একটি শিশু ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষিকা চেয়ারে বসে এক এক করে ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের ডাকছেন, তারা এসে শিশুটিকে মেরে যাচ্ছে। উঠছে হাসির রোল এবং শোনা যাচ্ছে শিক্ষিকার সংখ্যালঘুবিদ্বেষী কথাবার্তা। এই অবধি বললে মনে হয় নাজি জার্মানি নিয়ে তৈরি কোনো ফিল্মের বর্ণনা করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত, এই ভিডিওটি আধুনিক ভারতের।

উত্তরপ্রদেশের নেহা পাবলিক স্কুল নামে যে স্কুলটিতে এই ঘটনা ঘটেছে সেখানকার আলোচ্য শিক্ষিকা তৃপ্তা ত্যাগী আত্মপক্ষ সমর্থনে যে বয়ান দিয়েছেন তা আরও অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করে আমাদের। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটি ছোট ঘটনা, বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে – এইসব সাফাই গেয়েছেন তিনি। যে ভিডিও দেখে সারা দেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়েছেন তা সম্পাদনা করে তাঁর কথাবার্তা পাল্টে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, তিনি মুসলমান শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শুধু এটুকুই বলেছিলেন যে মুসলমান বাচ্চাদের মায়েরা যদি তাদের মামার বাড়ি নিয়ে চলে যায় তাহলে পড়ার খুব ক্ষতি হয়। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই তৃপ্তা সত্যি বলছেন, তাহলেও এটা স্পষ্ট নয়, যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাচ্চারা মামার বাড়ি গেলে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হয় কিনা। কারণ যে কোনো ধর্মের শিশুই মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি গেলে তার স্কুল কামাই হতে পারে, পরীক্ষার দিন সে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ফলে এই কথা বোঝানোর জন্য মুসলমান শব্দটি কেন ব্যবহার করতে হবে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

 

যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই তৃপ্তা সত্যি বলছেন, তাহলেও এটা স্পষ্ট নয়, যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাচ্চারা মামার বাড়ি গেলে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হয় কিনা।

 

শিক্ষিকার আরও বক্তব্য, ভিডিওতে যে শিশুটির উপর নির্যাতন হতে দেখা যাচ্ছে, সে পড়াশোনা করছে না। বাড়িতে হোমওয়ার্ক দিলে করে আসছে না। তাই তাকে মারধর করা হয়েছে, মুসলমান বলে নয়। তৃপ্তা যেভাবে মারধর করাকে শিশুটির ভালর জন্য বলে উল্লেখ করছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে, দেশের আইনে যে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘কর্পোরাল পানিশমেন্ট’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই। তিনি বারবার বলছেন, বাচ্চার মা-বাবাই তো আমাদের বলেছিল তাকে ‘টাইট’ দিতে। বাচ্চাদের টাইট দেওয়ার জন্য কিছু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতেই হয়।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের অভিভাবক সত্যিই বলে থাকেন, আমার ছেলেকে একটু শাসন করবেন যাতে ও পড়াশোনাটা শিখতে পারে। কারণ তাঁদের মনে হয় পড়াশোনার দায়িত্ব তাঁরা বাড়িতে নিতে পারেন না, ইস্কুলে ঠিকঠাক হতে পারে। স্কুলের উপরেই তাঁরা এ বিষয়ে নির্ভরশীল। স্কুলে শাস্তি হিসাবে মারধর যে নিষিদ্ধ তা অভিভাবকরা না জানলেও শিক্ষিকার জানা কি বাধ্যতামূলক নয়? ভাবা দরকার, শাসন করার নামে সহপাঠীদের দিয়ে মারধর করানো কি শুধু এই শিশুটির মনের উপরেই চাপ সৃষ্টি করছে? অন্য বাচ্চাগুলিকেও তো এর মাধ্যমে শেখানো হচ্ছে, একে একে এসে মেরে যাও। কখনো বলা হচ্ছে এবার কোমরে মারো। ফলে তাদেরও হিংসার পাঠ দেওয়া হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আজকের ভারতে গণপিটুনিতে মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, স্কুলজীবনে শিশুদের গণপিটুনির পাঠ দেওয়া হচ্ছে এবং বিদ্বেষের বীজ বপন করা হচ্ছে।

