অভিজিৎ সেন
“মানিক তো তোমায় খুঁজছে।”
“যাক, তুমি উতরে গেছ।”
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
১৯৭৪ সালের ২২ ডিসেম্বর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে বিজয়া রায়ের সঙ্গে কথোপকথন আর ১৯৭৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জন-অরণ্য মুক্তি পাওয়ার পর বিজলি সিনেমা হলের লবিতে সত্যজিৎ রায়ের সার্টিফিকেট – এই দুয়ের মাঝেই ছিল প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনের সেরা সময়। বাকি সময়টা তাঁকে পেরোতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। একদিকে সিনেমা, সিরিয়াল, বাণিজ্যিক নাটক, যাত্রা যেমন করেছেন, অন্যদিকে পেশাগতভাবে তাঁকে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছিল তাঁর আইন ব্যবসা।
শৈশবে, কৈশোরে সংসারে অভাব, অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। পড়াশোনা ভাল লাগত না। সিনেমার নায়ক হওয়ার নেশায়, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যেই বাড়ি থেকে পালিয়ে ঠাঁই নেন মুম্বইয়ে। সেখানে মাস দুয়েক গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে ফিরে আসেন কলকাতায়। তারপর একে একে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক এবং এলএলবির বেড়া ডিঙোনো। সিটি কলেজে পড়ার সময়ে যোগাযোগ নাটককার মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনিই প্রদীপকে নিয়ে যান চতুর্মুখ নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার অসীম চক্রবর্তীর কাছে। এরপর প্রদীপ যুক্ত হন শ্যামল ঘোষের নাট্যদল নক্ষত্রর সঙ্গে। রবীন্দ্র সদনে এদেরই লম্বকর্ণ পালা নাটকে প্রদীপের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন সত্যজিৎ রায় এবং স্থির করেন জন-অরণ্য ছবির নায়ক হবে এই ছেলেটিই। তবে খোঁজখবর নেওয়া আর সাক্ষাতের মধ্যে পেরিয়ে যায় বেশ কিছুটা সময়।
তিনি সত্যজিতের ছবির নায়ক হবেন, এই উত্তেজনা চমৎকার ধরা পড়েছে প্রদীপের আত্মজীবনী জন-অরণ্যে বইয়ে। “অনেক দিন অনেক বিপর্যয়ের ঝড়, হেলাফেলা, উপহাস সহ্য করে আজ এখানে এসে পৌঁছেছি। বুঝলাম আমার মধ্যে একটা জোশ দাপাদাপি শুরু করছে।”
জন-অরণ্য ছবির পর প্রদীপ ভেবেছিলেন শুধু অভিনয় নিয়েই থাকবেন। তাই ছেড়ে দিলেন চাকরি। তাঁর মনে হয়েছিল, “স্বপ্নের রাজপথে দাঁড়িয়ে কেউ গলিঘুঁজির সন্ধান করে?” স্বয়ং সত্যজিৎ তাঁকে সাবধান করেছিলেন, “আমার সঙ্গে ছবি করে তুমি বুঝতেই পারবে না টালিগঞ্জে কী ভাবে ছবি হয়।”
প্রদীপের দুর্ভাগ্য সত্যজিৎ-সৌমিত্র, তরুণ মজুমদার-অনুপকুমার, মৃণাল সেন-অঞ্জন দত্তের মত কোনো পরিচালক-অভিনেতার জুটি তাঁর বাঁধা হয়ে ওঠেনি। দৌড় (১৯৭৯) এবং অন্বেষণ (১৯৮৫) ছবির পর যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল শঙ্কর ভট্টাচার্যের সঙ্গে, তাঁর অকালমৃত্যুতে তাও শেষ হয়ে যায়। তাই আমরা সত্যজিতের কলকাতা ট্রিলজির (প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জন-অরণ্য) অন্যতম নায়ককে দেখি তৎকালীন সেরা পরিচালকদের দরজায় দরজায় ঘুরতে। তপন সিংহ এবং অসিত সেনের ছবিতে কাজ করলেও, প্রদীপকে নিরাশ করেন অজয় কর এবং তরুণ মজুমদার। অবশ্য এরই মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের দূরত্ব (১৯৮১) শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ায়, নায়ক প্রদীপের জমি আরও কিছুটা মজবুত হয়। তবে লড়াই ছিল খুবই কঠিন। দীপঙ্কর দে, স্বরূপ দত্ত, রঞ্জিত মল্লিক, শমিত ভঞ্জ ও সন্তু মুখোপাধ্যায়ের মত তাঁর থেকে কিছু বড় এবং সমবয়সীরা তখন শাসন করছেন সেলুলয়েড দুনিয়া। প্রদীপ টের পেলেন মূল স্রোতের ছবিতে সুযোগ না পেলে সংসার চালানো অসম্ভব। বছর চল্লিশ আগে বলিউড নায়িকা সারিকার সঙ্গে জুটি বেঁধে বন্দিনী কমলা ছিল তেমনই এক প্রচেষ্টা। কিন্তু সে ছবি বক্স-অফিস আনুকূল্য পায়নি।
