১৮৯০ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিৎপুরের ক্যালকাটা স্কুল অফ আর্টে ভর্তি হয়ে সেখানকার ইউরোপিয় শিল্পীদের থেকে অয়েল প্যাস্টেলে ও তেলরঙে আঁকা শিখতে শুরু করেন। এই প্রতিষ্ঠানই পরে গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটে পরিণত হয় এবং পার্ক স্ট্রিটে ভারতীয় জাদুঘরের পাশে স্থানান্তরিত হয়। শিল্পে অবনীন্দ্রনাথের অবদান ফিরে দেখা এবং আজকের দিনে তার প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করার প্রয়োজন বহুমুখী, কারণ অবনীন্দ্রনাথ যে যুগে কাজ করেছেন, সেই যুগের সাথে আমাদের সময়ের সাদৃশ্য নেহাত কম নয়।

সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন দেখে নিই, ১৮৯০-১৯০০ সালে কী কী ঘটছিল অবনীন্দ্রনাথের শিল্পী হয়ে ওঠার সময়। আলোচনাক্রমে আমরা আরেকটু পিছনেও যাব।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০৮ সালে ভারতে আসে এবং এক অঙ্কনশৈলীর প্রচলন করে, যার নাম কোম্পানি স্কুল অফ পেন্টিং। থমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েলের মত ব্রিটিশ শিল্পীরা সারা ভারত ঘুরে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি আঁকতেন এবং ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপিয় পৃষ্ঠপোষকদের তুষ্ট করার জন্য ভারতীয় শিল্পীদেরও ওভাবে আঁকতে শেখাতেন। এইসব ছবি মূলত তথ্য সরবরাহের কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, লখনৌয়ে অধিষ্ঠিত ফরাসি মেজর জেনারেল ক্লড মার্টিন ৬৫৮ খানা পাখির ছবির বরাত দিয়েছিলেন। এই ছবিগুলোকে এখন শিল্পীরা মনে করে ভারতীয় উপমহাদেশের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলোর “দলিল মাত্র”। অর্থাৎ ল্যান্ডস্কেপ, ফ্লোরা ও ফনা, দেশিয় পোশাক পরা ভারতের কালোকোলো নারী-পুরুষ মাটির পাত্র তৈরি করছে, চাষ করছে আর ব্রিটিশদের সেবা করছে — এইরকম কাজকর্মের ছবি। এগুলো প্রকৃতপক্ষে ইউরোপিয় পর্যটকদের স্মারক হিসাবে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য কাগজে আঁকা ‘ফোটোগ্রাফ’।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কিন্তু একথা ভাবলে ভুল হবে যে একটা নতুন দেশে গিয়ে পর্যটক উপনিবেশবাদীদের পক্ষে এরকম বিষয়বস্তু বেছে নেওয়াই স্বাভাবিক। ওই যুগে ইউরোপে যে শিল্প তৈরি হচ্ছিল তা-ও একইরকম ছিল। ১৩৪৬-১৩৫৩ সালে হওয়া ব্ল্যাক প্লেগের পর থেকে রেনেসাঁর ফলে ইউরোপ নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। ব্ল্যাক প্লেগের সময়কার বিপুল সংখ্যক মৃত্যু ক্যাথলিক চার্চ প্রচারিত ধর্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়। মানুষ বুঝতে পারে বাঁচানোর জন্য কোনো দেবতা কোথাও নেই। কেবলমাত্র যুক্তি আর বিচারবুদ্ধি দিয়েই জীবনযাপন সম্ভব। ফলে পৃথিবীর বুকে জীবনের অস্বিত্বকে বোঝার জন্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা হয়। শিল্পীরাও দেবদূত ও দৈত্যদের সম্বন্ধে কল্পনা করা ত্যাগ করেন এবং চারপাশের জীবনকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ব্যবচ্ছেদ করা অ্যানাটমিকাল স্কেচ, এরিয়াল পারস্পেকটিভের ধারণা (অর্থাৎ দূরের জিনিস আকারে ছোট দেখায়), ডেপথ অফ ফিল্ড সহ একটা ল্যান্ডস্কেপে ক্রস সেটে যীশুর রক্তমাংসের মানুষের মত চেহারা — এগুলোই ছিল মাটির পৃথিবীর পরিপার্শ্বে শিল্পীদের আগ্রহ উন্মেষের প্রাথমিক লক্ষণ। ওইসব ছবির জগত মূর্ত জিনিসপত্রের জগত। ক্রমশ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির এই সন্ধান থেকে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের নেদারল্যান্ডসে শুরু হল স্টিল লাইফ স্টাডি (অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক জিনিসকে দ্বিমাত্রিক ছবিতে ধরে রাখা), ১৮০০-১৮৫০ সালের রোম্যান্টিসিজমের সময়ে এল — নেচারস্কেপ স্টাডি (স্থল, জল ও পরিবেশের ছবি) এবং ১৮৭০- ১৮৮০-র দশকে ইম্প্রেশনিজমের যুগে প্যারিসের ব্যস্ত নগরজীবনের স্টাডি (একটা মুহূর্তকে ক্যানভাসে ধরে রাখা)। এরকম সময়েই অবনীন্দ্রনাথ কলকাতায় আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।

