittagong Armoury Raid – memories by Motilal Jaigirdar
Revolutionaries of Barak and Surma Valley between two world wars by Dr Manjulika Bhattacharya
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।