নিজেদের জীবনে নৈতিক খবরদারির মুখোমুখি হয়নি এমন লোক বোধহয় কম। মাত্রার তারতম্য হয় লিঙ্গ, পেশা, স্থান ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। এমনটা একেবারেই নয় যে শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বা রক্ষণশীল পরিবারই এমন খবরদারি করে। তথাকথিত আধুনিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত প্রগতিশীল, বামপন্থী, নারীবাদী — অর্থাৎ যাঁদের প্রকৃতিগতভাবে উদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা, তাঁরাও যে ক্ষেত্রবিশেষে মরাল জেঠু/মাসি/পিসির রূপ ধারণ করেন তা-ও বোধহয় আমাদের অজানা নয়। ব্যক্তিগত জীবনে এই নাক গলানোর প্রবণতা হয়ত আমাদের জিনগত বা সামাজিক চিন্তাধারা প্রসূত। সমাজের তৈরি করা কিছু স্টিরিওটাইপের বাইরে বেরিয়ে জীবনযাপন করতে চাইলেই উড়ে আসে সমালোচনার তীর। ব্যক্তিজীবনকে রেয়াত করা হয় না একেবারেই। তারই এক চরম নমুনা আমরা দেখলাম গত কয়েকদিনে, যখন ব্যক্তিগত পরিসরে নিজের পছন্দের পোষাক পরার ভয়ানক অপরাধে একটি বিখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার ঘটনা জনসমক্ষে এল। স্বভাবতই উঠে এল নিজের ইচ্ছেমত পোশাক পরার অধিকারের প্রসঙ্গ।
‘মাই লাইফ মাই চয়েস’ বাক্যবন্ধের ব্যবহার আমরা প্রায় সবাই কারণে অকারণে করে থাকি। আবার এই চয়েসের জন্য প্রায়শই মানুষকে হেনস্থা হতে হয়। তথাকথিত প্রগতিশীলরাও তখন সেই হেনস্থায় যোগদান করতে পিছপা হন না। আবার, যেহেতু এগুলো অনেক ‘আধুনিক’ জায়গায় হয় বা অনেক ‘উদার’ মানসিকতার মানুষ জড়িত থাকেন, সেক্ষেত্রে যে ঘটনার শিকার তার মুখ খোলার সুযোগ কমে যায় বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও সন্দেহ ওঠে। অনেক সময়ে এমন ঘটনার শিকার মানসিকভাবে অত্যাচারিত হয়ে কেরিয়ার বা পড়ার সুযোগ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, এটাও খুবই সত্যি। সুখের কথা, অনেকেই ওই শিক্ষিকার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই নিজের সাঁতারের পোষাক পরা ছবি পোস্ট করে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি একটা খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই শিক্ষিকা খুব জোর গলায় বলেছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজের ব্যক্তিজীবনে কী পোষাক পরবেন বা পরবেন না, তা তাঁর অভিভাবকও নির্ণয় করতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবেই অনেক উদারপন্থী মানুষ এই মনোভাবের সঙ্গে একাত্মবোধ করেছেন। এমনকি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও কালো পোষাক পরে ক্যাম্পাসে সমবেতভাবে প্রতিবাদ করেছেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এই সমস্ত পদক্ষেপই নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এই পছন্দ (চয়েস) ও সম্মতির (কনসেন্ট) আলোচনায় আরো কয়েকটা সমান গুরুত্বপূর্ণ কথা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, কিছু পেশাকে আদর্শ বলে প্রতিষ্ঠা করা সমস্যাসংকুল হতে পারে, যদি পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনের সীমানা গুলিয়ে যায়। শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি বা চিকিৎসকরা বারবার এই সমস্যার সম্মুখীন হন। তাই একজন রিসার্চ স্কলারকে অনায়াসেই বলা যায় ‘ঠিকঠাক’ পোষাক পরে প্রতিষ্ঠানে আসতে হবে। কারণ তিনি ব্যক্তিজীবনে নিজের সুবিধা বা পছন্দ অনুযায়ী যে পোশাকে স্বচ্ছন্দ, তা এমনকি তাঁর উদার আবহাওয়ার কলেজেও কিছু লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অত্যন্ত যোগ্য একজন শিক্ষককেও বলা যেতে পারে চুলের ধরন বদলে ফেলতে, কারণ তা শিক্ষক পদের উপযোগী নয় বলে তাঁর সিনিয়র শিক্ষক মনে করছেন।
তবে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসে, যা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা দেখা যাচ্ছে না। তা হল একজন কর্মীকে বরখাস্ত করার পদ্ধতি কি এইরকম হওয়া উচিত? ওই শিক্ষিকার অভিযোগ হল, তিনি ব্যক্তিগত পরিসরে যে সাঁতারের পোশাক পরা ছবি দিয়েছিলেন তা প্রথমত ওই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার আগের ছবি। দ্বিতীয়ত, তাঁর অজ্ঞাতসারে একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে একধরনের খাপ পঞ্চায়েতসুলভ মিটিং ডেকে, তাঁর মত না নিয়েই তাঁর ছবি নেট থেকে প্রিন্ট করে কয়েকজন ব্যক্তিকে দেখিয়ে, অপদস্থ করে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়।
এখানে একাধিক প্রশ্ন করার জায়গা আছে। যেমন কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ছবি তাঁর সম্মতি ছাড়াই কতৃপক্ষ কীভাবে প্রিন্ট করে ‘সার্কুলেট’ করা হল? কীভাবে তাঁর একটা পুরনো ছবি, যার ইনস্টাগ্রামে থাকার মেয়াদ মাত্র ২৪ ঘন্টা, তা এতদিন পরে প্রথমে ছাত্রের এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে এল? একজন কর্মীর কাজের অধিকার কর্তৃপক্ষ কী করে অস্বীকার করেন? কীভাবে কোনো নিয়মের বালাই না রেখে চাকরি কেড়ে নেওয়া যায়? এটা কি এই কারণে যে প্রতিষ্ঠানটা বেসরকারি, ফলে এদের কোনো নিয়ম মানার প্রয়োজন পড়ে না? এই প্রসঙ্গে এ কথাও উল্লেখযোগ্য, যে ঘটনাটার একটা প্রতিবেদন অনুসারে যে অভিভাবকের চিঠির সাপেক্ষে এই খাপ পঞ্চায়েতের অবতারণা, সেই চিঠির অস্তিত্বও যথেষ্ট সন্দেহজনক। তাহলে ঠিক কোন কারণে এই শিক্ষিকাকে এভাবে হেনস্থা করা হল?
