জঁ লুক গোদার চলে গেলেন। কিছুটা স্বেচ্ছাতেই নিজেকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে নিলেন তিনি। একজন বিদ্রোহীর মতই।

তাঁর এই স্বেচ্ছামৃত্যু – অ্যাসিস্টেড সুইসাইড – শেষ শটে কি দেখেছিলেন তিনি? ভাবছিলাম। শেষবার কি কিছু দেখতে চাইছিলেন জাম্প কাটে? হয়ত ঘরের আসবাব, হয়ত নিজের বোকামি ভেবে নিজের হাসি, হয়তো আনা কারিনার ছবি। কে জানে! গোদারের মৃত্যু বলে গেল, দক্ষিণপন্থার এই দুনিয়াতেও কারো কারো খাট চুল্লিতেও বার্স্ট করতে পারে। কখনও তার নাম হয় হারবার্ট, কখনো ঋত্বিক ঘটক, কখনো গোদার।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

গোদারের অবিচুয়ারিতে যা যা থাকতে পারে, আমি তার কিছু দিয়েই এই লেখা সাজাব না। কারণ তার জন্যে গোটা সভ্য সমাজ আছে। আমার এই লেখা হবে কিছুটা অসামাজিক ও গোদারসুলভ। কী কী থাকতে পারে গোদারের অবিচুয়ারিতে তার একটা তালিকা করা যায়। যেমন তিনি সিনেমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন, যে যে কারণে নিজেকে হনু ভাবছি সেইসব নিরাপত্তার পশ্চাদ্দেশে আগুন দিয়েছেন আজীবন, যা কিছু প্রত্যাশিত তাকে খিস্তি করাই ছিল তাঁর কাজ, তাঁর দুই ভাইয়ের নাম পাবলো পিকাসো ও ঋত্বিক ঘটক – এইসব ভাল ভাল কথা তো কাল থেকে অনেক বলা হল।

আমার বরং কাল থেকে মনে পড়ছে সেই গোদারকে, যিনি কান ফিল্মোৎসবের পর্দা ধরে ঝুলতে পারেন ফ্রান্স ১৯৬৮-র পরিপ্রেক্ষিতে। বলতে পারেন, “ওদিকে ছাত্ররা আন্দোলন করে মার খাচ্ছে আর এখানে ফ্রিজ শট আর লং টেক মারাচ্ছ?” গোদার চুপ করে ছিলেন বহুকাল। শেষ তাঁকে আমরা যখন দেখি তখনো তিনি অতিমারীতে ফেসবুক লাইভ ব্যাপারটা চুরুট টানতে টানতে দেখছেন আর মজা পাচ্ছেন। গোদার জানতেন, আমি-হীন একটা দুনিয়া আমি হয়ে উঠতে চাইছে আর সেখানে বারবার চূড়ান্ত অপমানিত কেউ কেউ নিজের কয়েকটা বই বা ফিল্ম নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। লড়াইটা কঠিন। কারণ একটা অসভ্য দুনিয়ায় বাঁচতে বাঁচতে আমাকেও অসভ্য হতে হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু ক্রমাগত অর্থ, পরিবার, ক্ষমতা, ক্ষমতার বিন্যাস, প্রযুক্তি, ঠকানো, ভোগবাদের চাপে কোনো মতে বেঁচে থাকতে থাকতেও “না” বলার লোক থাকবে এই গোদারহীন দুনিয়ায় – একথা তিনি জানতেন। দক্ষিণপন্থা জিতে গেলেও কেউ কেউ আছে যারা আজও অন্তত একটা ইঁট গাঁথতে পারি প্রতিপ্রস্তাবে, এখনো দর্শন এবং আদর্শবাদের অস্তিত্ব আছে। তাই তাঁর সর্বত্র বহিরাগত হয়ে বেঁচে না থাকলেও চলবে

গোদার দীর্ঘদিন ধরেই প্রচারের আলোর বাইরে ছিলেন। সিনেমার মহাকাব্য লেখা যাঁর নিজের হাতে, তিনি দেখছিলেন, একশো বছরেই এই মাধ্যমটি মারা যাচ্ছে। সমাজতন্ত্রও অপ্রাসঙ্গিক হচ্ছে দুনিয়ায়, যা বহু আগে তিনি বলছিলেন খতরনাকভাবে। গোদারের শেষ কাজগুলো এমনকি সিনেমা-উত্তর ডিজিটাল মাধ্যমেই বানানো। সিনেমা মারা গেছে একশো বছরেই, গোদার তবু বেঁচে ছিলেন নিজের মত। তিনি জানতেন ফোর জি, ফাইভ জির দুনিয়া তাঁর নয়। তাঁর সংলাপ মেনেই তাই অমরত্ব বরণ করে বিদায় নিলেন। আসন্ন ফাইভ জির দুনিয়ার গোদারকে বিশেষ দরকারও নেই। গোদারের উত্তরসূরী কখনই টারান্টিনো বা পানাহি হতে পারেন না। আসলে গোদার জানতেন, একটা দক্ষিণপন্থী দুনিয়া এরকমই হয়, সেখানে মূর্খরা সারাদিন বড়জোর “রেস্ট ইন পিস” লিখে একদিনের শোক পালন করবে তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে। তারপর মার্কস আর কোকা-কোলায় মেতে সব ভুলে যাবে।

উল্লেখ থাক, বাঙালি সত্তর দশকে গোদারকে চিনেছিল এমন দুজনের হাত ধরে, যাঁরা আজ এ দুনিয়ায় পরবাসী নানাভাবে — সুবিমল মিশ্র আর সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। আমরা যারা মার্কস ও কোকা-কোলার সন্তান, যাদের নিজের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার সাহস নেই, তারা গোদার অন গোদারকে পুজো করব বড়জোর। অন্যদিকে গোদার ভেবে ফেললেন, তাঁর জীবনের শেষ শট কী হবে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.