অবনীন্দ্রনাথ যে প্রতিষ্ঠানে ছাত্র হিসাবে যোগ দিলেন, তা তৈরি হয়েছিল শিক্ষার্থীদের বাণিজ্যিক শিল্পে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য, যাতে তারা ক্রাফটসম্যান, ক্লেরিকাল কার্টোগ্রাফার এবং কোম্পানি স্কুলের আঁকিয়ে হিসাবে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এই আশ্চর্য উপনিবেশের জীবনযাত্রার ছবি নথিবদ্ধ করে রাখতে পারে। ১৯০৫ সালে অবনীন্দ্রনাথ নিজে এই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ হওয়ার আগে পর্যন্ত সবসময় প্রধান পদেও একজন ইউরোপিয়ই থাকতেন।

এবার ইউরোপিয়দের আগমনের আগেকার ভারতীয় শিল্প সম্বন্ধে আলোচনা করে নেওয়া যাক। ভারতীয় শিল্প বরাবরই যথেষ্ট বাস্তবধর্মী (realistic) ছিল, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে তার সাথে মিশে ছিল আধ্যাত্মিকতা (spiritualism) এবং প্রতীকি ভাবনা (symbolism)। হরপ্পার প্রিস্ট কিং-এর মূর্তি (২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), মৌর্য যুগের দিদারগঞ্জ যক্ষী (তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং উপবিষ্ট সারনাথ বুদ্ধ (৪৭৫ খ্রিস্টাব্দ) — প্রত্যেকটাই ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের যেমন শারীরিক গঠন দেখা যায় তার অনুসারী, আবার শৈলীর দিক থেকে এগুলো একইসঙ্গে সরল এবং পৌরাণিক প্রতীকি ভাবনায় পুষ্ট। এমনকি অজন্তার গুহাচিত্রে (দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দ) এবং ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের দক্ষিণ ভারতের নটরাজ ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের উপর্যুক্ত গুণাবলী এক কাব্যিক অতীন্দ্রিয়তায় উত্তীর্ণ হয়। আশ্চর্যের কথা, এই একই নন্দনতত্ত্ব বিরাট ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরে, মধ্যে এবং দক্ষিণে পাওয়া যায়। এর একটা ব্যাখ্যা এই হতে পারে, যে ভারতে চিত্রকলা আর ভাস্কর্য চিরকালই নাটক, নৃত্য এবং সঙ্গীতের সাথে রসধ্বনি ও অলঙ্কার — এই তিনটে সূক্ষ্ম ধারণার মাধ্যমে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল। বহুকাল ধরে এর কোনো হেরফের হয়নি। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের মুদ্রাগুলো মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যে খোদাই করা হয়েছে, আবার মন্দিরের ভাস্কর্যের ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা ধ্রুপদী নাটকে দেখা যায় এবং চারুকলায় ব্যবহৃত প্রতীকি ভাবনার প্রতিধ্বনি ধ্রুপদী কাব্যেও পাওয়া যায়। এই ভিন্ন ভিন্ন শিল্পকে আরও বেশি করে এক অভিন্ন বাঁধনে বেঁধে দিয়েছে প্রেম, ভক্তি ও মোক্ষের দর্শন। এই ধারণাগুলোকে বস্তুজগতের সীমায় বেঁধে ফেলা কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা, যে সূত্র ধ্রুপদী ভারতীয় শিল্পের সমস্ত প্রকারকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে তা হল আখ্যানধর্মিতা (narrativity)।

