একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। চূড়ান্ত অসংবেদনশীল দুটো সরকার দিল্লি আর কলকাতায় বসে রয়েছে। থিয়েটার কর্মীদের অবস্থা, বিশেষ করে টেকনিশিয়ানদের অবস্থা শোচনীয় বললেও কম বলা হয়। যাঁরা আলোকশিল্পী, যাঁরা মঞ্চসজ্জার কাজ করেন, তাঁদের অবস্থা ভীষণ খারাপ। সরকার, নাট্য অ্যাকাডেমি কারও কোনো হেলদোল নেই। সবার চোখের সামনে থিয়েটার কর্মীদের পেটে লাথি মারা হচ্ছে। সিনেমা হল খুলছে, শপিং মল খুলছে, অথচ থিয়েটার বন্ধ। ভাবতে লজ্জা হয়, এই রাজ্যের সরকারের দায়িত্বশীল পদে এমন একজন আছেন, যিনি নাকি বিশিষ্ট নাট্যকার। তিনি তো এর দায় এড়াতে পারেন না। তিনিও এই কুৎসিত, অমানবিক, হৃদয়হীন কাজকর্মের শরিক। থিয়েটার কর্মীদের পেটে তাঁর লাথিও পড়ছে।
থিয়েটারের কাজ নিয়ে একটা মোটা দাগের বিভাজন রেখা রয়েছে। একদল আমরা, যারা ‘আর্টিস্টিক’ কাজ করি, নির্দেশক হই, অভিনয় বা গান করি, তারা। অন্য দল টেকনিক্যাল কাজ করে। এই বিভাজনটা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার৷ আমাদের মতো লোকজন, বিশেষ করে যারা একটু পরিচিত মুখ, তাদের যা হোক করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু টেকনিশিয়ানরা খেতে পাচ্ছেন না। অথচ, কলকাতার থিয়েটার বৃত্তে যারা কাজ করি, তাদের মধ্যে পরিচালক বা অভিনেতাদের দক্ষতা নিয়ে মতামতের ভিন্নতা থাকতে পারে। কারো মনে হতে পারে একজন অভিনেতা বা পরিচালক দুরন্ত কাজ করছেন, কারো মনে হতে পারে উনি একেবারেই পাতে দেওয়ার মতো নন। কিন্তু কলকাতার টেকনিশিয়ানদের দক্ষতা নিয়ে কোনো কথাই যথেষ্ট নয়। তাঁরা বিশ্বমানের কাজ করেন। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, কেবল জাতীয় স্তরে নয়, গোটা বিশ্বেই এই রকম দুর্ধর্ষ প্রতিভাবান টেকনিশিয়ান বিরল।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
হবে না-ই বা কেন? এখানে আলোর কাজ শুরু হয়েছে তাপস সেন, সতু সেনের হাত ধরে। সম্প্রতি দীপকবাবু মারা গেলেন। এই মানুষগুলোর কোনো তুলনা হয়? কলকাতায় যাঁরা আলো ঝোলান, ‘রিগার’-এর কাজ করেন, তাঁদের কোনো জবাব নেই। এবং এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এই মানুষগুলোর আর কিছু করার ছিল না বলে থিয়েটার করতে এসেছেন। অনেককিছুই করতে পারতেন। কিন্তু থিয়েটারকে ভালবেসে গোটা জীবনটা মঞ্চকে দিয়েছেন তাঁরা। একটানা লকডাউনের জেরে এখন কার্যত খেতে পাচ্ছেন না।
একটি ছেলের কথা বলি। আমার চেয়ে সামান্য ছোটই হবে বয়সে। নাম রঞ্জিত। বহুদিনের বন্ধু আমরা। আমি তো বেশ কম বয়সে কলকাতার মঞ্চে থিয়েটার করতে শুরু করেছি, ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কাজ করছি, তখন থেকেই রঞ্জিতকে দেখছি। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘রিগার’ হল রঞ্জিত। একদম উপরে উঠে বারে, ওভারহেড লাইনে আলোর কাজ করা, যাকে প্যাচলাইন করা বলে, এসব ওর মুখস্থ। কলকাতার সব হল তো বটেই, এমনকি দিল্লির কামানি অডিটোরিয়াম বা অন্য জাতীয় স্তরের কাজ হয় এমন সব হল ওর হাতের তালুর মতো চেনা। এই রকম টেকনিশিয়ান হাজারে একজন হয়। সেই ছেলেটি এখন একটি বহুতলে ঝাড়ুদারের কাজ করছে৷ আমরা যা পেরেছি সাধ্যমত সাহায্য করেছি। কিন্তু সে আর কতটুকু? সরকার তো বিন্দুমাত্র সাহায্য করছে না। নাট্য অ্যাকাডেমিও না।
