১৯৭৩ সালে জেনারেল পিনোশে চিলের নির্বাচিত সালভাদোর আয়েন্দে সরকারকে অস্ত্রের জোরে পদচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের যোগ্যতার্জন পর্বে চিলে বনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন ম্যাচের ফিরতি খেলা সান্তিয়াগোর এস্তাদিও নাশিওনালে খেলতে অস্বীকার করে সোভিয়েতরা। কী হল তারপর? পড়ুন আজ দ্বিতীয় পর্বে

ফিফার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুই সদস্যের দল এসে পৌঁছল এস্তাদিও নাশিওনালে। সেই প্রতিনিধি দলে ছিলেন ফিফার সাধারণ সম্পাদক হেলমুট কেজার এবং ব্রাজিলিয়ান প্রতিনিধি আবিলিও দে আলমেইডা। শেষের জন ছিলেন ব্রাজিলের একনায়কতান্ত্রিক সরকারের ঘনিষ্ঠ। কেজার আগে থেকেই তাঁর মনোভাব পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। “প্রত্যেকবার দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা, রাজনৈতিক বন্দি আছে কিনা, কেউ কান্নাকাটি করছে কিনা এসব বিচার করে ম্যাচ আয়োজন করতে গেলে পৃথিবীর কোথাও ম্যাচ করানো সম্ভব নয়।” ফলে তাঁদের সিদ্ধান্ত কী হতে পারত সহজেই অনুমেয়। তাঁরা পৌঁছনোর আগে অধিকাংশ বন্দিকে পাচার করে দেওয়া হল আতাকামা মরুভূমির ডিটেনশন সেন্টারে। তা সত্ত্বেও প্রায় ৭,০০০ বন্দী সেখানে ছিলেন। বন্দুকের নলের ডগায় তাঁদের রাখা হল ড্রেসিংরুম, প্লেয়ার্স টানেল এবং বেসমেন্টে। “গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম ফিফা প্রতিনিধিরা মাঠে ঘুরছেন, সঙ্গে সাংবাদিকরাও আছে। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে ডাকি। কিন্তু পারিনি কারণ জানতাম তার পরিণতি হবে বুলেট।” বলছিলেন ফেলিপে আগেরো, আয়েন্দে সরকারের সমর্থক বামপন্থী দলের সদস্য হবার অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ফিফা প্রতিনিধি দল দশ মিনিটে মাঠের ঘাস আর বাথরুমের শাওয়ার পরীক্ষা করে চলে গেলেন এবং রিপোর্ট দিলেন “সব চাঙ্গা সি।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রতিনিধি দলের রিপোর্ট পাওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিফায় একঘরে হয়ে পড়ল। ২১ সদস্যের বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির ১৫ সদস্যই এস্তাদিও নাশিওনালে ফিরতি ম্যাচ আয়োজনের পক্ষে ভোট দিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন চিলের একনায়কের হাতের পুতুলের মত আচরণ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করল ফিফাকে। চিলে পাল্টা জবাবে জানাল “মাঠের বাইরের বিষয় মাঠের ভিতর টেনে এনে সোভিয়েতরা অকারণ বিতর্ক তৈরি করছে।” অবস্থা বেগতিক দেখে কেজার গোপন বার্তা পাঠালেন চিলের ফুটবল ফেডারেশনের কর্তা ফ্রান্সেস্কো ফ্লুক্সাকে “সংবাদমাধ্যমের নেতিবাচক রিপোর্ট থামানোর স্বার্থে অন্য কোনো মাঠে আয়োজন করা যাবে?” ফ্লুক্সা কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না, উল্টে চোটপাট করলেন “সোভিয়েতদের জন্য আমাদের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রথম পর্বের রেকর্ডিং আমাদের দেওয়ার চুক্তি ভেঙেছে ওরা।”

এই ফ্লুক্সার ভূমিকা ছিল চরম সুবিধাবাদীর। শোনা যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম চিলে প্রথম দফার ম্যাচের আগে প্রবল কমিউনিস্টবিরোধী ব্রাজিলিয় রেফারি আর্মান্দো মারকেজকে এক প্যাকেট দামি আমেরিকান সিগারেট উপহার দেন ফ্লুক্সা। সহজেই অনুমেয় মাঠে চিলে ফুটবলারদের কড়া ট্যাকল কেন মার্কেজের চোখে পড়েনি। ফিফা প্রতিনিধি দলকে এস্তাদিও নাশিওনেল ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্বেও ছিলেন ফ্লুক্সা। তখন সরকারের অনুগত কর্মচারীর ভূমিকা পালন করলেও ঘটনার ৪০ বছর পর ইনি নির্লজ্জের মত স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করেন “আমরা তো জানতাম ওখানে রাজনৈতিক বন্দিরা আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার খারাপ লাগছিল। কিন্তু গোটা পৃথিবীই তো জানত।”

