~ রাজদীপ বিশ্বাস ~
-“চট্টগ্রামের বিপ্লবী কল্পনা দত্ত” আর “কমিউনিস্ট কল্পনা দত্ত যোশী” — এই দুটি সম্বোধনের মধ্যে কোনটা আপনি বেশী পছন্দ করেন?
– এ প্রশ্নের কী উত্তর দেব? আমি কিন্তু কখনো নেতা হইনি, আমি সবসময়ই একজন সাধারণ কর্মী। দুটো সম্বোধনই তো ভাল লাগছে! আচ্ছা এরকম বললে হয় না — চট্টগ্রামের কল্পনা দত্ত সে আবার কমিউনিস্ট পার্টিরও মেম্বার। কিন্তু একটা কথা। আমাকে দেবতা বানিয়ে ফেললেই আমি পালাই। আমারও অনেক শর্টকামিংস আছে।”
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
জীবন সায়াহ্নে উপনীত কল্পনা দত্তের এক সাক্ষাৎকার পড়তে পড়তে চোখ আটকে গিয়েছিল উপরের লাইনগুলোয়। অসমসাহসী কল্পনা দত্ত, যাঁর একমাত্র তুলনা তিনি নিজেই, কি বিনম্র! কি সংযত! কি আত্মপ্রসাদবিহীন! অবশ্য তিনি বরাবরই ব্যতিক্রমী। না হলে রায়বাহাদুর ডক্টর দুর্গাদাস দত্তগুপ্তের আদরের নাতনি যে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এত বড় বিদ্রোহিণী হয়ে উঠবেন, একথা সম্ভবত কেউ স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেননি। কল্পনা ঝড় ভালবাসতেন। ঝড় উঠলেই ছোট্ট কল্পনা ছুট্টে বেরিয়ে পড়তেন বাড়ির বাইরে। দোল খেতেন গাছের ডালে বসে।
গহিরা গ্রামে অসম সংঘর্ষের পর কল্পনা যখন ধরা পড়লেন, পল্টনের সুবেদার প্রচন্ড একটি থাপ্পড় মেরেছিল তাঁকে। সম্ভবত কেবল বিপ্লবী বলেই নয়, মেয়ে বলেও। একজন নারীর পিস্তল এক পাল পুরুষ পুলিশ ও মিলিটারি সিংহকে অমন ভাবে নাকাল করেছিল, সেই ক্ষোভেই হয়ত। কিন্তু সুবেদারের চড়ের ফল হয়েছিল অন্যরকম। পাঞ্জাবি সৈন্যরা সবাই এক যোগে তেড়ে এসেছিলেন সুবেদারের দিকে। সুবেদারকে হুমকি দিয়েছিলেন “মেয়েটিকে আর একবার যদি মারো তো তোমাকে দেখে নেব আমরা”। বন্দিনী কল্পনার হাত বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় পল্টনের অধিকর্তা মেজর কিং কল্পনাকে বলেছিলেন “আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি। তোমার হাতের চুড়িটা আমাকে দেবে? আমি বউকে ওটা উপহার পাঠাব।” বন্দিনী কল্পনা উত্তর দিয়েছিলেন “জোর করে খুলে নাও তো আলাদা কথা। কিন্তু আমি নিজে থেকে কিছুতেই দেব না।” মেজর কিংয়ের অবশ্য সাহস হয়নি জোর করে কল্পনার হাত থেকে চুড়ি খুলতে যাওয়ার।
কল্পনার বিপ্লবী যাত্রা খুব একটা মসৃণ ছিল না। বিপ্লবী জীবনের অনিবার্য ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ছাড়াও তাঁকে সম্মুখীন হতে হয়েছিল নারীর সাহচর্য সম্পর্কে সে সময়ের বিপ্লবীদের অস্বাচ্ছন্দ্যেরও। বেথুন কলেজে পড়াকালীন কল্পনার পরিচয় হয়েছিল পূর্ণেন্দু দস্তিদারদের সাথে। কল্পনা তাঁদের বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু পূর্ণেন্দু দস্তিদারদের কাছে কল্পনার গুরুত্ব কমরেড বা সহযোদ্ধা হিসাবে যত না ছিল, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব ছিল কল্পনার রায়বাহাদুরের নাতনি পরিচিয়টির। রায়বাহাদুরের বাড়ির মেয়ে হওয়ার ফলে তার ঘর অস্ত্রশস্ত্র, গোপন দলিল রাখার পক্ষে আদর্শ জায়গা। সহজে কেউ সন্দেহ করবে না।
