গত ২৫শে সেপ্টেম্বর আনুমানিক রাত তিনটেয় মৃত্যু হল কমলা ভাসিনের। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় নারীবাদের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। বেশ কিছুদিন যাবৎ ক্যান্সারে ভুগছিলেন, কিন্তু, তা সত্ত্বেও বিভিন্ন কাজে ছিল তাঁর অফুরন্ত উৎসাহ। এমনকি মৃত্যুর আগের দিন বিকেলেও একটি ভার্চুয়াল আলোচনা চক্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হয়েও তাঁর লড়াইয়ের স্পৃহায় ভাঁটা পড়েনি। হাসপাতাল থেকে ফিরে আবার কাজে যোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন নিজের বন্ধু, সহকর্মীদের। কিন্তু সেই সুযোগ আর হল না। আর তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই ভারতে নারীবাদের একটা যুগের অবসান হল।

কমলা ভাসিনকে আমি চিনেছিলাম ছাত্রজীবনে, প্রাথমিকভাবে তাঁর ছোট ছোট চটি বইয়ের মাধ্যমে। লিঙ্গ রাজনীতি বা নারীবাদের অ আ ক খ শেখার শুরু তাঁর লেখার হাত ধরেই। সপাটে বলে দিতে পারতেন তিনি, মেয়েরাও পিতৃতান্ত্রিক হতে পারে বা পুরুষরা নারীবাদী। বোধহয় তাঁর লেখাতেই প্রথম পড়েছিলাম যে পিতৃতন্ত্র মেয়েদের শোষণ তো করেই, ছেলেদেরও অবদমিত করে রাখে। আর তাই, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বলে “মর্দকো দর্দ নেহি হোতা!” বা কান্না ছেলেদের “মেয়েলি” করে দিতে পারে। অদ্ভুত লেখনী শক্তি এবং অনুধাবন ক্ষমতা ছিল তাঁর। খুব সহজে দুরূহ সব বিষয় বুঝিয়ে দিতে পারতেন। অনেক সময়ই রাজনৈতিক দর্শনের লেখকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে তাঁদের লেখা সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য, জারগনে ভারাক্রান্ত। এই জায়গায় কমলা ভাসিন ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি নিজেই বলেছেন, যে তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে যখন বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন, তখন নারীবাদের বিখ্যাত তাত্ত্বিক অংশগুলি তাঁর কাছে ছিল অজানা। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুবাদেই তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন সেই সব তত্ত্ব, যা বেশিরভাগ তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বই পড়ে জানতে পারে, কিন্তু তার প্রায়োগিক দিকটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অজানা থেকে যায়। কমলা ভাসিন যেহেতু তথাকথিত শিক্ষাজগতের লোক বা তাত্ত্বিক দার্শনিক ছিলেন না, তাই বোধহয় এই তত্ত্বগুলির চেহারা তাঁর কাছে সুস্পষ্ট রূপে ধরা দিয়েছিল, এবং তাঁর লেখায় অত্যন্ত সহজে সেগুলি প্রকাশ পেয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

১৯৪৬ সালের ২৪শে এপ্রিল অধুনা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে তাঁর জন্ম হয়। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। পরবর্তী সময়ে তাঁর পিতা ভারতের রাজস্থানে ডাক্তারি শুরু করেন। কমলার বেড়ে ওঠা এখানেই। গ্রামীণ পারিপার্শ্বিকে গড়ে ওঠায়, তাঁর পক্ষে গ্রামজীবন ও সেখানে নারীর স্থান অনুধাবন করা ছিল অনেকটাই সহজ। রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করে তিনি মুন্সটারে পড়তে যান। ভারতে ফিরে এসে তিনি সেবা মন্দির নামক একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন, যারা মূলত প্রাকৃতিক শক্তি সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করত। এইখানেই তাঁর সাথে তাঁর ভবিষ্যৎ স্বামীর (প্রাক্তন) আলাপ হয়। একই সময়ে কমলার রাজনৈতিক বোধ গড়ে ওঠে বলা যায়। কমলা আবিষ্কার করেন যে ভারতে জাতিভেদ প্রথা এবং পিতৃতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। অর্থাৎ লড়াইটা এই দুটি কুপ্রথার বিরুদ্ধেই। এরপর তিনি কিছুদিন রাষ্ট্রসংঘেও কাজ করেছিলেন। শেষে এই কাজ ছেড়ে দিয়ে নারীবাদী আন্দোলনে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিমজ্জিত করেন সংগত নামক সমিতির মাধ্যমে। এই সময়ে বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির আয়োজন করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে বই লেখার কাজ। আন্ডারস্ট্যান্ডিং জেন্ডারহোয়াট ইজ প্যাট্রিয়ার্কি ইত্যাদি বইয়ের মাধ্যমে অত্যন্ত সরলভাবে তিনি তুলে ধরেন লিঙ্গ রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।