আরও দুঃখজনক, তৃপ্তা নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে সামনে এনেছেন নিজের অন্যায়কে আড়াল করার জন্য। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, আমি প্রতিবন্ধী, উঠে দাঁড়াতে পারি না। এই শিশুটি পড়াশোনা করছে না, তার শাস্তি দরকার। সেজন্য আমি অন্য বাচ্চাদের সাহায্য নিয়েছি ওকে মারতে। কলেজে পড়ার সময়ে অনেকেই বন্ধুবান্ধবদের রোল কলের সময়ে প্রক্সি দিয়ে দিতে বলে থাকে। কিন্তু চড় মারতে অন্যকে প্রক্সি দিতে বলা অভিনব। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, শিশুটিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি স্কুলের অন্য কোনো শিক্ষিকা বা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সাহায্য নেননি। অন্য শিশুদের দিয়ে কাজটি করিয়েছেন। শিশুদের মনে বিষ ঢোকানোর দায়িত্ব তিনি যে খুব ভালভাবেই পালন করেছেন তা ভিডিওতে স্পষ্ট।

 

এক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, স্কুলজীবনে শিশুদের গণপিটুনির পাঠ দেওয়া হচ্ছে এবং বিদ্বেষের বীজ বপন করা হচ্ছে।

 

আমরা যে সময়ে বাস করছি সেই সময়ের নিয়মানুসারে সোশাল মিডিয়ায় তৃপ্তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠছে, আবার মানুষ তাঁকে সমর্থনও করছে। বলা যেতেই পারে, এদের অনেকে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের থেকে পয়সা পেয়েছে বলে সমর্থন করছে। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ দিক হল, ওই শিক্ষিকা “বেচারা প্রতিবন্ধী”, তাই তাকে হেনস্থা করা হচ্ছে – একথা বারবার বলা হচ্ছে। এই যুক্তির ব্যবহার আমাদের ভয়ঙ্কর দিকে নিয়ে যাবে। এক ধরনের সংখ্যালঘু মানুষের বিরুদ্ধে আরেক ধরনের প্রান্তিক মানুষকে লড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা এই ভাষ্যের মধ্যে স্পষ্ট। সমস্যা হল, কিছু মানুষ মনে করতে পারেন, সত্যিই তো। এই শিক্ষিকা প্রতিবন্ধী নারী, তাঁরও তো কিছু সহায়তা দরকার। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশ প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে সক্ষম নয়। আর শিশুকে নির্যাতন করার জন্য যে কোনো মানুষেরই সহায়তা প্রাপ্য নয় তা বোধহয় নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু এই ধরনের উদ্ভট যুক্তি খাড়া করা হচ্ছে। একজন প্রতিবন্ধী নারী সমাজসেবা করছিলেন, তাঁকে ঘিরে মিথ্যাচার করা হচ্ছে – এই ধরনের বক্তব্য উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রীরা রাখতে শুরু করেছেন।

আরো পড়ুন হিজাব না হলেও হিজাবির পক্ষ নিতেই হবে আমাদের

শিশুটির বাবা জানিয়েছেন তাঁদের অঞ্চলে সরকারি স্কুল থাকা সত্ত্বেও ৩০০ টাকা মাইনে দিয়ে এই স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন সে পড়াশোনা শিখতে পারবে এই আশা নিয়ে। এখানে বলে রাখা দরকার, শারীরিক শাস্তি যে স্কুলে দেওয়া যায় না সেটি বোধহয় উত্তরপ্রদেশ কেন, সারা দেশের অনেক শিক্ষকই এখনো জানেন না, জানলেও মানেন না। এ কথা জেনেও নেহা পাবলিক স্কুলের ঘটনাটি আমাদের বেশি বিচলিত করেছে পরধর্মবিদ্বেষী কাজে শিশুদের ব্যবহার করার জন্য। সোশাল মিডিয়ায় ওই ভিডিও দেখে নির্যাতিত শিশুটির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। কেউ চেয়েছেন তার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে, কেউ চেয়েছেন কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে। নির্যাতিত শিশুটির মন থেকে ভয়, দুঃখ, রাগ কোনদিন দূর হবে কিনা জানা নেই। তবে এই দুঃসময়ের ইতিহাস যখন লেখা হবে, দেশের এক বাচ্চাদের স্কুলে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ ঘটনার গভীর অন্ধকার ভারতবাসীকে লজ্জিত করবেই।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.