চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা— হল চশমা। কেমন, হল তো?’

        চলতি টোকিও অলিম্পিকের উদ্বোধনী প্যারেডে ভারতের তিরন্দাজ দীপিকা কুমারীর নামবিভ্রাট এতক্ষণে সক্কলে জেনে গেছেন। ভুটানের জনৈকা তিরন্দাজ কার্মা-র ‘মোকাবিলা’য় দীপিকা কুমারী হয়ে উঠলেন ‘দীপা কার্মাকার’। এমন কর্ম কার? একটি আন্তর্জাতিক চ্যানলের। এবং এক ভারতীয় ধারাভাষ্যকারের।
        তিরন্দাজি এ-দেশে বাণিজ্যসফল আইটেম একেবারেই নয়। জিমন্যাস্টিক্স তো নয়ই। দীপার বিভাগ আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্স ব্যাপারটা কী, আমাদের কাছে বেশ অস্পষ্ট। এ-সবে টাকার স্রোতও বয় না। সুতরাং এ-দেশে এ-সব তেমন প্রচার পায় না।  যাদের নাম নিয়ে গোলমাল হল, তারা আবার প্রভাবশালী বলয়ের বাসিন্দে নন। দীপিকা ঝাড়খন্ডের মেয়ে, দীপা ত্রিপুরার। দু’ রাজ্যেই প্রভূত দারিদ্র্য। দু’জনেই অতীব সাধারণ ঘরের, নিম্নবিত্ত। আন্তর্জাতিক মানের তালিম নিতে গেলে খরচখরচা যথেষ্ট। ব্যয়বহুল উপকরণের অভাবে দীপিকা বাঁশের তির দিয়ে দিনের পর দিন প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছেন। আর দীপার রূপকথা তো সকলেরই জানা। সেই একই ‘রোগলক্ষণ’! ইট-কাঠের বিপজ্জনক পৈঠাতেই তার আবাল্য  অনুশীলন। সুতরাং তাদের নামের ককটেলীয় উপস্থাপন করাই যায়! দীপা অবশ্য ঈষৎ রসিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি এখনও অবধি আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সেই রয়েছেন!
          রেডিওতে ভাষ্যকারের কাজটা ছিল মাঠের পুরো অবস্থাটা শ্রোতাদের সামনে ছবির মতো তুলে ধরা— খেলার প্রতিটা মুভমেন্ট। টিভিতে আদ্ধেক কাজ কম। অনেক কিছু ফিলার ঢুকিয়ে দর্শকদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ থেকে যায়। রেডিওতে বেরী সর্বাধিকারী, পিয়ার্সন সুরিটা, অজয় বসু— এঁদের ভাষ্য তো ভোলার নয়। এঁরা বিষয়নির্ভর চর্চা করতেন নিরন্তর, সেইসঙ্গে ছিল নিজেদের জ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত করার সতত প্রচেষ্টা। অলিম্পিক্সের এখনকার ‘বাজারে’ ইতিহাসটাকে নিয়ে কোনও ঘাঁটাঘাঁটি দেখছেন? প্রাচীন গ্রিস, রোমান সাম্রাজ্য, অলিভ পাতা, অলিম্পিক্সের পুনরুত্থান এই আধুনিক যুগে, পিয়ের দ্য কুবারতেঁ— এ-জাতীয় চর্চা চারপাশে এখন হচ্ছে? হবেই বা কেন! গুগল-‘মামা’ আছেন, তেমন দরকার পড়লে জেনে নিলেই হল! মনে পড়ে যাচ্ছে, একসময়ে একটি বাংলা দৈনিকে আধ পৃষ্ঠাজোড়া ধারাবাহিকের জন্যে আমরা মুখিয়ে থাকতাম। অজয় বসু— ভাষ্যকার অজয় বসু, শিক্ষক অজয় বসু, ভাষাশিল্পী অজয় বসু আমাদের মতো বহু পাঠকের হৃদয়-পিঞ্জরে স্থাপন করে গেছেন অলিম্পিক-রূপকথার নায়কদের— জেসি ওয়েন্স, পাভো নুর্মি, এমিল জ্যাটোপেক, জনি ওয়েসম্যুলার,…। আমরা নতজানু ছাত্রের মতো পাঠ নিতাম খবরের কাগজে বা অন্যত্র।