বামপন্থী নারীবাদী হিসাবে কমলা মনে করতেন যে পুঁজিবাদের মোড়কে পিতৃতন্ত্র সমাজে মেয়েদের অবস্থানকে বিপন্ন করেছে। আজকের যে ধর্ষণ সংস্কৃতির কথা নারীবাদীরা প্রায়শই বলে থাকেন, তাঁর মতে তার দায় এই পুঁজিবাদী সমাজের, যা নারীকে শরীর মাত্রে পরিণত করতে চায়। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় সমাজে পরিবর্তন আনা ও মেয়েদের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। অনেকেই বর্তমানে ভাবেন যে নারীবাদী চিন্তার ধারা ভারতে এসেছে পাশ্চাত্য থেকে। এই চিন্তাধারার তীব্র বিরোধী ছিলেন কমলা। এমনকি খুব সম্প্রতি আলোড়ন তোলা স্লোগান “আজাদী”, যার উৎস অনেকের মতে কাশ্মীর, এবং যা উচ্চারণ করে জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র দেশদ্রোহী তকমা পেয়েছেন, তার জন্যেও কমলা ধন্যবাদার্হ। আদতে পাকিস্তানের নারীবাদী লড়াইয়ের এই স্লোগান এ দেশে এনেছিলেন কমলা ভাসিন। ১৯৭০-৮০র দশকে দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী হিসাবে কমলা এবং তাঁর সহকর্মীরা ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল প্রভৃতি দেশের সাথে নারীবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে যে যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন, সেই সময়ের নিরিখে তা মোটেই সহজ ছিল না।

সংগত ও জাগরীর পাশাপাশি কমলা ভাসিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং আন্দোলনে, যা দিল্লীর জ্যোতি সিংয়ের ভয়াবহ ধর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠিত হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও তাঁর ভাষা এবং নারীবাদী রাজনীতির ব্যবহারিক প্রয়োগের ফলেই বোধহয় তাঁর নারীবাদী রাজনীতিতে “এক্সক্লুশনিস্ট” চিন্তাধারার প্রভাব দেখা যায়। কিছুদিন আগেই, নারীবাদী লড়াই সংক্রান্ত একটি আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি দলিত ও রূপান্তরকামী মানুষদের লড়াইকে তার থেকে আলাদা করে দেখার কথা বলেছিলেন। স্বভাবতই, যে সময়ে নারীবাদী রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ “ইনক্লুসিভনেস”, অর্থাৎ, দলিত, রূপান্তরকামী, অশ্বেতাঙ্গ সবাইকেই নারীবাদের ছাতার তলায় জড়ো করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, সে সময়ে কমলা ভাসিনের মত দীর্ঘকালীন আন্দোলনকর্মী ও নারীবাদীর থেকে এই বক্তব্য অভিপ্রেত ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর আগে করা তাঁর শেষ টুইটটিতে তিনি এই মত ত্যাগ করেছিলেন, এবং ভবিষ্যতে এ সম্বন্ধে আরো বোঝার চেষ্টা করবেন জানিয়েছিলেন। সে সময় আর তিনি পাননি, কিন্তু পঁচাত্তর বছরের ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষটির এই নতুনকে বোঝার প্রয়োজনীয়তা অনুভবই হয়ত তাঁকে কমলা ভাসিন করেছে। অদম্য হার না মানা লড়াইয়ের স্পিরিট তিনি রেখে গেলেন উত্তরাধিকার হিসাবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের নারীবাদের কর্মীদের জন্য।

(ঋণ: কমলা ভাসিনের শেষ টুইটটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য স্বাতী মৈত্রের ‘Kamla Bhasin, a complicated legacy: examining the activist-writer’s work and politics’ প্রবন্ধ)

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.