ভারত চিরকালই গল্পের দেশ, সক্রিয়ভাবে গল্প বলার দেশ। মনে করা হয় রামায়ণ, মহাভারত লেখা হয়েছিল ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। মহাভারতের কৃষ্ণের চরিত্রের কিংবদন্তী পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের ভক্তি আন্দোলনের ফলে আরও বেশি পল্লবিত হয়। ফলে ইউরোপিয়দের আগমনের আগে মোগল ও রাজপুতদের রাজসভার শিল্পীরা রাধাকৃষ্ণের মিনিয়েচার আঁকছিলেন, তাঁদের প্রেমের গান গাইছিলেন পশ্চিম ভারতে মীরাবাঈ এবং পূর্ব ভারতে শ্রীচৈতন্য। এই গানগুলো প্রকৃতপক্ষে ছোট ছোট গল্প। হিন্দু সংস্কৃতির সাথে পরিচিত যে কোনো মানুষই জানেন, যে এই গল্পগুলো আবার ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে এক প্রকার সংলাপ। একইভাবে অজন্তার গুহাচিত্র বুদ্ধের জীবনের গল্প বলে এবং দক্ষিণ ভারতের ব্রোঞ্জের নটরাজ হল মহাজাগতিক নর্তক হিসাবে শিবের বিমূর্ত গুণগুলোর আখ্যান।

আশা করি এই ইতিহাস ইউরোপিয়দের আগমনের আগে পর্যন্ত প্রচলিত ভারতীয় শিল্পের আত্মা এবং পরিচয়ের যথার্থ ব্যাখ্যা করতে পেরেছে। একথা স্পষ্ট ছিল যে ইউরোপিয় শিল্পের নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের সঙ্গে ভারতীয় শিল্পীরা নিজেদের দার্শনিকভাবে মেলাতে পারতেন না। হিন্দু দর্শন অস্তিত্বের বহুবিধ প্রকাশে বিশ্বাসী। একটা বই কেবলমাত্র একটা ত্রিমাত্রিক বস্তু নয়। তা প্রতীক হিসাবে জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকে মনে করায়। কাগজ হওয়ার আগে বইটা ছিল একটা গাছের পাতা, এবং পুড়ে গেলে ভস্মে পরিণত হতে পারে। যে কোন চেহারাতেই বইটা পঞ্চভূতের প্রকাশ। বইটা একইসঙ্গে বস্তু (কাগজ ও কালি) এবং বস্তুরও অতীত (জ্ঞান)। শিল্পের শিক্ষার্থীদের প্রবণতা অনুযায়ী যে শিল্পী স্রেফ একটা কাপড়ের প্রেক্ষাপটে বইটাকে একটা টেবিলের উপর রাখেন আর একটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় আলোকিত করেন, তিনি লক্ষ করেন আলো কীভাবে বইটার তিন দিকে পড়ছে এবং কীভাবে কাপড়টা বইয়ের ভারে মুড়ে যাচ্ছে, কুঁচকে যাচ্ছে। তিনি শুধুমাত্র বইটার বাহ্যিক বস্তুত্বকে চিনতে পারেন, কিন্তু তার বস্তুর অতীত প্রতীকি অস্তিত্বকে বুঝতে পারেন না। এমন একটা স্টিল লাইফ স্টাডি কোন আখ্যান বর্ণনা করে?

হয়ত এই প্রশ্নগুলোই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে ক্যালকাটা স্কুল অফ আর্টসের পাঠক্রম সম্বন্ধে অতৃপ্তির বীজ বপন করেছিল। ফলে তিনি পাঠক্রম বদলাতে সক্রিয় উদ্যোগ নেন, প্রাথমিকভাবে ভারতীয় শিল্পের শিকড়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর্ট কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ ই বি হ্যাভেল এই সংস্কার সমর্থন করেন, কারণ ঠিক সেইসময় পাশ্চাত্যে হিন্দু দর্শনের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছিল (১৮৯৩ সালে শিকাগোর ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা যার দৃষ্টান্ত)। বিবেকানন্দের সাথে পরিচয়ের সুবাদে জাপানি শিল্প বিশারদ ওকাকুরো কাকুজো ভারতে আসেন এবং পরে তাঁর দুই ছাত্র, ইয়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসো, ঠাকুর পরিবারের আমন্ত্রণে এ দেশে আসেন। তাঁদের কাছ থেকে অবনীন্দ্রনাথ জলরঙের “ওয়াশ” কৌশল শেখেন, এবং ইউরোপিয় তেলরং পরিত্যাগ করে পরবর্তী ছবিগুলো তিনি “ওয়াশ” পদ্ধতিতে আঁকেন।

দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দের অজন্তার গুহা থেকে ফিগার আঁকার যে শিল্পধারা চলে আসছিল, ইউরোপিয়দের আগমনে শৈলীর দিক থেকে তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি, কারণ কোম্পানি স্কুল অফ পেন্টিং অনুযায়ী আঁকতে ওই ধারা কাজে লাগছিল। অবনীন্দ্রনাথ সহজেই সেই ধারাকে বেঙ্গল স্কুল অফ পেন্টিংয়ে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তাঁর ছবিতে আমরা একেবারে অজন্তার গুহাচিত্রের কাব্যিক সরলতাই দেখতে পাই, যা রাজপুত ও মোগল মিনিয়েচারও দেখা যায়। এক্ষেত্রে অবনীন্দ্রনাথের নিজস্ব অবদান হল ইউরোপিয়দের জন্য সহজ দলিল তৈরি না করে বরং ভারতীয় দর্শকদের জন্য তাদের পরিচিত বিষয়বস্তুকে ফিরিয়ে আনা।

প্রথমত, অবনীন্দ্রনাথ আঁকা ছবির মধ্যে আবার গল্প নিয়ে এলেন। তাঁর বিখ্যাত ছবি ভারতমাতা (১৯০৫ সালে আঁকা, যে বছর কলকাতায় স্বদেশি আন্দোলন আরম্ভ হয়) হল এক স্বাধীন ভারতের জাতীয় পরিচয়কে দেবত্বদান। সাধারণভাবে এই ছবির সাথে নটরাজের মূর্তির কোনো তফাত নেই। দুটোই বিমূর্ত ধারণার প্রকাশ। স্বাধীন ভারতের আত্মা একজন দেবীর মত (চারটে হাত, পদ্মের উপর দণ্ডায়মান), স্বয়ংসম্পূর্ণ (কালী ও দুর্গার অস্ত্রের বদলে ভারতমাতার চার হাতে আছে একটুকরো কাপড়, পুঁথি, রুদ্রাক্ষের মালা এবং খাদ্যশস্য — স্বদেশি আন্দোলনের প্রতীক) এবং তিনি এমন এক প্রেক্ষাপটে হাওয়ায় ভেসে আছেন যা পাশ্চাত্যের এরিয়াল পারস্পেকটিভের সংজ্ঞা দিয়ে বোধগম্য হয় না। বরং অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে ঈশ্বরের যে একত্বের কথা বলা আছে, এই ছবি সেই ধারণার অনেক কাছাকাছি (ভারতমাতা জল, স্থল এবং আকাশ জুড়ে আছেন)। ভারতে যে বস্তুগত কৃষিসম্পদ এবং বস্তুর অতীত আধ্যাত্মিক সম্পদ পাওয়া যায়, ভারতমাতা তার মূর্ত প্রতীক। এই রূপ নতুন ভারতের অযুত সম্ভাবনারও প্রতীক। ভারতমাতার হাতের পুঁথিগুলোও ঔপনিবেশিক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রতীক, মন থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ দূর করার প্রতীক। অবনীন্দ্রনাথ ক্যালকাটা স্কুল অফ আর্টের পাঠক্রম সংস্কারের মাধ্যমেও ঠিক এই কাজটাই করার চেষ্টা করছিলেন।