রঞ্জিতের মতো অসংখ্য টেকনিশিয়ানদের জন্য কোনো সাহায্য-সহযোগিতা নেই। দিনমজুরের মতো কাজ করতে হয়। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ৩০০, ২০০ বা ৫০০ টাকা পান। থিয়েটার দলগুলো তো খুব বেশি অর্থ দিতে পারে না। যাতায়াতের জন্য যদি ১০০ টাকা দেওয়া হয়, এই মানুষগুলো তার থেকে ৫০ টাকা বাঁচাতে চেষ্টা করেন। ওইটুকু টাকা থেকে বই কেনার চেষ্টা করেন। থিয়েটার নিয়ে আরো জানতে, শিক্ষিত হতে চেষ্টা করেন। আমি এই মানুষগুলিকে খুব কাছ থেকে চিনি, নিবিড়ভাবে জানি। কারণ, আমিও খুঁটে খাওয়া লোক।
আমরা অনেকগুলো ছোট ছোট ফোরাম এইরকম শিল্পীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। দেশের আলি নামে এক শিল্পীকে আমাদের সাধ্যমত সামান্য সাহায্য করে আমরা শুরু করি। উনি সুন্দরবনের একদম প্রত্যন্ত এলাকায় থাকেন। বয়সের তো নথিপত্র নেই, তবে লোকমুখে শোনা যায় ওঁর বয়স এখন ১০৬ বছর। ‘বনবিবির পালা’ ধারার প্রবীণতম শিল্পী উনি। কিন্তু কথা হল, এগুলো তো আমাদের করার কথা নয়, সরকারের করার কথা। আমাদের সাধ্যই বা কতটুকু? কিন্তু সরকার ঠিক কী করছে?
থিয়েটারের জন্য তৃণমূল সরকার দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে। একদিকে সীমাহীন বঞ্চনা, অবহেলা, দলবাজি; অন্যদিকে মিথ্যাচার আর চাটুকারবৃত্তির ককটেল। একটা উদাহরণ দিই, তাহলে সবটা স্পষ্ট হবে। গত বছর, ২০২০ সালে বেশ কিছু দলকে ৫০,০০০ টাকা করে দেওয়া হল। বলা বাহুল্য, যারা টাকাটা পেল, তারা প্রায় সবাই দলবাজি করেই পেল। এরা প্রচার করতে শুরু করল, লকডাউনে আর্থিক অনটনে থাকা থিয়েটার কর্মীদের জন্য এটা নাকি মমতা ব্যানার্জির মহানুভবতা। তিনি নাকি গরীব শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতেই এই সাহায্য করলেন। এক্কেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। এই গ্রান্টের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। লকডাউন, করোনা কিছুই তখন ছিল না। সেই অনুদানকে ‘লকডাউনের ত্রাণ’ হিসেবে দেখানো হল। এই হল তৃণমূলী রাজনীতি। পাতি মিথ্যাচার ছাড়া আর কিচ্ছু নেই এতে।
একটু নাট্য অ্যাকাডেমির দিকে তাকানো যাক এবার। নাট্য অ্যাকাডেমি একটা স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখনো সক্রিয় একটা সংস্থা। এককালে নাট্য অ্যাকাডেমিতে বাংলার থিয়েটার জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষরা থাকতেন। এখন যাঁরা আছেন, তাঁদের একটাই কাজ, তা হল ব্রাত্য বসুকে তেল দেওয়া। গোটা লকডাউনের সময়ে নাট্য অ্যাকাডেমি কোনো সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। স্বশাসিত সংস্থা হয়েও কুটোটি নাড়েনি। রাজ্য সরকারের রাবার স্ট্যাম্প হয়ে বসে আছে। সরকারের অন্দরে ব্রাত্য বসুরা যেমন প্রশ্ন তোলেননি কেন থিয়েটার হল বন্ধ থাকবে, তেমনই নাট্য অ্যাকাডেমিও কোনো দাবি তোলেনি।
