শ্রীমু

ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম। সেই স্বনামধন্য দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি অনিমেষ চট্টোপাধ্যায় (ভিক্টর ব্যানার্জি) সন্ত্রাসবাদী হুসেনের ফাঁসি রদ করার আবেদন নাকচ করে দিলেন। ইসলামিয় দৈত্যকুল এতে বেজায় চটল। ঠিক হল, এর উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে অনিমেষকে। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। দায়িত্ব পড়ল বাংলাদেশের এক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের উপর। তারা বর্ধমানের খয়রাগড়ে লোক পাঠাল গোপনে অনিমেষ বধের ছক কষতে। এদের দল পুরুষ ও মহিলা নিয়ে সংগঠিত। প্রত্যেকেই অদম্য, হিংস্র, নির্মম এবং লক্ষ্যে অবিচল। কিন্তু খয়রাগড় কেন? কারণ তার অদূরেই অনিমেষবাবুর পৈতৃক ভিটে, যেখানে প্রত্যেক বছর দুর্গাপুজো উপলক্ষে তিনি আসেন। সন্ত্রাসবাদীদের দলটি কিন্তু বেশ কাঁচা। তারা বুদ্ধি করে একটি দোতলা বাড়িতে সংসার পেতে বসল ঠিকই, কিন্তু বসার সময়ে তাদের আসনতলে যে কাঁচা বোমা শুকোচ্ছিল তা ঠাহর করতে না পেরে একেবারে চিত্তির কাণ্ড বাধালে। বোমা ফেটে চুরমার, হুলস্থুল, রক্তারক্তি, লোক জানাজানি, পুলিস-ফুলিস থেকে মিমি চক্রবর্তী হয়ে দিল্লির বাঙালি ক্ষত্রিয় অফিসার পঙ্কজ সিংহ (আবীর চ্যাটার্জি), মানে লায়ন কিংয়ের প্রবেশ। যাকে বলে খেলা জমে ক্ষীর।

এত অবধি পড়ে যাঁরা ভাবছেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তাঁরা ভুল ভাবছেন না। রক্তবীজ ছবির তুখোড় পরিচালকদ্বয় (নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখার্জি) পুরো ছকটি সাজিয়েছেন উত্তরসত্যের (post truth) ভিত্তিতে। এ এক সংকর সত্য উপাখ্যান, যার পরতে পরতে মিশে আছে ২০১৪ সালের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনার কিছু টুকরো। সঙ্গে অমিত শাহী কল্পনার মিশেল, যার কোনটি আসল আর কোনটি নকল তা বাছতে বাঙালিকে সুকুমার রায়ের শরণাপন্ন হতে হবে। যেহেতু শাহ হাতিবাগানে থিম প্যান্ডেলে বিরাজমান, অগত্যা আমাদের আসল নকল উভয়ই ভাল বলে ধরে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। আর এই যে আপনি এরকমটাই তো হয়েছিল গোছের ‘সত্য কাহিনি’-র ঘেরাটোপে বাঁধা পড়লেন, এর থেকে যবনিকা পতনের আগে পর্যন্ত আপনাকে জিনিয়া লইতে কেহ পারিবে না।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

খেলা তো সবে শুরু। খয়রাগড় কাণ্ডের মূল চক্রী সমেত মোট ৩১ জনের সাজা ঘোষণা হলেও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি কিন্তু দমে না। তারা অনিমেষবাবুর নেহাতই সহজ, সরল হুইলচেয়ারবন্দি দিদির দেখভাল করার অছিলায় ঘরের মধ্যে মহিলা সুইসাইড বম্বার পাঠায়, সঙ্গে একটি মূক বালককেও। ছেলেটি একেবারে এলেবেলে গোছের দেখতে হলে কী হবে, আসলে পাক্কা বদমায়েশ। পুকুর ধারে বসে স্লেটে লুকিয়ে লুকিয়ে আরবি হরফে ‘জিহাদ’ লেখে আর চেনাজানা কাউকে আসতে দেখলেই টুক করে লুকিয়ে ফেলে। ভাগ্যিস ভালমানুষের পো সত্যমের চোখে পড়ে গেছিল, নইলে তো ধরাও পড়ত না! এই জন্য অনসূয়াদিকে পই পই করে বলেছিলাম স্বচক্ষে আধার কার্ড না দেখে বাড়িতে ঝি চাকর ঢুকিও না। বাংলাদেশ থেকে পিলপিল করে আসা সব মুসলমান মেয়েগুলো নাম ভাঁড়িয়ে বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে ঢোকে কী মতলবে জানি না ভেবেছ?