অবশ্য পরবর্তীকালে কল্পনা হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের বিপ্লবী দলের প্রথম সারির কর্মী। নিজগুণেই। মেয়েরা আর্মি রিভলভার চালাতে পারবে কিনা এবং বিপ্লবী জীবনের নিয়ত কষ্ট, অব্যবস্থায় মেয়েরা মানিয়ে চলতে পারবে কিনা — এই দুই প্রশ্নেরই সুস্পষ্ট উত্তর কল্পনা তার অভিজ্ঞা দিয়ে হ্যাঁ বাচকে পরিণত করেছিলেন। বাড়ি ছাড়ার পর মাস্টারদার দেওয়া তিনটি রিভলভারের মধ্যে থেকে কল্পনা বেছে নিয়েছিলেন একটি আর্মি রিভলভার। কল্পনাকে আর্মি রিভলভার চালানোর কৌশল ও কাঠিন্য সম্পর্কে অবহিত করে মাস্টারদা বলেছিলেন, এই রিভলভার আয়ত্তে আনতে হলে অধ্যবসায় চাই। কল্পনা হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, অধ্যবসায়ের ত্রুটি হবে না। হয়ওনি। বিপ্লবী জীবনের কষ্ট সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করে মাস্টারদা বলেছিলেন যেখানে যেখানে তাঁরা আশ্রয় পাবেন সেখানে সেখানে কিন্তু আশ্রয়দাতারা যা দেবেন তাই খেতে হবে মুখ বুজে। মাস্টারদাদের মত কষ্টসহিষ্ণু যে মেয়েরাও হতে পারেন, কল্পনা তা অচিরেই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন চা পাতার চচ্চড়ি খেয়ে। হয়েছিল কী, সেবার কল্পনারা যাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁর ধারণা ছিল বিপ্লবীরা চা নামক বস্তুটির খুব ভক্ত। তাই তিনি শহর থেকে বিশেষ করে চা পাতা আনিয়ে সেই চা পাতা রান্না করেছিলেন শাক চচ্চড়ির মত করে। এবং যেহেতু যা দেওয়া হবে তাই খেতে হবে মুখ বুজে এমনই ছিল অলিখিত নিয়ম, কল্পনাও বাকিদের সাথে মুখ বুজে খেয়েছিলেন সেই অপূর্ব বস্তুটি।
কারামুক্তির পর কল্পনা যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। সেখানেও দক্ষ সংগঠক হিসাবে, একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে অচিরেই নিজের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় কমিউনিস্ট পার্টির কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামে যে নিবিড় কাজ করেছিলেন তার ফলে তাঁর নিজের এবং পার্টির জনপ্রিয়তা কতদূর বেড়েছিল, তা বোঝায় যায় এই ঘটনা থেকে যে ১৯৪৬-এর নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রামের প্রার্থী কল্পনা দত্তকে হারাতে প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে বক্তা হিসেবে আনতে হয়েছি খোদ জওহরলাল নেহরুকে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অসূয়া সত্ত্বেও নেহরুকে তাঁর বক্তৃতায় কল্পনা প্রসঙ্গে ব্যবহার করতে হয়েছিল “বাহাদুর লড়কি” বিশেষণটি।
রবীন্দ্রনাথের অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তের আজ জন্মদিবস। মাঝেমাঝে মনে হয় তিনি জীবিত থাকলে আজকের বিজেপি শাসিত ভারতে তাঁর কেমন লাগত? বিজেপি শাসিত ভারতেরই বা এমন বিদ্রোহিণীকে কেমন লাগত? ইউএপিএ আইনে কারারুদ্ধ করা হত কি তাঁকে? অথবা তাঁকেও কি বলা হত দেশদ্রোহী, আজাদি গ্যাং? কী প্রতিক্রিয়া হত কল্পনার, যখন তিনি শুনতেন দিলীপ ঘোষ, মোহন ভাগবতরা বলছে নারীর স্থান গৃহাভ্যন্তরে এবং নারীর হাফ প্যান্ট পরা, শার্ট প্যান্ট পরা ভারতীয় সংস্কৃতি নয়! কল্পনা কি হেসে ফেলতেন, না বিরক্ত হতেন? কারণ পাহাড়তলিতে গোপন অভিযানের সময় তিনি, বা ইউরোপিয়ান ক্লাব অভিযানের সময় প্রীতিলতা তো পরেছিলেন শার্ট প্যান্টই।
লেখক বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী
কল্পনা দত্ত, সূর্য সেন ও চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের অন্যান্য বিপ্লবীরা – ছবি Wikipedia থেকে।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।