পরাধীনতার সুদীর্ঘ ইতিহাসকে মাথায় রেখে ব্রিটেনের মহারানির মৃত্যুতে ভারতবাসীর শোকপ্রকাশ করা কর্তব্য কিনা তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার সপ্তাহ খানেক আগেই আরেকটা খবরে পুলকিত হয়ে উঠেছিল আমাদের আহত ঐতিহাসিক আত্মাভিমান। খবরটা হল ভারতের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্রিটেনের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও “আড়াইশো বছর ধরে যারা আমাদের শাসন করেছে – বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছি আমরা। ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম স্থানে ওঠার চেয়েও বেশি আনন্দ এতেই… ভারতের পতাকা এতে আরও উঁচুতে উঠেছে।” প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এমনটা বলার পাঁচদিন পরেই ব্রিটেনের রানির মৃত্যুশোকে সেই পতাকা অর্ধনমিত রইল। যাক সে কথা। করোনা অতিমারীর ধাক্কা সামলে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর জ্বালানির আকাশছোঁয়া মূল্য নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি কেন হিমসিম এবং ভারতের ৭% বৃদ্ধির অঙ্ক এমতাবস্থায় সত্যিই কতটা স্বস্তিদায়ক, তা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক বরং।
বিশ্ব অর্থনীতির এই টলমলে অবস্থার পিছনে মুখ্য ভূমিকা কার? জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে মূল অপরাধী হওয়ার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রধান কৌশলগত হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস বা কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি। বিশ্বের বৃহত্তম খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক এবং তৃতীয় বৃহত্তম কয়লা রপ্তানিকারক হিসেবে রাশিয়ার অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তিই হল জীবাশ্ম জ্বালানি, আর রপ্তানির মূল গন্তব্য ইউরোপ। ২০২১ সালে রাশিয়ার মোট সরকারি ব্যয়ের ৪৫% এসেছিল তেল ও গ্যাস উৎপাদনজনিত আয় থেকে। রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির ৫০% যায় ইউরোপের দেশগুলোতে, ৩০% যায় চীনে। রাশিয়ার মোট প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির প্রায় ৭৪% এবং মোট কয়লা রপ্তানির ৩২% শতাংশ যায় ইউরোপের প্রথম সারির দেশগুলোতে। ছবিটা উল্টোদিক থেকে দেখলে ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট তেল আমদানির ৩৪% এবং মোট প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ৪৫% এসেছে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধে রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়া থেকে সমস্তরকম জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সে দেশের জীবাশ্ম জ্বালানির মূল উৎস যুক্তরাষ্ট্র নিজে এবং প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকো; রাশিয়ার সরবরাহ যৎসামান্য। কাজেই জো বাইডেনের দেশের পক্ষে যা সম্ভব, ইউরোপের পক্ষে তা অসম্ভব। ইউরোপ আমদানি বন্ধ করে দিলে রাশিয়ার অর্থনীতি যেমন ধাক্কা খায়, রাশিয়া রপ্তানি বন্ধ করে দিলে তেমনই অচল হয়ে পড়ে ইউরোপের দৈনন্দিন জীবন। উপরন্তু রাশিয়া থেকে আমদানি করা জ্বালানির উপরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোর নির্ভরতার মাত্রাও নানারকমের। ফলে ইউরোপিয় ইউনিয়নের পক্ষে কোনো একক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো আরও বেশি কঠিন। অবশেষে গত কয়েক মাসের চাপান উতোরের পর, প্রত্যাশামতই সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের মূল পাইপলাইন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয় রাশিয়া।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
জীবাশ্ম জ্বালানির এই আকস্মিক ঘাটতিতে কিছুটা ঠেকনা দেওয়ার উপায় হতে পারে পারমাণবিক শক্তি এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিগুলো। সামগ্রিকভাবে ২০২০ সালে যানবাহন, শিল্প ও গার্হস্থ্য প্রয়োজনের জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ মিলিয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের মোট চাহিদার ২২% পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির মাধ্যমে জোগানো সম্ভব হয়েছে। গত এক দশকে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে বিপুল বিনিয়োগের ফলে ২০২২ সালের প্রথমার্ধে জার্মানির মোট বিদ্যুতের চাহিদার ৪৯% পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে এগিয়ে এবং স্পেনের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় উৎস বায়ুশক্তি। কিন্তু এই মুহূর্তে তা পর্যাপ্ত নয়। শুকনো এবং অতিরিক্ত উত্তপ্ত গ্রীষ্মকালের জন্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন মার খেয়েছে। উপরন্তু ইউরোপ তথা বিশ্বের পারমাণবিক শক্তির বৃহত্তম উৎপাদক ফ্রান্সে ৫৬টা পারমাণবিক চুল্লির মধ্যে ৩২টা পাইপলাইনে ক্ষয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আপাতত বসে গিয়েছে। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর থেকে জার্মানি তার মোট ১৭টা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের আটটি বন্ধ করে দেয় এবং বাকিগুলোও ধাপে ধাপে ২০২২ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়ার কথা। যদিও বর্তমান জ্বালানি সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত দুটো কেন্দ্র বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নাকচ হয়েছে।