তা বাপু প্ল্যানটি কিন্তু জব্বর ফেঁদেছিল মোল্লাগুলো। একেবারে পাকা শয়তানের মাথা যাকে বলে। আমাদের রাষ্ট্রপতি অনিমেষ বাবাজিকে তো জানো। মা দুর্গা অন্ত প্রাণ, অতিথিবৎসল, প্রজাহিতৈষী ব্রাহ্মণ জমিদার। উঁচু বংশের ছেলে বলে কথা। সে তো অষ্টমীতে চৌষট্টিবার যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা বলে চণ্ডীপাঠ করবেই করবে। বিজয়া দশমীতে মায়ের ভাসানের শোভাযাত্রায় সবার সঙ্গে পা মেলাবেই মেলাবে। কেউ আটকাতে পারবে না। তারই সুযোগ নিয়ে এই ‘টেররিস্ট’ মেয়েছেলেগুলো নিজেদের গায়ে বোমা বেঁধে অনিমেষ সমেত উড়ে যাবে ঠিক করেছিল। নেহাত বাদ সাধল পঙ্কজ সিংহের মস্তিষ্ক আর সংযুক্তা মিমিত্রের তাক লাগানো হাতের টিপ। কিন্তু হলে কী হবে, এক্কেবারে রক্তবীজের ঝাড় যে এরা। সবাইকে খতম করতে পারল কই? এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লেই সেখান থেকে জন্ম নেয় আরেকটি সন্ত্রাসবাদী।

তা বলে যবনেরা সবাই খারাপ তা বলছি না। ভাল মুসলমানও আছে বই কি। জাকিরকেই দেখো না, মায়ের অ্যাক্সেসরিজের দায়িত্বে আছে। আসিফের কথাও বলতে হয়। ও সেই ২০১৪ সালে অজিত দোভালের টিমেও ছিল, আবার এখন পঙ্কজ সিংহের টিমেও আছে। এরা তো ভালই, মানে এখন পর্যন্ত কোনো বেয়াদবি দেখিনি।

 

#

রক্তবীজের কথা যখন শেষমেশ চলেই এল, তখন মস্করা ছেড়ে শেষ পাতে দু-চারটি তত্ত্বকথা সেরে ফেলা ভাল। বাংলা যে তন্ত্রের পীঠস্থান তা এখনকার আম বাঙালি বিস্মৃত হলেও বিদ্বজ্জনরা জানেন, কতটা মানেন তা আলাদা কথা। এই বাঙালির প্রধান উৎসবে যে চণ্ডীপাঠ হয়, তা একটি ঘোরতর তান্ত্রিক টেক্সট। শুনে তাজ্জব বনে যাবার কিছু নেই। এই চণ্ডী হল মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবীমাহাত্ম্য। এ বড় অদ্ভুত গ্রন্থ। একভাবে দেখলে অসংখ্য আষাঢ়ে গল্পের সংকলন, অনেকটা মার্ভেল সিরিজের মত। মধু-কৈটভ, শুম্ভ-নিশুম্ভ প্রমুখ অসুরদের দৌরাত্ম্যের প্রতিকারে দেবীর টপ ফর্মে মনস্টার হান্টিং। এহেন অষ্টম দেবী মাহাত্ম্যের কাহিনীটিই রক্তবীজের। বেকায়দায় পড়া শুম্ভ শেষমেশ রক্তবীজকে যুদ্ধে পাঠালেন। আর তার মোকাবিলা করার জন্য দেবী চণ্ডীর শরীর থেকে বেরিয়ে এলেন শিবদূতী। তাঁকে সঙ্গত করতে দেবতাদের শরীর থেকে বেরিয়ে এল আরও অনেক দেবীর ওয়ারিয়র সংস্করণ। কিন্তু সংস্করণ প্রসবে রক্তবীজ ছিল দেবতাদের তুলনায় অনেক দড়। তার একেকটি রক্তবিন্দু মাটিতে পড়লেই তার থেকে একটি করে রক্তবীজ জন্মায়। ফলে তাকে নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। কোনো উপায় না দেখে দেবী চণ্ডী তখন চামুণ্ডাকে বললেন, হে চামুণ্ডে! তোমার বদন বিস্তৃত করো। চামুণ্ডা সেই আদেশ পেয়ে মাটিতে পড়া রক্তবীজের রুধির চেটেপুটে সাফ করে দিয়ে সে যাত্রা দেবকুলকে বাঁচালেন।

