আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নাগরিক ডট নেটের সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলন,
হিন্দি আগ্রাসন ইত্যাদি নিয়ে কথা বললেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার।

ভাষা

আপনার ছোটবেলায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাব কেমন ছিল? ১৯৫২ সালে তো আপনারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এসেছেন, তাই না?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমি পূর্ব বাংলায় জন্মেছি। কিন্তু একদম ছোট বয়সেই, ১৯৪৭ সালেই, পশ্চিমবঙ্গে চলে আসি। তার পাঁচ বছর পর একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটল। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। থাকতাম খড়গপুর শহরে। খড়গপুর হল রেল শহর। বহু ভাষাভাষী মানুষের বাস। সে যাই হোক, আমি খবরের কাগজের পোকা ছিলাম। আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তরের নিয়মিত পাঠক ছিলাম। তখন তো আর টেলিভিশন ছিল না, খবরের কাগজই ছিল দুনিয়া দেখার জানলা। খবরের কাগজ থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা জানতে পারলাম। বিষয়টা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা অবশ্য প্রথমে বুঝতে পারিনি। বয়স বেশ কম ছিল। তার উপর খবরের কাগজের প্রতিবেদন থেকে তো সবটা বোঝাও মুশকিল। তবে ভীষণ কিছু যে একটা ঘটেছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম।

এই আন্দোলন যে ক্রমে ক্রমে স্বাধীনতা আন্দোলনের চেহারা নেবে, ভাষার জন্য এতবড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়ে যাবে, পাকিস্তান ভেঙে যাবে – এসব কিছুই তখন বুঝিনি। ওই বাংলায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচন যখন হল, তার ফলাফল থেকে খানিকটা আঁচ করতে পারলাম বিষয়টা কোনদিন বাঁক নিচ্ছে। তার পরের ইতিহাস তো আমাদের সকলেরই জানা।

১৯৫২ সালে একজন স্কুলছাত্র হিসাবে আমি শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের নাম জানতাম। কিন্তু সার্বিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারিনি। তবে ভাষা আন্দোলনের খবর জেনে আমরা খুবই খুশি হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল, যে কারণে আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল, সেই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অসারতা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। মুসলমানরাও যে মুসলমানদের উপর অত্যাচার করতে পারে, সেই জুলুমের বিরুদ্ধে যে মুসলমানদেরই লড়তে হচ্ছে, এই বিষয়টা দেখে ভাল লেগেছিল। আমার আশেপাশের মানুষজনও খুশি হয়েছিলেন। তবে সকলের খুশির কারণ এক ছিল না।

ভাষা আন্দোলনের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে বা কলকাতায় কতখানি পড়েছিল?

আমি তো তখন খড়গপুরে থাকি। সেখানে বিষয়টা নিয়ে আলাপ আলোচনা যথেষ্ট পরিমাণে হয়েছিল। স্কুলে, পাড়ায়, বাড়িতে, খেলার মাঠে মানুষজন কথা বলছিলেন ঢাকার আন্দোলন নিয়ে। তবে রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব বলতে যা বোঝায়, সরাসরি তেমন কিছু হয়নি। বড় কোনো সভা-সমাবেশ কিছুই তেমন হয়নি। আমরা না হয় কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকতাম, সব খবর সময় মত পেতাম না, কিন্তু শহর কলকাতাও যে প্রবল উদ্বেলিত হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। বরং বলব, শিক্ষিত মানুষজনের অধিকাংশই ভাষা আন্দোলনের খবর জানতেন, নজর রাখতেন। কিন্তু সংহতি জানিয়ে খুব কিছু হয়নি।

 

আমাদের মনে হয়েছিল, যে কারণে আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল, সেই
সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অসারতা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। মুসলমানরাও যে মুসলমানদের উপর অত্যাচার করতে পারে, সেই জুলুমের বিরুদ্ধে যে মুসলমানদেরই লড়তে হচ্ছে, এই বিষয়টা দেখে ভাল লেগেছিল।

 

এর কারণ কী?

আমার এই বিষয়ে মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভেবেছিলেন এটা ওদের লড়াই, ওরা লড়ুক। আমরা তো ঠিকই আছি। আমাদের ভাষা তো আর বিপন্ন নয়। তাহলে আমরা কেন আগ বাড়িয়ে সংহতি জানাতে যাব? এর নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটা ভূমিকা ছিল বলেও মনে হয়। পাকিস্তান যে বিপদে পড়েছে, এতে অনেকেই খুশি হয়েছিলেন। হিন্দু উদ্বাস্তুরা তখনো মুসলিমদের উপর খুবই রেগে ছিলেন। মুসলমান বনাম মুসলমানের লড়াই তাঁদের আনন্দিত করেছিল। বৃহত্তর অর্থে ভাষা রাজনীতির বিষয়টা নিয়ে এই বাংলায় তখনো সচেতনতা গড়ে ওঠেনি।

অনেকে অভিযোগ করছেন, ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এক রাষ্ট্র এক ভাষা নীতি নিয়ে চলছে। হিন্দির আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা চলছে। আপনার কী অভিমত?