কাজেই সামগ্রিকভাবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারে যথেষ্ট এগিয়ে থাকলেও রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ইউরোপিয় নীতির মধ্যে বড়সড় গলদ রয়ে গিয়েছিল, যা যুদ্ধের আবহে প্রকট হয়ে পড়ল। আসন্ন শীতে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের ব্যবহার কমানোর জন্য নানারকম বিধিনির্দেশ জারি করছে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড। তার মধ্যে আছে গরম জলের সীমিত সরবরাহ, রাস্তার আলো নিভিয়ে রাখা, কাঠকয়লার ব্যবহার ইত্যাদি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতির হার ৯% ছাড়িয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে একটা গড় ব্রিটিশ পরিবারের গ্যাস ও বিদ্যুতের খরচ ৮০% বাড়তে চলেছে। ফ্রান্সে গার্হস্থ্য খাতে ব্যবহার্য বিদ্যুতের দাম বার্ষিক ৪%-এর বেশি বৃদ্ধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে ২৬ বিলিয়ন ইউরোর ভর্তুকি দিতে হয়েছে সরকারকে। সপ্তাহ খানেক আগে জার্মানিও ৬৫ বিলিয়ন ইউরোর প্রকল্প ঘোষণা করেছে মুদ্রাস্ফীতির মোকাবিলায়। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সীমা বেঁধে দেওয়া ছাড়াও এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছাত্রছাত্রী ও বার্ধক্য ভাতার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের জন্য এককালীন বরাদ্দ, রেল ও বাসের ভাড়ায় ভর্তুকি, বাড়িভাড়া ও সন্তানপালনের খাতে আর্থিক সহায়তা।
আরও পড়ুন ইউরোপে তাপপ্রবাহ: এ সমস্যা শুধু প্রথম বিশ্বের নয়
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আরও যে পদক্ষেপ নিয়েছে ইউরোপ তা হল সুদের হার বৃদ্ধি। ২০১২ সাল থেকে একটানা কমতে থাকার পর গতমাসে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নির্দিষ্ট করে ০.৭৫%। এ সপ্তাহে তা একলাফে দ্বিগুণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১.৫%, যা গত তিন দশকে সর্বোচ্চ এককালীন বৃদ্ধি। সুদের হার কীভাবে মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? কোনো দেশে সুদের হার বাড়লে একদিকে সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ে, অর্থাৎ বাজারের চাহিদা কমে। অন্যদিকে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বিনিয়োগের পরিমাণ কমে। দুটো কারণেই দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে। আবার ইউরোপে সুদের হার বাড়লে বিদেশি লগ্নিকারীদের পক্ষে ইউরোপের ব্যাঙ্কে টাকা রাখা লাভজনক। ফলত আন্তর্জাতিক মুদ্রার বাজারে ইউরোর চাহিদা বাড়বে এবং দামও বাড়বে। বস্তুত, সুদের হার বাড়ানোর ঘোষণার পরে ইতিমধ্যেই ইউরোর দাম বেড়ে গেছে। ইউরো শক্তিশালী হলে অন্যান্য দেশের পক্ষে ইউরোপ থেকে জিনিসপত্র আমদানি করা আরও ব্যয়সাপেক্ষ হবে। সুতরাং ইউরোপিয় উৎপাদনের আন্তর্জাতিক চাহিদাও কমবে। অর্থাৎ সুদের হার বৃদ্ধির ফলে আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক – দুরকম চাহিদাই কমবে। চাহিদা কমলে দাম কমবে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
আবার ইউরোর দাম বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরোপের উৎপাদিত জিনিসের চাহিদা কমলে ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর উৎপাদিত জিনিসের চাহিদা বাড়বে। জ্বালানি সংকটের জন্য ইউরোপের কাচ, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, অ্যামোনিয়া বা কস্টিক সোডা জাতীয় অন্যান্য রাসায়নিক উৎপাদন এমনিতেই নানা সমস্যার সম্মুখীন। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজেদের কলেবর ছোট করতে বা সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখতেও বাধ্য হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়া এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নের জোগান হ্রাস পাওয়ার সুযোগে ভারত আর চীনের ব্যবসার সুযোগ কিছুটা বাড়ছে, যদিও বিশ্ব বাজারে মন্দা দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি খাতে কোনো দেশই সুবিধা করতে পারবে না। এখন পর্যন্ত ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি চলতি বছরের শেষাশেষি ৩০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবার সম্ভাবনা। ভারতের অর্থনীতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল তার বিপুলায়তন আভ্যন্তরীণ চাহিদা। ইতিপূর্বে ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার সময়ে সেটাই ভারতীয় অর্থনীতিকে অনেকটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধের প্রশ্নে আপাত নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে রাশিয়া থেকে তেল ও কয়লা আমদানিও জারি রেখেছে ভারত। ফলে যুদ্ধ তথা জ্বালানি সংকটের আঁচ ভারতে ততখানি টের পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছরের তুলনায় এ বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের আভ্যন্তরীণ উৎপাদন ১৩.৫% বেড়েছে। কিন্তু বৃদ্ধির হারের পরিসংখ্যানে অনেকসময়েই কিছু সূক্ষ্ম ফাঁকি থেকে যেতে পারে।
করোনা অতিমারীর কারণে ভারতীয় অর্থনীতির যে প্রবল অবনতি হয়েছিল, অতিমারী সামলে ওঠার পর এই দ্রুত ও উচ্চ বৃদ্ধির হার অনেকটাই মূলত স্বাভাবিকতায় ফেরার লক্ষণ। তদুপরি এই বৃদ্ধির হার অনেকটাই একপেশে, কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে এই বৃদ্ধির ছায়া খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশের মোট উৎপাদন সাত কোটিরও কম জনসংখ্যার একটা দেশের মোট উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় উল্লাস প্রকাশ নিতান্ত অগভীর অভিব্যক্তি। তার বেশি কিছু নয়।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।