পিনোশে সরকার যথারীতি সান্তিয়াগো ছাড়া অন্যত্র ম্যাচ আয়োজনের প্রস্তাব বাতিল করে দিল। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষও অনড় থাকলেন। “নৈতিক কারণেই চিলের দেশপ্রেমিকদের রক্তে ভেজা সান্তিয়াগো স্টেডিয়ামে সোভিয়েতরা খেলতে যাবে না।” এই ছিল তাঁদের উত্তর। ফিফা থেকে শাস্তির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তাঁরা অনমনীয় থাকলেন। ফিফা ম্যাচ বাতিল তো করলই না, উল্টে আর্থিক ক্ষতির কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ১,৭০০ ডলার জরিমানা করল।

এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে চিলের খেলোয়াড়রাও মানসিক স্বস্তিতে ছিলেন না। প্রথম দফা ম্যাচের আগেই ডিফেন্ডার নেলসন ভাসকুয়েজের বাবা নিখোঁজ হয়ে যান। উনি ছিলেন পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। বাবা ফিরে না আসা পর্যন্ত ভাসকুয়েজ মস্কো যেতে অস্বীকার করেন। অবশেষে কয়েকদিন পর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়। ভেলিজ নিজে দিন কাটাচ্ছিলেন অসম্ভব মানসিক উদ্বেগে। তাঁর খ্যাতি জুন্টার অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে দিলেও স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। মস্কো থেকে ফিরে ভেলিজ জানতে পারলেন তাঁর এক কাকা নিখোঁজ। দুরুদুরু বুকে কাকার খোঁজ নিতে এস্তাদিও নাশিওনেলের গেটে হাজির হন ভেলিজ। চিলের প্রথম সারির ক্লাব কোলো কোলোর খেলোয়াড় হিসাবে ভেলিজ সুপরিচিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও স্টেডিয়ামের ভিতরে যাওয়ার সাহস জোটাতে পারেননি। গেটে পাহারায় থাকা পূর্বপরিচিত এক রক্ষী দয়াপরবশ হয়ে কাকার নাম জেনে পরেরদিন খবর দেন যে উনি বেঁচে আছেন। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ নভেম্বর – এই দেড় মাসে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ এস্তাদিও ন্যাশনালের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আতিথেয়তা ভোগ করেছিলেন।

তেমনই একজন অতিথি ছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার হুগো লেপে। খেলোয়াড়দের সুবিধার্থে একটা ইউনিয়ন গড়েছিলেন দিন বদলের স্বপ্ন দেখা হুগো। ফলে তাঁর জায়গা হয় স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে। সে খবর জানতে পেরে দলের অধিনায়ক ফ্রান্সিস্কো চামকো ভালদেজ দায়িত্ব নেন হুগোকে খুঁজে বের করার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভালদেজ পিনোশের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান এবং অনুরোধ করেন হুগোর মুক্তির জন্য। পিনোশে আশ্বাস দেন তিনি হুগোর মুক্তির ব্যবস্থা করবেন, যদি সে রাজনৈতিক কর্মী না হয়। বারবার এস্তাদিও নাশিওনালে ঘোরাঘুরি করে প্রায় দেড় মাসের চেষ্টায় ভালদেজ হুগোর সন্ধান পান এবং তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা হয়। এই চরম মানসিক উদ্বেগের মধ্যেও খেলোয়াড়রা মাঠের দ্বৈরথের মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ২০ তারিখ প্রায় মাঝরাতে ফ্লুস্কা খেলোয়াড়দের ডেকে জানালেন ম্যাচ হচ্ছে না। “ওরা আসবে না। আমরাই বিশ্বকাপ খেলব।” খেলোয়াড়দের মধ্যে চাপা উল্লাসের ঢেউ ওঠে। “তবে একটা শর্ত আছে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী তোমাদের মাঠে নামতে হবে, একটা গোলও করতে হবে।”