আসল সমস্যা হচ্ছে, তৃণমূল আমলে বাংলার থিয়েটার জগতে একটা হেজিমনি তৈরি হয়ে গিয়েছে। এটা বাম আমলেও ছিল, সে কথায় পরে আসব। এখন যেটা হচ্ছে, একটা বড় অংশের থিয়েটার কর্মী শাসকদলের ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর অংশ হয়ে গিয়েছেন। ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষরা তো তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা। এর বাইরে একটা বড় অংশের থিয়েটার কর্মী, গ্রুপগুলোর মাথারা, নানা রকম স্বার্থের কারণে শাসক দল করেন। আর মফস্বলকেন্দ্রিক দলগুলোও সরকারের নেকনজরে থাকতে চায়। সেটা স্বাভাবিকও। তাদের সরকারি মেলায় শো পাওয়ার ব্যাপার থাকে, প্রাইম টাইমে হল পাওয়ার ব্যাপার থাকে। তারা কেন সরকারকে চটাতে চাইবে? বাম আমলেও এই জিনিসটা ছিল। এই যে তৃণমূলের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ, এর ফলে নাট্যকর্মীদের দাবিদাওয়াগুলো সেভাবে উঠেই আসছে না। যাঁদের তোলার কথা, তাঁদের অধিকাংশই তো সিস্টেমের পেটের ভিতরে। এটা একটা বড় সমস্যা।
সরকারের থিয়েটার নিয়ে কোনো নীতি না থাকাটাও একটা বেশ বড় সমস্যা। এই সরকার তো ভাবেই না নাটকের কথা। এত তৃণমূলী নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও নাটকের একটা বড় অংশের লোকজন কিছুদিন আগে তাঁদের সমস্যার কথা বলতে নবান্নে গিয়েছিলেন। মমতা নিজে তো দেখা করেননি বটেই, কোনো উচ্চপদস্থ আমলাকে দিয়েও আবেদনের কপি গ্রহণ করাননি। ভাবা যায়! অথচ, এই মমতাই নিয়মিত টিভি সিরিয়ালের কলাকুশলীদের সঙ্গে বসেন।
মুখ্যমন্ত্রী নাটক নিয়ে উৎসাহী নন। গত ১০ বছরে কী ভাল নাটক হয়েছে জিজ্ঞেস করলে উনি একটি নাটকেরও নাম করতে পারবেন না। উনি হয়তো সিরিয়াল নিয়ে আগ্রহী। এটা হতেই পারে৷ কিন্তু সরকারের তো একটা পলিসি থাকবে! জ্যোতি বসুও কি খুব থিয়েটার দেখতেন? একেবারেই না। কিন্তু ওই সময় অনেক সীমাবদ্ধতা এবং সমালোচনার জায়গা থাকলেও সরকারের থিয়েটার নিয়ে একটা নীতি ছিল। আর এখন এই যে একজনের ইচ্ছাতেই সব — এইরকম স্বৈরতান্ত্রিক ছিল না বিষয়টা। অনেকগুলো রাস্তা খোলা ছিল।
প্রথমেই বললাম, আবারও বলছি, ব্রাত্য বসুর মতো লোকজন এর দায় এড়াতে পারেন না। উনি নিজে ক্যাবিনেটের বৈঠকে কেন থিয়েটার হল খোলার দাবি তোলেননি? কেন প্রশ্ন তোলেননি, যে সিনেমা হল খোলা হলে থিয়েটার হল কেন বন্ধ থাকবে? মার্জিনাল আর্ট ফর্ম বলে? এই প্রশ্নগুলো তুলতে না পারলে উনি কীসের নাট্যকর্মী? একটা কথা সরাসরি বলতে চাই, ব্রাত্য বসু নিজে থিয়েটারের লোক হয়ে থিয়েটার কর্মীদের সঙ্গে বেইমানি করছেন। ওঁর তৃণমূল নেতার সত্তাটিই প্রধান, থিয়েটার কর্মীর সত্তাটি নয়। অবশ্য ব্রাত্য বসুর কাছে তো এটাই প্রত্যাশিত। টিভি ক্যামেরার সামনে যিনি বলেছিলেন, “নাট্যকর্মী শব্দটি শুনলেই আমার যৌনকর্মী শব্দটি মনে পড়ে”, তাঁর কাছ থেকে কী আশা করার থাকতে পারে? ব্রাত্যবাবু অবশ্য বোঝেন না, যৌনকর্মী কোনো নঞর্থক শব্দ নয়।