সেই সময় তাঁর প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি দিয়েছিল বাণিজ্যিক নাটক বা বোর্ড থিয়েটার। হাতিবাগানের বাইরে তখন নহবত বসেছিল তপন থিয়েটারে। এই মঞ্চসফল নাটকে টানা ছ বছর (১৯৭৬-১৯৮২) অভিনয় করেছিলেন প্রদীপ। সহ-অভিনেতা হিসাবে পেয়েছিলেন বিকাশ রায়, তরুণকুমার ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত মহীরুহদের।
অথচ অন্য একটি বাণিজ্যিক নাটক করতে গিয়ে প্রযোজকদের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় অভিনয় ছেড়ে প্রদীপ মন দেন আইন ব্যবসায়। সেই লাইনেও সাফল্য সহজে আসেনি। জন-অরণ্য ছবির সোমনাথের মতই নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছিল প্রদীপকে। সেখানে মুখোমুখি হয়েছেন রক্তমাংসের বিশুদা, নটবর মিত্তির, গোয়েঙ্কা, মিসেস গাঙ্গুলি ও যূথিকার। সত্যজিতের নায়ক কেন এখানে, তার কৈফিয়তও দিতে হয়েছিল বহুজনকে।
সুপুরুষ এবং মায়াময় কণ্ঠের অধিকারী প্রদীপ, তাঁর অভিনয়ের ছাপ রেখেছিলেন দূরদর্শনের দুটি টেলি সিরিয়ালে – সোনার সংসার (১৯৮৫) এবং কালপুরুষ (১৯৯০)। যেসব দর্শকের বয়স আজ পঞ্চাশের ওপারে, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে প্রথমটিতে শ্রীলা মজুমদার এবং দ্বিতীয়টিতে অনসূয়া মজুমদারের সঙ্গে তাঁর রসায়ন কীভাবে মজিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন।
আরো পড়ুন পথের পাঁচালী — একটি আদ্যিকালের সমালোচনা
প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর অভিনয়ের তারটি বড় নিচু পর্দায় বাঁধা। সেই সমালোচনার উত্তর দিতে প্রদীপ যখন যাত্রায় যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। তাঁর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন প্রবাদপ্রতিম পালাকার ও পরিচালক ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। অন্যদিকে খেয়ালের বশবর্তী হয়ে হেলায় হারান আকাশবাণীর রেডিও নাটকে অভিনয় এবং দূরদর্শনে খবর পড়ার সুযোগ।
বিভিন্ন বয়সের প্রদীপকে চরিত্রাভিনেতা হিসাবে সুযোগ দিয়েছেন অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং সন্দীপ রায়। সতী, গয়নার বাক্স, হীরের আংটি, উৎসব, বাক্স রহস্য ও গোরস্থানে সাবধান সেই সাক্ষ্যই বহন করছে।
সাদাসিধা মাটির মানুষ প্রদীপকে দেখা যেত আইসিসিআরে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতাসভায়। প্রতি বছর ২ মে, সত্যজিতের জন্মদিনে, বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে গিয়ে সেরে আসতেন গুরুপ্রণাম। তাঁকে শেষ দেখা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল প্রাঙ্গণে, কলকাতা সাহিত্য উৎসবে, এ বছরের মার্চ মাসে। ‘সত্যজিৎ ১০০’ অনুষ্ঠানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা ট্রিলজির তিন দিকপাল ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, বরুণ চন্দ (অনলাইনে) এবং প্রদীপ।
ঋণ:
১। জন অরণ্যে: প্রদীপ মুখোপাধ্যায় (সপ্তর্ষি প্রকাশন)
২। আমাদের কথা: বিজয়া রায় (আনন্দ পাবলিশার্স)
নিবন্ধকার স্বাধীন সাংবাদিক, সম্পাদক ও অনুবাদক। প্রায় তিন দশক ইকনমিক টাইমস ও এই সময় কাগজে কাজ করেছেন। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।