তাঁর আরেকটা অসাধারণ ছবির নাম গণেশ জননী (১৯০৮)। এই ছবি দেখামাত্রই পাশ্চাত্য চার্চ পেন্টিংয়ের অঙ্গ যীশু আর মাতা মেরির ছবিগুলো মনে পড়তে পারে। কিন্তু এই ছবির দুষ্টুমি (পার্বতী গণেশকে গাছের একটা ডালের কাছে তুলে ধরেছেন, যাতে গণেশ ফল পেড়ে পার্বতীর কোঁচড়ে ফেলতে পারেন) যতটা ক্রুশবিদ্ধ যীশু বা নেটিভিটি দৃশ্যগুলোর ছবিকে মনে করায়, তার চেয়ে বেশি মনে করায় যমুনা তীরে কৃষ্ণের গোপীদের পোশাক লুকিয়ে রাখার ছবিগুলোকে। কোনো হিন্দু পুরাণে পার্বতী আর গণেশের ফল পাড়ার আখ্যান পাওয়া যায় না। তবু এই ছবি এমন একটা মজার গল্প বলে, যা সব দুষ্টু ছেলের নিজের গল্প। এই ছবির আকাশ, পাহাড় এবং গাছের উৎস পাওয়া যাবে জাপানি উডকাট প্রিন্টে, পিছনের পাথর এসেছে ফারসি মিনিয়েচার ও চাইনিজ স্ক্রোল পেন্টিং থেকে, পার্বতীর পরনের লম্বা পোশাক ও চাদর মোগলদের পোশাকের মত আর যে লাবণ্যময় এবং সাবলীল ভঙ্গিমায় পার্বতী নাদুস নুদুস গণেশকে এক হাতে তুলে ধরে আছেন, তা ধ্রুপদী ভারতীয় মূর্তি নির্মাণশিল্পে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই সমন্বয়বাদের মধ্যে দিয়েই অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ছবিগুলোতে ভারতবর্ষ অতিক্রম করে পুরো প্রাচ্যের ঐতিহ্যকে এক নতুন প্যান-এশিয়ানিজমে প্রতিষ্ঠা করেন।

অবনীন্দ্রনাথের যুগ স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্থান পর্ব। বর্তমান সময়ের টানাপোড়েনও সেই সময়ের থেকে খুব ভিন্ন নয়। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারী এবং সার্ভেল্যান্স অর্থনীতির যুগে গণতন্ত্রের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এক সাংস্কৃতিক জাগরণ দাবি করছে। সমসাময়িক শিল্পীরা এখন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে নিজেদের কাজ দেখান, ফলে আন্তর্জাতিক রুচির কথা মাথায় রাখতে হয়। এই মুহূর্তের উত্তরাধুনিক ভারতীয় শিল্প ভারতীয় দর্শকের থেকে বহু দূরে সরে গেছে এবং দুর্বোধ্যও হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নিজেদের কাজের ভারতীয়ত্ব তাঁদের খুঁজে পেতেই হবে। অবনীন্দ্রনাথের থেকে যা শেখার, তা হল অন্ধের মত এগিয়ে যাওয়ার বদলে একটু পিছিয়ে আসা; পাশ্চাত্যের আধিপত্যকে প্রশ্ন করতে পারার সাহস রাখা এবং কয়েক হাজার বছর ধরে মিশ্র সভ্যতা হওয়ার ফলে আমরা যে দক্ষতাগুলো অর্জন করেছি, সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে এই কঠিন সময়ে এক নতুন পরিচয় তৈরি করা।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর শিল্পকীর্তি – ছবি Wikipedia থেকে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.