এবার একটু আত্মসমালোচনা করি। আমরা যারা বামপন্থী ঘরানার থিয়েটার করি, এই সবকিছুর দায় তো আমাদেরও। আমরাই তো ব্রাত্য বসুদের ময়দানের দখল নিতে দিয়েছি, রুখতে পারিনি। এর সূচনা হয়েছিল বাম আমলে। সিপিএম জমানাতেও শিল্পীদের অবস্থা খুব সদর্থক ছিল না। “বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে” — এটা কোনো শিল্পীর কাজ হতে পারে না। আমার বারবার মনে পড়ে অক্টাভিও পাজের সেই কথাটা “সমর্থন সাময়িক, বিরোধিতা আবহমান”। এটাই শিল্পের কাজ, সরকারের রাবার স্ট্যাম্প হওয়া নয়। সেই যে বশ্যতার, পোষ মানার, “হ্যাঁ, হ্যাঁ” বলার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তার পথ বেয়েই আজ রাজ্যে একটা স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতা দখল করেছে।
এই সর্বগ্রাসী স্বৈরাচারের আমলে থিয়েটারের শিল্পীদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, আমরা তা করতে পারছি না। ছয়ের দশকে, সাতের দশকে বাদল সরকার, উৎপল দত্তরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তার ধারেকাছেও যেতে পারছি না আমরা। এমনকি, শম্ভু মিত্রের ভূমিকাও পালন করতে পারছি না।
আসলে থিয়েটারের উত্তরণ আর রাজনীতির উত্তরণ অনেক সময়ই ব্যস্তানুপাতিক হয়। তারা এক পথে চলে না। যেমন, ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের। অথচ সেই সময়েই মঞ্চ তোলপাড় করে উঠে আসছেন একদল নতুন থিয়েটার কর্মী। অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, অসিত বসু। তৈরি হচ্ছে দিনবদলের থিয়েটার। মরা সময়ে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার গান। চরম রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, অত্যচারের মধ্যেই কিন্তু নিপীড়িতের থিয়েটার জন্ম নেয়, তা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়। এখনো কিন্তু ঠিক তেমন সময়। এই তো সময়, যখন স্বৈরাচার আর ফ্যাসিবাদের চোখে চোখ রেখে উঠে দাঁড়াবে মার খাওয়া মানুষের থিয়েটার, সে প্রতিরোধের ডানা মেলবে আকাশে। ভয় পাওয়া মানুষকে একজোট করে ভয় দেখাবে ক্ষমতাকে।
কিন্তু তার জন্য আক্রান্ত হতে হবে আমাদের। একটা সত্যি কথা বলুন তো, পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটার কর্মীরা কেন আক্রান্ত হচ্ছি না? মহারাষ্ট্রে কবীর কলা মঞ্চ আক্রান্ত হচ্ছে, ভারভারা রাও জেলে পচছেন, অথচ আমরা কেন ঠিক আছি? কারণ, রাষ্ট্র আমাদের ভয় পায় না, আমাদের দুধভাত ভাবে। তাই আমরাও এই অদৃশ্য আপোষ আর স্থিতাবস্থার কারাগার ভাঙতে পারছি না কিছুতেই।
~মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।
তিতুমীর নাটক ও জয়রাজ ভট্টাচার্য – ছবি লেখকের সৌজন্যে।
ব্রাত্য বসু – ছবি Wikipedia থেকে।
আরো পড়ুন:
- খেউড় নয়, শাঁওলী মিত্রের আরও তীব্র অথচ মেধাবী সমালোচনা প্রাপ্য
- শাঁওলীদির থেকে কত শিখেছি তার হিসাব নেই
- তাপস সেন: আলো মানুষ, ভাল মানুষ
- টিনের তলোয়ারের ৫০ ও ‘প্রোপাগ্যান্ডিস্ট’ উৎপল দত্ত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
এলেমদার লেখা।
চমৎকার লেখা, জয়রাজ। কিন্তু যেখানে ৬০-৭০ দশকে সরকার নাট্যকরমীদের ভয় পেত, আজ সেটা পায় না কেন? প্রতিবাদের এই ধারায় উত্তরসূরি তৈরি হল না কেন?