অধ্যাপিকা ডঃ স্বাতী মৈত্রের কথায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে কোনো প্রকাশ্য আলোচনা হয় না। স্বাভাবিকভাবেই এই অলিখিত নিয়মের ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এবং ছাত্র – উভয়ের অধিকারই ক্ষুণ্ণ হয়। প্রশ্ন ওঠে, কোনো সরকারি কলেজের ক্ষেত্রে কি এইভাবে কাউকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা যেত? এখনো পর্যন্ত যে নিয়মে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চলে, তাতে এর উত্তর কিন্তু না-ই হবে। হ্যাঁ, পোশাক আশাক বা শিক্ষকের ব্যক্তিজীবন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে (যদিও ওঠা উচিত নয়, কারণ শিক্ষক তাঁর কাজে কতটা সফল একমাত্র সেটাই গুরুত্ব পাওয়া উচিত) এবং তা শৃঙ্খলারক্ষা সংক্রান্ত কার্যকলাপ অব্দিও গড়াতে পারে, কিন্তু তার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। সেই পদ্ধতি প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে আইন আদালতেও। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির চিহ্ন নেই। বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর সাথে কাজের অধিকার জড়িয়ে আছে। প্রসঙ্গত অনেকসময়েই দেখা যায়, এই সব প্রতিষ্ঠান সরকারি ছুটি বা কর্মীর অন্যান্য অধিকারের প্রশ্নকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে বেআইনিভাবে কর্মীদের শোষণ করে চলেছে। আবার যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনো খ্যাতনামা ধর্মীয় সংগঠন সংযুক্ত থাকে, তাহলে তাদের বেনিয়মগুলোর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে তারা এমন কিছু কিছু নিয়ম তৈরি করে, যা এমনকি দেশের সংবিধানে বর্ণিত সমানাধিকারের মূল নীতিরই বিরোধী।
আরো পড়ুন অবসরের পোশাক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
ডঃ মৈত্র অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে উল্লেখ করেছেন, এই শিক্ষিকার ঘটনায় মিডিয়া তথা জনমানসের কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে ব্যক্তির অধিকার বা শিক্ষকের আদর্শের প্রশ্ন। কিন্তু সম্পূর্ণ অবহেলিত হয়েছে কর্মীর অধিকারের প্রশ্ন। প্রায় কোনো সংবাদমাধ্যমই এ বিষয়ে আলোচনা করেনি। তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিকিনি পরা বা না পরার অধিকারের প্রশ্ন।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, যে ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব পছন্দের অধিকার এক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। আমার শরীরের উপর একমাত্র আমারই কর্তৃত্ব চলবে, আর কারোর নয় – একথা অবশ্যই জরুরি এবং বারবার বলা দরকার। পাশাপাশি আইনগতভাবে ব্যক্তির কাজের অধিকারের লঙ্ঘন এড়িয়ে যাওয়াও বিপজ্জনক। মার্কসবাদী নারীবাদের চেতনায় বারবার এই বক্তব্য উঠে এসেছে যে লিঙ্গসাম্যের দাবির সাথে অর্থনীতির প্রশ্ন যুক্ত না হলে তা সুদূরপ্রসারী ফল দিতে পারে না। ভারতের প্রেক্ষিতে এখানে জাতপাতের বিষয়টাও যুক্ত করতে হয়।
অর্থাৎ যারা প্রশ্ন তুলছেন, সাঁতারের পোশাকে কোনো পুরুষ শিক্ষকের ছবি দেখা গেলে তা-ও কি এই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করত? তাঁদের বলা দরকার যে, উত্তর হ্যাঁ হলে সেক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের এই কাজ সমর্থনযোগ্য হত না। কারণ তাঁরা একজন কর্মীর অধিকারকে বেআইনিভাবে লঙ্ঘন করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়াই একজন মানুষকে তাঁর নিজের যোগ্যতায় লাভ করা পদ ছাড়তে বাধ্য করেছেন। এ ঘটনা ভবিষ্যতে আরও জটিল সমস্যার সৃষ্টি করবে যদি আমরা এই প্রশ্নগুলো তুলতে না পারি। এই ধরনের ঘটনার নজির দেখিয়ে শ্রেণি বা জাতির প্রশ্নেও বড় অসাম্য সৃষ্টি করতে পারে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান (ইতিমধ্যেই করার হয়েছে এমন নজির খুঁজলেই পাওয়া যাবে)।
তাই নিজের পছন্দের পোশাকে অবশ্যই ছবি তুলুন, কিন্তু কর্মীর অধিকারের প্রশ্নটাও তুলতে ভুলবেন না। কারণ ব্যক্তিগত জীবনের মত পেশাগত জীবনের অধিকারগুলোও মানুষের কাছে অপরিহার্য।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।