        এবার একটু তিরকুটে কথা। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলজুড়ে সমৃদ্ধি-বলয় তৈরি হয়ে যায়। রাজধানীর ক্ষমতার অলিন্দে তখন বিভিন্ন প্রভাবশালী লবি ছড়ি ঘোরাচ্ছে। পঞ্জাব লবি, জাঠ লবি, মারাঠা লবি প্রভৃতি। দক্ষিণ ভারতের কট্টর হিন্দি-বিরোধী অবস্থানের ফলে তারাও দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয় না, উপরন্তু শীর্ষ আমলাদের একটা বড় অংশ দক্ষিণ ভারতের। শাঁসালো সব প্রকল্প, শিল্প, সেচ টেনে নিচ্ছে এই সমৃদ্ধি-বলয়। সেইসঙ্গে তখন ছিল ‘মাশুল সমীকরণ নীতি’। ফলে দেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ক্রমিক পশ্চাদপসরণ। সেই সর্বনাশা নীতির অভিশাপ আজও পূর্ব ও পূর্বোত্তর ভারতকে বহন করে যেতে হচ্ছে। সেই মহাভারতের আমল থেকে কেষ্টঠাকুরের রাজনীতির অনুক্রমে এই অঞ্চলকে ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে রাখার যে-আয়োজন চলে আসছে, আধুনিক কালের ইন্দ্রপ্রস্থেও সেই ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে তৎপরতার অভাব হয়নি। বাকি ভারতের অবচেতনে হয়তো ক্রিয়াশীল এই ব্যবস্থা।
       এত সব কথা অপ্রাসঙ্গিক নয়। রোম অলিম্পিকে (১৯৬০) মিলখা সিং চতুর্থ হয়েছিলেন। একচুলের জন্যে পদক পাননি। কিন্তু সে-দৌড় লোকগাথায় পরিণত হয়েছে। দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন মিলখা।  বিস্তর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে উপজীব্য করে  ফসল তোলে বলিউড। মিলখা হয়ে উঠেছেন রূপকথার নায়ক। বাকি জীবন এই চতুর্থ হওয়ার ডিভিডেন্ড পেয়েছেন। পাবেন না-ই বা কেন! ভাকরা-নাঙ্গালের পঞ্জাব, ‘সবুজ বিপ্লব’-এর পঞ্জাব, পঞ্চ নদের পঞ্জাব— এখানকার কোনও কৃতীর ন্যাশনাল হিরো হয়ে-ওঠার পথটা বেশ মসৃণ-ই। অন্য দিকে, পূর্বোত্তর ভারতের ত্রিপুরা। পিছিয়ে-থাকা রাজ্য ত্রিপুরা। আবাল্য অতি কঠিন লড়াইয়ে থাকা দীপা কর্মকার জিমনাস্টিক্সে অলিম্পিকে নামা প্রথম ভারতীয় মহিলা। ২০১৬-য় রিও-র আসরে ঝলমলে পারফরমেন্স সত্ত্বেও অল্পের জন্য চতুর্থ হওয়াটা আমাদের স্মৃতিতে এখনও রঙিন। বিপজ্জনক প্রদুনোভা ভল্টের সেই শিল্পসৌকর্য! তো, ‘চতুর্থ’ দীপা কর্মকার নাকি তার নিজের রাস্তা ছেড়ে তিরন্দাজি ধরেছেন! অন্যের ঘাড়ে তার নাম চাপানো হচ্ছে। এলেবেলে আর কাকে বলে!
ঐক্যের মধ্যে কত যে বৈচিত্র্য!

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.