বেশ কিছুকাল হল, পশ্চিমবঙ্গে বসে বাংলা ছবি দেখা বেশ শক্ত। কারণ বাংলা ছবি তৈরি হয় কম। টালিগঞ্জ পাড়া থেকে প্রধানত দুরকম ছবি বেরোয় – ‘wannabe হিন্দি’ ছবি আর ‘wannabe ইংরিজি’ ছবি। সেসব ছবির বাঙালিয়ানা বলতে সংলাপটুকু। দ্বিতীয় ধরনের ছবিতে আবার সংলাপও বেশ খানিকটা ইংরিজি। অতি সাম্প্রতিককালে তৃতীয় এক ধরনের ছবি তৈরি হচ্ছে, সেগুলো ‘wannabe সর্বভারতীয়’। ফলে নীহারিকা কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাংলা ছবি দেখতে তৃষিত হৃদয় জয় করে ফেলে, কারণ প্রথম ফ্রেম থেকেই পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য একখানা খাঁটি বাংলা ছবি দেখান।
এ ছবির গৃহবধূরা গা ভর্তি গয়না পরে থাকে না, কাঞ্জিভরম পরে শুতে যায় না। স্কুলপড়ুয়া মেয়ের মা পরনের সাধারণ শাড়ির আঁচলটা কোমরে বেঁধে নিয়ে নাচ শেখান। যেমনটা চিরকাল বাঙালি মায়েদের করে আসতে দেখেছি। কয়েক মিনিট যেতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, পরিচালক ইন্দ্রাশিস এবং ক্যামেরার দায়িত্বে থাকা শান্তনু দে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঘরের সব জায়গায় সমান আলো পৌঁছনোর দরকার নেই। ইন্টেরিয়র ডেকরেটরের হাতে সাজানো ছবির মত ঘর তাঁরা দেখাতে চান না। কলকাতার পুরনো বাড়ির সেইসব সিঁড়ি, যেগুলো দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকে, সেগুলোকে সেভাবেই পর্দায় আনা হয়েছে। এখানে স্নান করে খালি গায়ে গামছা পরেই ঘরে আসেন ভুঁড়িওলা জ্যাঠামশাই। পরিচালক সিক্স প্যাক খুঁজতে বেরোননি। এখানে মাতাল বাবা বাইরে থেকে নেশা করে এসে মাকে পাড়া জানিয়ে নোংরা কথা বলে এবং দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে পেটায়। ঢুলুঢুলু আলোয় ড্রইংরুমে বসে স্কচ খেয়ে চার অক্ষরের ইংরিজি গালি দেয় না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
চারিদিকের ঝলমলে আলোয় যাঁদের ক্লান্ত লাগে, আজকের জীবনযাত্রার প্রচণ্ড গতিতে যাঁদের হাঁসফাস লাগে – নীহারিকা ছবিটা তাঁদের জন্য। প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে পর্দার নরম আলোর উপশম পেতে হলে এই ছবি দেখে ফেলুন। ক্রমশ গতি বাড়িয়ে চলা জীবনের নানাবিধ শব্দে যদি আপনার কান এবং মস্তিষ্ক পরিশ্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলেও ঘন্টা দুয়েক সময় বার করে এই ছবি দেখে আসা ভাল। শান্তনু যেমন আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি, সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকারও নেপথ্য সঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন অতি সামান্য। নৈঃশব্দ্য কথা বলেছে দর্শকের কানে কানে, যার জন্যে সাউন্ড ডিজাইনার সুকান্ত মজুমদারেরও বাহবা প্রাপ্য। শব্দ পরিহার করার এই সংযমও আজকের বাংলা ছবিতে সুলভ নয়। তবে এসব তো খুঁটিনাটি। সবচেয়ে বড় কথা, নীহারিকা এমন একটা কাজ করেছে যা বাংলা সিনেমা শুধু নয়, বাংলা সাহিত্য থেকেও আমাদের কালে উবে গেছে। তা হল জীবন সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তোলা। কাকে বলে আনন্দ? কোনটা স্বাধীনতা? ভাল থাকা বেশি জরুরি, নাকি সাফল্যে থাকা? এসব প্রশ্ন আমার সময়ের কোন বাংলা ছবিকে তুলতে দেখেছি? মনে পড়ে না। ইতিমধ্যেই বহু আলোচিত এই ছবির যৌনতার দিকটা। সেখানেও বেশকিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন পরিচালক। কোনটা সম্মতি, কোনটা স্বাভাবিকতা, কোনটাই বা বিকৃতি? এসবের উত্তর যে সাদায় কালোয় হয় না সবসময়, শান্তনুর ক্যামেরায় ফুটে ওঠা আলো আর আঁধারের মাঝখানেও লুকিয়ে থাকতে পারে – তা সাহস করে দেখিয়েছেন।