এটা একটা ভয়ঙ্কর আক্রমণ। এর বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ জরুরি। বিপন্ন মাতৃভাষার পাশে দাঁড়ানো এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। হিন্দি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটা রক্ষা করার জন্য জরুরি। এই আবহে একুশে ফেব্রুয়ারি নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে আসছে। নিজের ভাষাকে বাঁচানোর লড়াই, মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই, হিন্দির আগ্রাসন প্রতিরোধের লড়াই এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য। রাজনৈতিক দলগুলির উচিত এই বিষয়ে নজর দেওয়া। আমি বিশেষ করে বামপন্থী দলগুলির কথা বলব। তাঁদের এই বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত।

একুশে ফেব্রুয়ারি সারা পৃথিবীর প্রতিটা বিপন্ন ভাষাকে রক্ষা করার লড়াইকে অনুপ্রাণিত করে। বর্তমান ভারতে, আমি যদি বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কথা বলি, তাহলে এখনই এই বিষয়ে সচেতন আন্দোলন প্রয়োজন। হিন্দি যদি আইআইটির মত কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির একমাত্র ভাষায় পরিণত হয়, তাহলে তো মহা বিপদ। অন্য ভাষাভাষী লোকজন তো খুবই মুশকিলে পড়বে। খবরের কাগজ দেখে তো মনে হয় বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের তেমনই মতিগতি। অহিন্দি ভাষাভাষীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা চলছে বলে আশঙ্কা হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্য সব কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে যদি হিন্দি বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে অহিন্দিভাষীরা পিছিয়ে পড়বে, অবিচারের শিকার হবে। আর ভারতের মত বহু ভাষাভাষী মানুষের বাস যে দেশে, সেখানে এমন কাজ করা হবেই বা কেন! অথচ সেই চেষ্টাই চলছে। এর বিরুদ্ধে সকলের প্রতিবাদ করা দরকার। আমি দেখছিলাম তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন প্রতিবাদ করেছেন, বাঙালিদেরও প্রতিবাদ করতে হবে।

 

কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্য সব কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে যদি হিন্দি বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে অহিন্দিভাষীরা পিছিয়ে পড়বে, অবিচারের শিকার হবে… তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন প্রতিবাদ করেছেন, বাঙালিদেরও প্রতিবাদ করতে হবে।

 

হিন্দি আগ্রাসনের পাল্টা হিসাবে এক ধরণের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অনুশীলন হচ্ছে, অনেকে যার মধ্যে উগ্রতা দেখতে পাচ্ছেন। আপনার কি এমন কিছু নজরে পড়েছে?

নিশ্চয়। আমি এই ধরনের রাজনীতির অত্যন্ত বিরোধী। এগুলি হঠকারী কাজ। এসব করে আদতে বাঙালির ক্ষতিই হচ্ছে। বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকে যে শ্রমজীবী মানুষ বাংলায় কাজ করতে আসেন, তাঁদের উপর হামলা করা অত্যন্ত অন্যায়। অতীব অনুচিত কাজ। এসব আমি একেবারেই সমর্থন করি না। ভারতের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো ভারতীয়ের যাওয়ার, বাস করার, ব্যবসা করার অধিকার আছে। এই অধিকার কেউ কাড়তে পারে না। তাই ভিনরাজ্যে বাঙালি আক্রান্ত হলে আমরা প্রতিবাদ করি। যাঁরা বিহার, উত্তরপ্রদেশের শ্রমজীবী মানুষের উপর আক্রমণ করছেন, তাঁরা বুঝছেন না, এর ফলে অন্য প্রদেশে বাঙালির প্রবেশ বন্ধ হতে পারে। অসংখ্য বাঙালি প্রবাসী শ্রমিক আক্রান্ত হতে পারেন। এসব বন্ধ হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন বাংলা শব্দগুলো যথাসময়ে আমার মনের বাগানে ফুটে উঠেছে

ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বয়স প্রায় ১০০ বছর হল। কমিউনিস্টরা কি ভাষার প্রশ্নটাকে ঠিকভাবে পড়তে পেরেছেন এই অঞ্চলে?

এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। প্রাথমিকভাবে কমিউনিস্টদের এই বিষয়ে বোঝাপড়া খানিকটা সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়। তবে পরে তাঁরা সেই সীমাবদ্ধতা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছেন। পূর্ব বাংলার কথা যদি বলি, আমরা বদরুদ্দীন উমরের মতো বিশাল মাপের কমিউনিস্ট তাত্ত্বিককে পেয়েছি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর অসাধারণ কাজ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও কমিউনিস্টদের অধিকাংশই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে এই বাংলায় ভাষা সাম্রাজ্যবাদ, হিন্দি আগ্রাসন নিয়ে কমিউনিস্টদের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। নয়তো উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি সেই জায়গাটা দখল করবে।

 

এই বাংলায় ভাষা সাম্রাজ্যবাদ, হিন্দি আগ্রাসন নিয়ে কমিউনিস্টদের
আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। নয়তো উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি
সেই জায়গাটা দখল করবে।

 

পশ্চিমবঙ্গের চলমান ভাষা আন্দোলন কি খানিকটা জনবিচ্ছিন্ন?

খানিকটা নয়, অনেকটাই। এই বাংলায় ভাষার লড়াইটা শহুরে মধ্যবিত্তের আন্দোলন। এটা খুব বড় দুর্বলতা। ভাষা নিয়ে লড়াই কিন্তু কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়। তাকে জীবন-জীবিকার প্রশ্নের সঙ্গে জুড়তে হবে। ওই বাংলায় ১৯৪৮ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন যখন শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন পেল, তাঁরাও যখন এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করলেন, তখনই কিন্তু সাফল্য এল। পশ্চিমবঙ্গের কর্মীদের এই বিষয়টা বুঝতেই হবে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.