পরেরদিন এস্তাদিও নাশিওনালে যে সার্কাসটা হল তা যেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের বিখ্যাত ম্যাজিক রিয়ালিজম। নির্দিষ্ট সময়ে মাঠে পৌঁছে খেলোয়াড়রা দেখলেন একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচের মতই সন্তোষজনক আয়োজন। এমনকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ১৫,০০০ দর্শকও আছেন চিলে দলকে উৎসাহ দিতে। শুধু বিপক্ষ দলটাই অনুপস্থিত। জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল, রেফারি বাঁশি বাজিয়ে নির্দেশ দিলেন খেলা শুরুর। খেলোয়াড়রা ফাঁকা মাঠে নিজেদের মধ্যে চারটে পাস খেললেন, তারপর অধিনায়ক চামকো ভালদেজ ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দিলেন। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। স্টেডিয়ামের ইলেকট্রনিক বোর্ডে ফুটে উঠল “চিলের যৌবন এবং ফুটবল আজ ঐক্যবদ্ধ”। তার ঠিক নীচে খেলার ফলাফল: ১-০। খেলার নামে এই পরিহাসের শিকার ফুটবলার অনেক না মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

“মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে অভিনয় করছিলাম আমরা। সেদিন যা হয়েছিল তা খেলাধূলোর স্পিরিটের পরিপন্থী, সম্পূর্ণ অখেলোয়াড়োচিত,” বলেছিলেন এলিয়াস ফিগুয়েরো। “খেলা শুরুর আগে চারপাশে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিলাম কোথায় লুকিয়েছে মানুষগুলোকে। নিজেকে মনে হচ্ছিল নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্রীর নির্দেশে মঞ্চে দাঁড়ানো মূকাভিনয় করা ভাঁড়। মনের মধ্যে তোলপাড় চলছিল। ভাবছিলাম যদি এই মুহূর্তেই সাহস সঞ্চয় করে বিদ্রোহ করি তাহলে কী হাল হবে” বলেন লিওনার্দো ভেলিজ।

খেলোয়াড়দের মধ্যে বিষণ্ণতার ছায়া থাকলেও পিনোশে প্রশাসন ও তার মদতদাতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। ফুটবল নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না যে দেশের, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৩ নভেম্বরই এই খবর ছেপে দেয়। ‘Soviet Union kicked out of World Cup in soccer’ শিরোনামে বিশেষ সংবাদদাতা ভিক্তর লুসিনশি ফিফার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে দেড় কলমের প্রতিবেদন লেখেন। সেই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, এরপর সোভিয়েত ব্লকের অন্য তিন দেশ – পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড এবং বুলগেরিয়া যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে। শেষমেশ যদিও তা হয়নি। পূর্ব জার্মানির সরকার অবশ্য সরকারিভাবে সোভিয়েত মতামতকে সমর্থন জানায়। ঘটনাচক্রে পূর্ব জার্মানি আর চিলে বিশ্বকাপে একই গ্রুপে পড়ে। দেশজোড়া রক্তপাতের মধ্যে ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে চিলে দল রওনা দেয় পশ্চিম জার্মানির উদ্দেশে। রওনা হবার আগে পিনোশে খেলোয়াড়দের শুভেচ্ছা জানাতে আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রপতি ভবনে। দলের আর সকলে হাসিমুখে হাত মেলালেও কার্লোস কাজেলি পিনোশের সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকার করেন। সেই মুহূর্তে কোন প্রতিক্রিয়া না হলেও জার্মানি পৌঁছে কাজেলি এই স্পর্ধার ফল টের পান।

তথ্যসূত্র

(১) গারেথ থমাস, দ্য ফুটবল হিস্ট্রি বয়েজ, সেপ্টেম্বর ২০২১
(২) পিট স্পেন্সার, footballpink.net, ফেব্রুয়ারি ২০২২
(৩) উলফগ্যাং ক্রাউশার, ইউরোজিন, অগস্ট ২০০৮
(৪) ফিলিপ বেকার, insidethegames.biz, মার্চ ২০২২
(৫) রবি দেব, medium.com, এপ্রিল ২০১৪
(৬) তথ্যচিত্র দি অপোজিশন, প্রযোজক: ইএসপিএন

(পরবর্তী অংশ আগামীকাল)

প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.