এই মারকাটারি গল্পের ঘেরাটোপটি আসলে বহিরঙ্গ, এর ভিতরে রয়েছে মারাত্মক সব কথা। একটু খুলে বলা যাক। আমরা কথায় বলি, জীবাত্মা আর পরমাত্মা। আসলে আত্মা আত্মামাত্রই। তাতে জীব বা পরম – কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। এই আত্মার যখন জীব ভাবটি ফুটে ওঠে, তখন তিনি রক্তরঞ্জিত হয়ে প্রকাশ পান। একেই বলে রক্তবীজ। অর্থাৎ দেহের সাহায্যেই আমাদের মধ্যে আত্ম অনুভূতির উন্মেষ হয়, আর সেই আত্ম অনুভূতির মাধ্যমেই আমরা বিশ্ব সম্পর্কিত সমস্ত ধারণা তৈরি করতে সমর্থ হই। তাই দেহকে বাদ দিলে চলবে না। আবার দেহকে মান্য করলে দ্বৈতবাদ আসবেই, আমি ও তুমির ভেদ তৈরি হবে। সহস্র সাধনা, জ্ঞান আলোচনাও এই অহমবোধকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করতে পারে না। তাই যতদিন দেহ আছে, মন আছে, ইন্দ্রিয় আছে, ততদিন রক্তবীজও আছে। এর থেকে পরিত্রাণের পথ হল বিশ্বাস, অনুভব, যুক্তি, শাস্ত্র এবং কৃপা। এই পাঁচ অস্ত্রের একসঙ্গে ব্যবহারেই একমাত্র রক্তবীজ নিধন সম্ভব। যতদিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে অদ্বয় জ্ঞানের উন্মেষ না হচ্ছে, অর্থাৎ যতদিন না আমরা বুঝতে পারছি যে জীব বলে আলাদা কিছু নেই, দৃশ্য বলে আলাদা কিছু নেই, একমাত্র বিশুদ্ধ বোধস্বরূপ অখণ্ড বস্তুটি নিত্য বিরাজমান, ততদিন পর্যন্ত রক্তবীজ নিধন সম্ভব নয়।

রক্তবীজের এই ব্যাখ্যা কিন্তু সম্পূর্ণ ভেদাভেদবিরোধী এবং বর্তমান ভারতের পরিস্থিতির নিরিখে ঘোরতর অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু আমি ও মুসলমান তুমির দ্বৈতবাদকে পরিহার করে আমাদের নিজেদের মধ্যেকার রক্তবীজ অসুরকে নিধন করার কথা বলে এই তত্ত্ব।

আরো পড়ুন দেব দেবী মহাদেব আছেন, সত্যান্বেষী নিরুদ্দেশ

হে সুধী পাঠক, বাংলা সিনেমায় রক্তবীজ ছবিটি এক বিপজ্জনক প্রবণতার সূচনা করেছে। ভয় হয়, এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্য পরিচালকরাও আগামী কয়েক মাসে রক্তবীজপ্রতিম একাধিক বিভেদসৃষ্টিকারী, উস্কানিমূলক ছবি বানাতে উদ্যোগী হবেন। অদূরেই ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন। বোঝাই যাচ্ছে এই ধরনের ছবিতে অর্থ লগ্নি করার জন্য বেশ কিছু মগনলাল মেঘরাজকে একত্রিত করা হয়েছে। এই মুহূর্তে রক্তবীজ ছবিটিকে ‘দ্য বিগেস্ট গেম-চেঞ্জার অফ বেঙ্গল’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

খেলাটি যে আসলে পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে সাম্প্রদায়িকতার নিভু নিভু আঁচকে গনগনে করে তোলা তা বুঝতে ফেলু মিত্তিরের প্রয়োজন নেই। সুতরাং, সাবধান হও পারমিতা, হেসো না এসব কথা শুনে।

লেখক একজন দর্শক ও কথাগরল প্রণেতা। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.