স্কুলজীবনে একটা ধাঁধা খুব জনপ্রিয় ছিল। খাতায় একটা দাগ কেটে বন্ধুদের বলা হত “না মুছে এই দাগ টা ছোট কর দেখি”। তক্ষুনি বন্ধু ওই দাগের পাশে ফস্ করে একটা বড় দাগ টেনে বলত “নে তোর দাগ ছোট করে দিলাম। এ তো সবাই পারে”।
ছোটোবেলার এই দাগ ছোটো করার খেলা বুড়োবেলাতেও দেখি আমার আশেপাশের লোকজন খেলছে, বেশ আমোদ ক’রে খেলছে। শুধু পদ্ধতিটা উল্টে গেছে। এখন আর নিজের দাগটাকে প্রলম্বিত করার চেষ্টা না ক’রে, ইরেজ়ার দিয়ে অন্যের দাগটাকেই মুছে দেবার চেষ্টা করছে। ছোটোবেলায় পাওয়া যেতো সুগন্ধী রঙিন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে খুব বাজে ইরেজ়ার, যেগুলো সাদা পাতায় ঘষলে পাতাটাই কালিবর্ণ ধারণ করে, তেমন ইরেজ়ারেই দাগ মোছার চেষ্টা চালাচ্ছে আশেপাশের লোকজন।
শ্রী ব্রাত্যব্রত বসু – একটি দীর্ঘ এবং সুদৃঢ় এবং সঘন দাগ আমাদের বাংলা নাটকে। আগামী ইতিহাস একদিন এভাবেই বাংলা নাটককে দেখবে যে – ব্রাত্য বসু পূর্ববর্তী বাংলা নাটক, ব্রাত্য বসু পরবর্তী বাংলা নাটক – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ, ওই দাগটা যুগ-বিভাজনের দাগ। আমরা তো পড়েছি- গিরিশ যুগ, শিশির যুগ, শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত যুগ, তেমনই ব্রাত্য বসু যুগ। আর, যে কোনো যুগপুরুষকে তাঁর সমকালে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস বারবার হয়েছে, ইতিহাস সাক্ষী। মজার ব্যাপার এই, যুগনায়কের সঙ্গে সঙ্গে কালিমা-প্রদানকারী ব্যক্তিদেরও ইতিহাসে ঠাঁই হয়। যেমন যীশুর সঙ্গে জুডাসও থাকেন ভিঞ্চির ছবিতে, কিংবা সিরাজদৌল্লার আখ্যানে মীরজাফর।
আসলে, আমি যদি বুঝতে পারি, আমার যোগ্যতা, আমার মেধা, আমার চর্চা কখনোই আমাকে সেই শিখর চূড়ায় পৌঁছে দেবে না যেখানে প্রথম সূর্যকিরণ আসে, যেখানে পৌঁছতে পারেন নায়ক, তাহ’লে স্বভাবসঞ্জাত ঈর্ষায় এবং কুচক্রী বুদ্ধিতে আমি চেষ্টা করবো নায়ক যাত্রাপথ পিচ্ছিল করতে, তাতেও যদি নায়ক না দমেন তাহ’লে তাঁকে আক্রমণ করতে, কুৎসা করতে। আমি মিথ্যা বলবো যে, নায়ক আদৌ শিখর জয় করেনইনি, উনি মিথ্যাবাদী। এতে নায়কের কতোটা ক্ষতি হবে সেটা বড়ো কথা নয়, আমার লাভ হবে বিস্তর- আমি সাধারণের কাছে পরিচিত হবো প্রতিনায়ক হিসেবে। সেই পরিচিতিটুকুই তো আমার প্রয়োজন, আমার যে সম্বল আর কিছুই নেই। কোনোরকমে ছলে-বলে-কৌশলে চরম নিম্নগামী হয়ে একবার যদি প্রমাণ করতে পারি আমি শ্রী ব্রাত্যব্রত বসুর প্রতিপক্ষ, তাহলেই তো আমার জীবনতরী তরে গেল’। কিন্তু এই করতে গিয়ে যে নিজেকে সস্তা চটকদারী কর্মক্ষমতাহীন ইরেজ়ার বানিয়ে সমস্ত বাংলা নাটকের সাদা পাতাটাকেই আমি কালিমালিপ্ত করলাম, এবং কোনোভাবেই সেই দাগটিকে কণামাত্র খাটো করতে পারলাম না, সেই বোধোদয় আমার হবে না।