বছর বিশেক আগেও কাহিনিচিত্র কথাটা বাংলায় রীতিমত ব্যবহৃত হত। শনি বা রবিবার দূরদর্শনে বাংলা ছবি শুরু হওয়ার আগে ঘোষক/ঘোষিকা বলতেন “আজ দেখবেন বিজ্ঞাপনদাতা দ্বারা আয়োজিত কাহিনিচিত্র…”। ইদানীং যে শব্দটা আমরা ভুলে গেছি, তার একটা কারণ বোধহয় এই, যে আমাদের পরিচালকরা সিনেমায় গল্প কীভাবে বলতে হয় তা ভুলে গেছেন। যদি এমন হত যে তাঁরা বাংলা সিনেমাকে গল্পের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছেন, এমন সব অবিস্মরণীয় ফ্রেম তৈরি করছেন যে কেবল তার জন্যেই ছবিটা দেখা যায় – তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে যে কয়েকটা হাতে গোনা ছবি ‘হিট’ হয়েছে সেগুলোর সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্যের কথা বলতে বললেও একাধিকবার ছবিটা দেখা দর্শক মাথা চুলকোবেন। অথচ ক্যামেরা, আলো, সম্পাদনা – সবেরই তো মান বেড়েছে প্রযুক্তির উন্নতির কারণে। নীহারিকা কিন্তু এদিক থেকেও ব্যতিক্রমী। এর গল্প (সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ইন্দ্রাশিসের রচনা) যেমন বাঁধা গতের নয়, তেমনই একাধিক নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করেছেন পরিচালক।
শান্ত জনপদ শিমুলতলায় সন্ধেবেলা লোডশেডিং হয়ে যাওয়ার পর দীপার ঘুরঘুট্টি অন্ধকার মামাবাড়ি জেগে থাকে পর্দা জুড়ে। তারপর একতলায় জ্বলে ওঠে দুটো আলোর বিন্দু – সম্ভবত হ্যারিকেন। একটা আলোর বিন্দু কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চলে যায় চোখের আড়ালে, শেষে আবির্ভূত হয় দোতলায়। এ দৃশ্য মনে রাখার মত। আবার অনেক দর্শক নিশ্চয়ই বাড়ি যাবেন সিলুয়েটে দীপার (অনুরাধা মুখার্জি) নাচের রেশ নিয়ে। সংলাপ নয়, স্রেফ ছবি দিয়ে গল্প বলা যে শক্ত কাজ তা গত কয়েক বছরের বাংলা ছবি দেখলে বেশ টের পাওয়া যায়। পরিচালকের পরিমিতিবোধ না থাকলে এ জিনিস অসম্ভব। ইন্দ্রাশিসের সেই পরিমিতিবোধে চমৎকার সঙ্গত করেছেন সম্পাদক লুব্ধক চ্যাটার্জি। বিশেষত কোনো কান্নাকাটি, হইচই ছাড়াই দীপার মায়ের মৃত্যু নিঃশব্দে স্রেফ দুটো শটে দেখিয়ে ফেলার মুনশিয়ানা ভোলার নয়।
যে ছবিতে চাকচিক্য বর্জন করা হয় সে ছবি দাঁড়িয়ে থাকে অভিনয় ক্ষমতার উপর ভর দিয়ে। নীহারিকা ছবিতে সেই গুরুদায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন অভিনেতারা। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অনুরাধা ব্যক্তিগত জীবনের অশান্তি এবং শান্তিময়তা দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন, যদিও স্বামী রঙ্গনের (অনিন্দ্য সেনগুপ্ত) উপর ফোনে চেঁচানোর সময়ে তাঁকে কিঞ্চিৎ বেশি কোমল মনে হয়েছে। ছবির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দীপার ছোটমামা। অভিনেতা শিলাজিৎ সিনেমায় অভিনয় করছেন কম দিন হল না। কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে সন্দীপ রায় – কেউই তাঁকে এত বড় অথচ আপাত বিশেষত্বহীন চরিত্রে ভাবেননি। স্বনামধন্য শিলাজিৎ কিন্তু অনায়াসে ঘুমন্ত মফস্বলের ব্যস্ত ডাক্তার হয়ে গেছেন, যাঁর চরিত্রের তলদেশে আবার ঘুমিয়ে আছে এমন একটা জিনিস যাকে অন্তত তিনি নিজে বলেন বিকৃতি। পরিচালক নিথর দাম্পত্যের একাকিত্ব বোঝাতে শিলাজিৎকে দিয়ে অন্ধকার বারান্দায় ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব’ গাইয়ে নিয়েছেন। ওই অমূল্য মুহূর্ত সৃষ্টি করার কৃতিত্ব যতখানি পরিচালকের, ঠিক ততটাই শিলাজিতের।
আরো পড়ুন বল্লভপুরের রূপকথা: খাঁটি বাংলা ছবি
চমকে উঠতে হয় অবশ্য ছোটমামীর চরিত্রে মল্লিকা মজুমদারকে দেখে। গোটা ছবিতে তিনি টানা টানা চোখ ব্যবহার করে যে অভিনয় করে যান (যা তুঙ্গে ওঠে ‘মলয় বাতাসে’ গানে) তাতে স্রেফ চরিত্রটা নয়, মানুষটার জন্যেও কষ্ট হয়। কারণ উপলব্ধি করা যায়, নিম্নমেধার সিরিয়াল/মেগা সিরিয়াল একজন শিল্পীর ক্ষমতার প্রতি কতটা অবিচার করে।
এতকিছু সত্ত্বেও দু-একটা খটকা থেকে যায়। যেমন ছবিতে কোন সময় দেখানো হচ্ছে তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়। কারণ শিমুলতলার জীবনে এমনকি ব্যস্ত ডাক্তারবাবুকেও মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায় না, কিন্তু বিয়ের পর দীপা আর রঙ্গন কলকাতায় চলে আসতেই মোবাইল ফোন তো বটেই, ল্যাপটপেরও ব্যবহার দেখা যায়। এ যদি বর্তমানের গল্প হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, শিমুলতলা কি এখনো এতটা প্রযুক্তিবর্জিত? নাকি বেশ আগে লেখা বইয়ের গল্পকে পর্দায় নিয়ে আসতে গিয়ে এই বিভ্রাট হয়েছে? দেওঘরের প্যাথোলজিস্ট পরিচিত ডাক্তারকে “মিস্টার চ্যাটার্জি” বলে সম্বোধন করেন – এই ব্যাপারটাও একটু অদ্ভুত লাগে। সাধারণত তো ডাক্তারবাবুদের “ডক্টর” বলেই সম্বোধন করা হয়। আরেকটি প্রশ্নও না করে থাকা যায় না। দীপা পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পেল – নিজের সঙ্গে থাকার স্বাধীনতা। কিন্তু তা করতে গেলে তো অর্থনৈতিক স্বাধীনতারও প্রয়োজন হয়। সে সম্পর্কে কোনো সংবাদ কিন্তু পেলাম না। দীপা এম এ করেছে, তারপর গবেষণা করবে – এই পর্যন্ত জানা গিয়েছিল রঙ্গনের সঙ্গে বিয়ের আগে। তারপর সোজা বিয়ে, মা হওয়া দেখলাম। ওরই মধ্যে বা পরে কি সে কোনো কাজে যোগ দিয়েছিল? তার হদিশ পেলাম না।
কেউ বলতেই পারেন এ নেহাত ছিদ্রান্বেষণ। কিন্তু ছবিটা এত বেশি প্রত্যাশা জাগায় এবং পূরণ করে বলেই কথাগুলো মনে আসে। বাজার চলতি বাংলা ছবির মত একখানা পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যেখানে পারা যায় গুঁজে না দিয়ে যে পরিচালক নায়িকাকে দিয়ে দ্বিজেন্দ্রগীতি গাওয়ান, তাঁর কোথাও ভুলচুক হয়ে গেল কিনা তা নিয়ে তো উদ্বেগ তৈরি হবেই। রবীন্দ্রসঙ্গীতও আছে অবশ্য। কিন্তু সে গানের এর চেয়ে উপযুক্ত ব্যবহার অসম্ভব ছিল।
পপকর্ন খেতে খেতে দেখে ভুলে যেতে চাইলে নীহারিকা আপনার জন্যে নয়। যদি প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার বহুক্ষণ পরেও দেখা ছবির রোমন্থন করতে ভাল লাগে, তাহলে এই ছবি আপনার।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত […]