১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পৃথিবীতে একসঙ্গে তিনটে ঘটনা ঘটেছিল। ওই তিনটেই ছিল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রথম এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা সবাই জানে, তা হল জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। ইউরোপের বুকে তিনের দশক জুড়ে চলতে থাকা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর স্বাভাবিক তুঙ্গ মুহূর্ত ছিল ওই ঘটনা। ছবছর ধরে যে যুদ্ধ কাঁপিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীর মানুষকে, তার আনুষ্ঠানিক সূচনা বলা যায় হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণকে।
জার্মান সেনাবাহিনী যখন পোল্যান্ড সীমান্তে যুদ্ধ শুরু করল, সেদিনই বার্লিনের কাইজার উইলহেল্ম ইনস্টিটিউটে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গকে প্রোজেক্ট হেড করে প্রোজেক্ট উলভারিন বা জার্মান অ্যাটমিক বম্ব প্রোজেক্টের কাজ শুরু হয়। কাইজার উইলহেল্ম ইনস্টিটিউটের পূর্বতন ডিরেক্টর ফ্রিৎজ হেবারকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইহুদি পরিচয়ের জন্য। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইপরের যুদ্ধে এই হেবার আবিষ্কৃত রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের ফলেই জার্মানি অনেকখানি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর দেশভক্তি নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না। এমনিতেও বেশিরভাগ বিজ্ঞানী তাঁদের ইহুদি পরিচয়ের জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। যে কজন অ-ইহুদি টিকে ছিলেন তাঁদের মধ্যে হাইজেনবার্গই একমাত্র, যাঁকে এই প্রোজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারত। হিটলারের স্নেহধন্য ডয়েশ ফিজিকের মাথা ফিলিপ লেনার্ড তাই হাইজেনবার্গ ছাড়া অন্য কাউকে পাননি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ওই ১ তারিখেই ক্যালটেকের এক অধ্যাপক তাঁর ছাত্র হার্টল্যান্ড স্নাইডারের একটি পেপার ফিজিকাল রিভিউ-তে প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘On Continued Gravitational Contraction’। সেই অধ্যাপকের নাম রবার্ট জে ওপেনহাইমার, পরবর্তীকালে যিনি পরমাণু বোমার জনক হিসাবে আখ্যা পাবেন।
ফিজিকাল রিভিউর সেই সংখ্যাতেই আরেকটা আকর্ষণীয় পেপার প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনামে ‘The Mechanism of Nuclear Fission’। সেই পেপারের লেখক নীলস বোর আর জন আর্চিবল্ড হুইলার। তার আগের বছরই খবর এসেছে, বার্লিনে অটো হান পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে ফেলেছেন। ভেঙে ফেলার পর সেই নিউক্লিয়াস থেকে কীভাবে শক্তি নির্গত হতে পারে তার একটা ধারণা ছিল বোর আর হুইলারের ওই পেপারে।
এর ঠিক তিন বছর পর থেকে লস আলামসে শুরু হল এক কঠোর গবেষণা। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গোপন কক্ষের মধ্যে প্রকৃতি যে বিশাল শক্তির আধার সঞ্চয় করে রেখেছিল, সেই শক্তিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। এর পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। দেবতাদের থেকে আগুন চুরি করে এনে মানুষকে দেওয়ার অপরাধে দেবতারা সারাজীবনের জন্য নির্বাসন দিয়েছিলেন প্রমিথিউসকে। প্রকৃতির গোপন কক্ষ থেকে শক্তি চুরি করে আনার জন্য আমেরিকার প্রমিথিউসকেও কম নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি।
দেশপ্রেমের সংজ্ঞা আসলে ধোঁয়াশায় ভরা। প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমের কোনো সংজ্ঞা হয় না। হেবারের মত বিশ্ববরেণ্য রসায়নবিদ, অ্যামোনিয়া আবিষ্কারের জন্য যিনি বিখ্যাত, জার্মানি ছাড়া অন্য কোনো দেশকেই নিজের দেশ বলে ভাবতে পারেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হাতে রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার কারিগর হওয়া সত্ত্বেও তথাকথিত প্রকৃত দেশপ্রেমী নাজিদের হাতে পড়ে তাঁকে কম নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি। অন্যদিকে পরমাণু বোমা তৈরি মানবতার দৃষ্টিভঙ্গিতে যতই ঘৃণ্যতম অপরাধ হোক, ম্যানহাটন প্রোজেক্টের ডিরেক্টর হিসাবে তাঁর কাজকর্মের ফলে ওপেনহাইমারকে অন্তত আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিতে কেউই দেশদ্রোহী আখ্যা দিতে পারবে না। কিন্তু এহেন প্রমিথিউসের কপালেও জুটেছিল দেশদ্রোহের অভিযোগ। কোনো দেশের শাসকই আসলে বোঝে না, শাসকের রাজনৈতিক বিরোধিতা মানেই দেশদ্রোহিতা নয়। অথচ সেই রাজনৈতিক বিরোধিতাকেই দেশদ্রোহ বলে চালানো হয় প্রায় প্রত্যেকটা দেশে। উন্নত দেশ হোক বা উন্নয়নশীল, শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি কোথাও পালটায় না।