আমি লুঙ্গি পরে দু পায়ে জল ঠেলে নাট্যকর্মীদের ত্রাণ বন্টনে যাচ্ছি, তোমরা ‘জয়’ধ্বনি করো। কোন আমি? যে আমি জনগণের টাকায় জনগণের নাটক করি শহরের সবচেয়ে দামী শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে মহলা দিয়ে। টাকার হিসেব? চোপ্! নাটক চলছে। ‘জয়’ধ্বনি দাও। মহলা শেষে শহরের দামী রেস্তোরাঁয় দামী শিল্পীদের নিয়ে খেতে বসি জনগণের টাকায়। টাকার হিসেব? চোপ্! নাটক চলছে। ‘জয়’ধ্বনি দাও। জনগণের টাকায় শ্রেণী-সংগ্রামের নাটক করছি, মুটে-মজদুরের কথা বলছি, এই কি ঢের নয়? এইটুকুর জন্যই কি তোমরা আমাকে নেতা বানাবে না? ‘জয়’ধ্বনি দেবে না? আমার বিলাস-ব্যসন-নারীসঙ্গ ওগুলোকে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’র সন্দীপের সঙ্গে তুলনা করো। তাতেও তো আমার সামাজিক প্রতিপত্তি খানিকটা বাড়ে। প্রতিযোগিতামূলক ত্রাণবন্টনে আমি সামাজিক মাধ্যমে কতো কতো ছবি দিয়েছি, প্রায় প্রথম স্থান অধিকার করার মতো। তাতেও ‘জয়’ধ্বনি পাবো না? আচ্ছা বেশ, জীবনে-মরণে জনমে-জনমে সাকুল্যে যে দুয়েকবার নির্দেশক সেজেছি, তারই দৌলতে কলাকুশলীদের জন্য আমি বেদনাদীর্ণ হয়ে কুম্ভীরাশ্রু ফেলতে এসেছি। তাতেও ‘জয়’ধ্বনি জুটবে না? ধ্যুত্তেরিকা! নে, এবার তবে ওই জ্বলন্ত সূর্যের দিকেই তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকি – ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’, দেয়ালে দেয়ালে লিখি, সমাজ মাধ্যমের পাতায় পাতায় লিখি- ‘ব্রাত্য বসু থিয়েটারের পেটে লাথি মেরেছে’। দেখো, ঠিক এবার লোকজন শুনবে। আরে বাবা, লোকজন না-পড়ুক আমি তো রবীন্দ্রনাথের সেই লেখাটা পড়ে ফেলেছি, “হাউই কহিল, ‘মোর কী সাহস ভাই,/ তারকার মুখে আমি দিয়ে আসি ছাই।’/ কবি কহে, ‘তার মুখে লাগে না কো কিছু,/ সে ছাই ফিরিয়া আসে তোরই পিছু পিছু।” ব্রাত্য বসুকে গালাগালি দিলে, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমিকে গালাগালি দিলে তাদের কোনো ক্ষতি নেই, আমার লাভ বিস্তর। আমি ‘জয়’ধ্বনি পাবো।
শ্রী ব্রাত্য বসুর কারণে কিংবা পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির কারণে কতোবার কতো ভাবে কতো সাধারণ নাট্যকর্মী উপকৃত হয়েছেন, তার তালিকা বিধৃত করার প্রয়োজন আজকের লেখায় নেই। সকলেই জানি। নিন্দুকেরা আরও বেশি ভালো জানেন। লোভী ঈর্ষাতুরের ব্যক্তি কুৎসা কখনোই কাউকে কোথাও পৌঁছে দেয় না। বরং একটা গতিময় কাজে বাধা তৈরি করে, একটা জাতিকে হীন প্রতিপন্ন করে।
‘‘মাঝে মাঝে শুধু খসে পড়ে মাথা/কিছু-বা পুরনো কিছু-বা তরুণ/হাঁক দিয়ে বলে কনডাকটর/পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন’’।