ভারতবর্ষে নারী হয়ে জন্মানোর সুবাদে ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলা অত্যন্ত লজ্জার কথা। মেয়েদের জীবনে স্বাভাবিকভাবেই ঋতুচক্র আসে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে তা নিয়ে কথাবার্তা বলার চল নেই। খুব বিখ্যাত এক কোম্পানি স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্র্যান্ডের নাম রেখেছে ‘হুইস্পার’ (যার বাংলা ফিসফিস করে কথা বলা), কারণ মাসিক ঋতুচক্র নাকি খুব গোপন বিষয়। আমার বেশ মনে আছে, একটা সময় আমরা নারীবাদী আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটা প্রচারাভিযান চালিয়েছিলাম, যার নাম ছিল ‘নো মোর উইস্পার’। অর্থাৎ ঋতুচক্র নিয়ে আমরা আর ফিসফিস করে কথা বলব না, জোর গলায় কথাবার্তা চালাব। ফলে বিহারে এক অনুষ্ঠানের এক ভিডিওতে যখন দেখি তরুণী রিয়া কুমারী ভরা সভায় দাবি করছে, সরকার তাদের কম খরচে হুইস্পারের প্যাকেট দিক, তখন আমাদের বয়সের মহিলারা খুশি হয়। মনে হয়, অন্তত কয়েক ধাপ এগোতে পেরেছি এই প্রজন্মের হাত ধরে। কিন্তু এই একই ভিডিওতে যেভাবে রিয়াকে আমলা হরজোত কৌর বামরার হাতে অপমানিত হতে দেখলাম, তা আমাদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে।
স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে কথা বলেছে বলেই মেয়েটিকে অপমান করা হয়েছে, তা নয় অবশ্য। সরকারি আধিকারিক তাকে বলেছেন সরকারের কাছে কিছুই দাবি করা উচিত নয়। কারণ চাওয়ার কোনো শেষ নেই। ন্যাপকিনের পর তারা জিনস, জুতো, এমনকি কন্ডোমের দাবি করে বসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ওই আধিকারিক। এ আসলে সুকৌশলে অত্যাবশ্যক পণ্য আর শখের জিনিসকে এক করে দেওয়া। কারণ জিনস তরুণীদের পছন্দের পোষাক হতে পারে, কিন্তু তার বদলে অন্য পোষাকও পরা যায়। কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিন মোটেই শৌখিন জিনিস নয়। ন্যাপকিনের পরিবর্তে আমাদের দেশে বহু মেয়ে গাছের পাতা, পুরনো কাপড়, বালির পুঁটলি – এরকম নানা ধরনের জিনিস ব্যবহার করে। ফলে নিয়মিত গুরুতর সংক্রমণের সম্মুখীন হয়। যে সরকারি আধিকারিক কথাগুলো ওই তরুণীকে বলেছেন তিনি নিজেও মহিলা। স্যানিটারি ন্যাপকিন না পেলে তিনিও আজ অত উঁচু পদে পৌঁছতে পারতেন কিনা সন্দেহ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আমাদের দেশের পরিসংখ্যান বলছে, ঋতুকালীন সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন না পাওয়ার জন্য ২ কোটি ৩০ লক্ষ মেয়েকে স্কুল থেকে বিদায় নিতে হয়। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুসারে বিহারে মাত্র ৫৯% মহিলা ঋতুকালীন স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে পারেন। বলাই বাহুল্য, দারিদ্র্য এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা। স্যানিটারি ন্যাপকিন আমাদের দেশে যথেষ্ট দাম দিয়েই কিনতে হয় এবং গরিব পরিবারে যেখানে মেয়েরা এ নিয়ে খুলে কথাই বলতে পারে না, সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার পয়সা পাবে কী করে?
এখন প্রশ্ন হল, এইসব পরিসংখ্যান কি ওই আধিকারিক জানেন না? নাকি জানলেও তিনি ব্যাপারটাকে গুরুত্বহীন মনে করেন? বলে রাখা ভাল, এই আধিকারিক উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের শীর্ষ অধিকর্তা। সবচেয়ে বড় কথা, স্যানিটারি ন্যাপকিন আমাদের দেশের অনেকগুলো রাজ্যে সত্যিই মেয়েদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। শক্তি উড়ান নামক প্রকল্পে রাজস্থান সরকার এই কাজ করে থাকে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকও বেশ কিছু প্রকল্প চালায়। উড়িষ্যার উজ্জ্বলা প্রকল্প তার মধ্যে অন্যতম। কেরালাতেও স্কুলে স্কুলে একই উদ্দেশ্যে ‘শি প্যাড’ নামে একটা প্রকল্প চলে।
আরো পড়ুন গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা মেয়েদের অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া
এই আধিকারিকের বিরুদ্ধে জাতীয় মহিলা কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেস দায়ের করেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন তিনি এ বিষয়ে অবগত এবং ব্যবস্থা নেবেন। আধিকারিক অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত এবং কারোর উপর নির্ভরশীল না হওয়ার পরামর্শই দিয়েছিলেন, কোনো অন্যায় করেননি।
মুশকিল হল, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সরকারের কাছে কিছু দাবি জানানোর সংঘাত নেই। বরং পরিবারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে মেয়েরা রাষ্ট্রের কাছে কিছু দাবি জানাচ্ছে — এটাই সুলক্ষণ। অথচ অদ্ভুতভাবে এক্ষেত্রে সরকারের কাছে কিছু দাবি করলেই সে দেশদ্রোহী – এমন বলার প্রবণতা দেখা গেল। ছাত্রীদের সঙ্গে কথোপকথন চলতে চলতে আধিকারিক তো বলেই দিলেন, সরকারের কাছে দাবি থাকলে আর ভারত কেন? পাকিস্তান হয়ে যাও। এ দেশে বেশ কিছুদিন হল নাগরিকদের তাদের ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, বেশভূষা, এমনকি সোশাল মিডিয়ার পোস্ট দেখেও “পাকিস্তান চলে যাও” বলা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মহিলাদের ক্ষমতায়নের সরকারি মঞ্চ থেকে সরকারের কাছে কিছু দাবি করলে “পাকিস্তান হয়ে যাও” বলার মত ভয়ংকর ঘটনাও আমাদের দেখতে হল।
ওই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিহারের ছাত্রীটিকে এক ন্যাপকিন প্রস্তুতকারক কোম্পানি বিনামূল্যে ন্যাপকিন সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু ছাত্রীটি বলেছে সে নিজের জন্য এই দাবি করেনি, করেছে সব গরিব মেয়ের জন্য। অত বড় মঞ্চে সকলের সামনে উচ্চপদস্থ অফিসারের থেকে অত ভয়ংকর কথা শোনার পরেও শান্তভাবে মেয়েটি সমস্ত গরিব মেয়ের দাবি জানাতে ভুলছে না – এ অবশ্যই নারীবাদী আন্দোলনের জন্য আশার কথা। অত্যাবশ্যক পণ্য সরকারের কাছে দাবি করা একজন নাগরিকের অধিকার। এই দাবি তুললে পাকিস্তান চলে যাও বলা যায় না – এ সত্য বারবার নাগরিকদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।