পরমাণু বোমার বীভৎসতা আঘাত করেছিল প্রোজেক্ট হেডকেও। কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলে চণ্ডাশোক যেমন ধর্মাশোকে পরিণত হয়ে পৃথিবী জুড়ে শান্তির বাণী ছড়িয়ে গিয়েছিলেন, ওপেনহাইমারও তেমন হিরোশিমা, নাগাসাকির অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে বিশ্ব জুড়ে শান্তির বাণী ছড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এই বীভৎসতা শুধু তাঁকে নয়, আঘাত করেছিল আইনস্টাইনকেও। তিনি নিজেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন বাইরের জগৎ থেকে। পদার্থবিদ ওপেনহাইমারকে গ্রাস করে ফেলেছিল রাজনৈতিক ওপেনহাইমার। পরমাণু বোমার আঘাতে জাপানের দুটো শহরকে ধ্বংস করার পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন মেতে ওঠে হাইড্রোজেন বোমা বানানোর নেশায়, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে সেই প্রোজেক্টের যতদূর সম্ভব বিরোধিতা করে গিয়েছেন ওপেনহাইমার। এই বোমা শুধু হিংসা বাড়িয়ে চলবে, আর কিছু হবে না – এই ছিল তাঁর বক্তব্য। এতেই ম্যাককার্থি যুগের রাজনৈতিক নেতাদের আমেরিকান ভাবাবেগে আঘাত লাগে। ওপেনহাইমার অতীতে যা রাজনৈতিক কাজকর্ম করেছিলেন তা নিয়ে কাঁটাছেড়া শুরু হয়। ক্যাঙারু কোর্টে বিচারের নামে প্রহসন করে দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা শুরু হয়। (ঠিক এরকম সময়েই ভারতীয় বন্ধু হোমি ভাবার হস্তক্ষেপে জওহরলাল নেহরু ওপেনহাইমারকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিলেন (সূত্র : Homi J Bhaba – A Life; Bakhtiyar K Dadabhoy)। প্রমিথিউসের মত আজীবন নির্বাসন অবশ্য সহ্য করতে হয়নি ওপেনহাইমারকে। তাঁর দেশপ্রেমকে কলঙ্কিত করেই শাসককে ক্ষান্ত হতে হয়েছিল।
আরো পড়ুন কিউবার ‘সংকট’ ও আমেরিকা: তুমি সাপ হয়ে কাটো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো
ক্রিস্টোফার নোলানের ছবি ওপেনহাইমার আসলে শাসকের ঠিক করে দেওয়া দেশভক্তির সংজ্ঞাকেই যেন চ্যালেঞ্জ করে। ছবির একেবারে শেষদিকে আইনস্টাইনের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়া কথাগুলোই যেন ছবির নির্যাস। একদম শেষ দৃশ্যে বৃদ্ধ আইনস্টাইন ওপেনহাইমারকে বলছেন “আমি না হয় নিজের দেশ ছেড়ে চলে এসেছি, কিন্তু তুমি তোমার নিজের দেশের থেকেই বা কী পেলে? দেশ আসলে কারো নয়। একদিন হয়ত এরা তোমাকে মেডেল দেবে, তোমার পিঠ চাপড়ে প্রশংসা করবে, কিন্তু মনে রাখবে সেসব কিছুই তোমার জন্য নয়। সবকিছু ওদের জন্য। ওই দেশ বলে যে জিনিসটাকে যারা চালায়, তাদের জন্য।”
চিরকালের শান্তিবাদী (pacifist) এবং বেশ খানিকটা সময় নাগরিকত্বহীন হয়ে থাকা বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী ছাড়া আর কার মুখ দিয়েই বা নোলান এই কথাগুলো বলাবেন? আর কার মুখ দিয়েই বা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাবেন?
ঠিক এই জায়গায় এসে ছবির ছোটখাটো ভুলত্রুটিগুলো ঢাকা পড়ে যায়। তবে নোলান বলেই সেগুলো খুব চোখে লাগে। পদার্থবিদ্যা আর নোলান যেখানে একে অপরের পরিপূরক, যেমন টেনেট, ইনসেপশন বা ইন্টারস্টেলার; বিশেষত ইন্টারস্টেলার ছবিতে যেখানে কিপ থর্নের মত পদার্থবিদ যুক্ত ছিলেন, সেখানে এই ছবিতে যত ছোটই হোক, তথ্যগত ভুল হলে চোখে পড়বেই। যেদিন জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে, সেদিনই ওপেনহাইমার-স্নাইডারের পেপার প্রকাশিত হয়। ক্যালটেকের বার্কলে ল্যাবরেটরির তৎকালীন ডিরেক্টর ছিলেন আর্নেস্ট লরেন্স। তাঁর নামেই বার্কলে ল্যাবরেটরির এখনকার নাম লরেন্স বার্কলে ল্যাবরেটরি। ওপেনহাইমার তখন সেখানকার অধ্যাপক। ছবিতে দেখানো হয়েছে একজন ছাত্র ওপেনহাইমারকে বলে “ব্ল্যাক হোল নিয়ে আপনার পেপার প্রকাশিত হয়েছে।” অথচ ব্ল্যাক হোল কথাটা চালু হয় ওই ঘটনার বেশ কয়েক দশক পরে। ওপেনহাইমারের ওই পেপার যে প্রাথমিকভাবে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কেই তা ঠিকই। কিন্তু ছয়ের দশকে হুইলারের আগে ব্ল্যাক হোল শব্দবন্ধটা কেউ ব্যবহার করেনি।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
ফ্রিৎস হেবার ১৯৩৪ এ মারা গিয়েছিলেন। সুতরাং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার দিনে তাঁর অপসারণ সম্ভব নয়। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Fritz_Haber
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমরা শুধরে নিলাম।