বিড়ির পাতায় দুঃখ। দুঃখ আঙুলে জড়ানো সুতোয়। যে সুতোয় বাঁধা পড়ে পাতা, বিড়ির মশলা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিড়ি শ্রমিক বিড়ির পাতার সঙ্গে সুখে দুঃখে জড়িয়ে আছেন। বিড়ি বেঁধেই সংসার চালান মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার প্রায় ১২ লক্ষ মহিলা। কয়েক বছর আগে তবু বলা যেত, সংসার চালাতে পুরুষ সদস্যদের পাশে দাঁড়াতে, নিজেরা স্বাবলম্বী হতে বিড়ি বাঁধেন মহিলারা। কিন্তু কোভিড পরবর্তী সময়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বিড়ি বাঁধাই মূল রোজগার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের পুরুষরা অনেকেই এখনো নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন না। কাজ জুটলেও কমেছে বেতন। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাজারে জিনিসপত্রের দাম। তাই বিড়ি বেঁধেই সংসার চালাতে হচ্ছে।

ধুলিয়ানের মর্জিনা বিবি, সেখ কুলসুমদের ঘুম ভাঙে বেশ ভোরে। সংসারের প্রতিদিনের কাজ সেরে, চুলা জ্বেলে শুরু হয় বিড়ি বাঁধা। মজুরির খোঁজ করলে দেখা যাবে ভয়ংকর শোষণের ছবি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার সাধারণত প্রতি বছর দুটো ন্যূনতম মজুরির তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকা অনুসারে প্রতি এক হাজার বিড়ি বেঁধে শ্রমিকদের ২৬৭ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ২০২১ সালে বিড়ি মালিক সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে হওয়া দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী মজুরি ঠিক হয় ১৭৮ টাকা। কিন্তু বাস্তবে আরও কম মজুরি পান শ্রমিকরা। মুর্শিদাবাদ জেলার কোনো প্রান্তেই নতুন চুক্তি কার্যকর হয়নি। জঙ্গিপুর মহকুমার জঙ্গিপুর ও ধূলিয়ান পৌরসভা এলাকায় এবং গঞ্জ লাগোয়া এলাকায় খুব বেশি হলে ১৭৫ টাকা মজুরি পান শ্রমিকরা। গ্রামে মজুরি কমে কোথাও ১৬০ টাকা, কোথাও ১৫০। সাগরদীঘির বেশ কিছু গ্রামে হাজার বিড়ি পিছু ১৩০ টাকা মজুরিতেও বিড়ি বাঁধছেন শ্রমিকরা। প্রতিবাদ করলে মালিকের মুনশিরা বলছেন, না পোষালে বিড়ি বেঁধো না; লোকের অভাব নেই। জঙ্গিপুর মহকুমার বাইরে লালগোলা, জলঙ্গী, ডোমকলের মতো এলাকায় মজুরি ১২০ টাকারও কম।

জঙ্গিপুর মহকুমার গ্রামে গ্রামে অভাবের সুযোগ নিচ্ছেন বিড়ি মালিকরা। বাড়তি যন্ত্রণা ‘ছাঁট-পট্টি’। সেটা কী? শ্রমিকদের মজুরি চুরি করার এক প্রাচীন কৌশল।

একজন বিড়ি শ্রমিক হাজার বিড়ি পিছু মজুরি পান। শ্রমিক ও মালিকের মাঝে থাকেন মুনশি বা কনট্রাক্টাররা। মুনশিরা শ্রমিকের পাড়ায় পাতা আর মশলা পৌঁছে দেন। সেদিনই আগে দেওয়া পাতা, মশলা অনুযায়ী বাঁধা বিড়ি বুঝে নেন। সেগুলো সংগ্রহ করে মুনশিরা নিয়ে যান কারখানায়। বিড়ি কারখানা বা ছোট ছোট ইউনিটে বিড়িগুলো প্যাকেটবন্দী হয়।

মালিক পক্ষের দাবি, প্যাকেটবন্দি করার সময় দেখা যায় অনেক বিড়িই ভালভাবে বাঁধা হয়নি। সেগুলো নাকি ফেলে দিতে হয়। সেজন্য আগেভাগেই কয়েক মুঠো অতিরিক্ত বিড়ি শ্রমিকদের দিয়ে বাঁধিয়ে নেওয়া হয়, কোনো মজুরি ছাড়াই । বিড়ি শ্রমিক যখন বিড়ি জমা করতে যান, এক হাজার বিড়ির সাথে কোথাও একশো, কোথাও দেড়শো অতিরিক্ত বিড়ি জমা নেওয়া হয়। অর্থাৎ ১১৫০ টা বিড়ি বাঁধলে শ্রমিক ১০০০ বিড়ির মজুরি পান। মজুরি ফাঁকি দিয়ে আদায় করা ছাঁট বিড়িও প্যাকেটবন্দি হয়ে পৌঁছে যায় বাজারে।

বিড়ি বাঁধার কাজ স্বাস্থ্যের পক্ষেও বেশ বিপজ্জনক। বিড়ি শ্রমিক মহল্লার অনেকেই শ্বাসকষ্টে ভোগেন। বিড়ি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের প্রশ্নও অবহেলিত। বিড়ি শ্রমিকদের নব্বই শতাংশই মহিলা। তাঁরা কখনো নিজের বাড়িতে, কখনো পাড়ার মোড়ে দল বেঁধে বিড়ি বাঁধেন। এই শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের কোনো দায়িত্ব নেন না মালিকরা।

বিড়ি শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের চিকিৎসার জন্য ধুলিয়ানের তারাপুরে ২০০০ সালে তৈরি হয়েছিল হাসপাতাল। শুধুমাত্র ধুলিয়ান বা সামসেরগঞ্জ নয়, পরিষেবা পেতেন পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড, মালদাবাসী মানুষও। যদিও এখন হাসপাতালের পরিষেবা কার্যত বেহাল। বিরাট জায়গা নিয়ে তৈরি হওয়া এই হাসপাতালে রয়েছে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, একাধিক ওয়ার্ড। অথচ দেখাশোনা করার জন্য দক্ষ কর্মী নেই। হাসপাতালে চারজন চিকিৎসক আছেন, কিন্তু ওষুধ নেই। ডাক্তার দেখাতে পারলেও সরকারি হাসপাতালের নিয়মানুযায়ী ওষুধ পান না শ্রমিকরা। নেই পর্যাপ্ত ল্যাব টেকনিশিয়ান, ইসিজি অপারেটর। বিড়ি শ্রমিকরা অনেকেই যক্ষ্মায় ভোগেন, কিন্তু নেই এক্স-রে অপারেটরও। ফলে শ্রমিকরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিতই রয়ে যাচ্ছেন। একই অবস্থা মুর্শিদাবাদ জেলার আরও তিনটে ডিসপেন্সারিতে।

অন্যদিকে বিড়ি শিল্পের অনেক মালিকই স্বাস্থ্যকে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, গড়ে তুলছেন বেসরকারি ক্লিনিক থেকে হাসপাতাল — সবই। বিড়ি মালিকদের মুখে প্রায়শই শোনা যায় বিড়ি শিল্প চরম সংকটে রয়েছে। যদিও বিড়ি শিল্পের মালিকদের সম্পত্তির খতিয়ান দেখলে তা মনে হয় না।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন বিড়ি শিল্পের মালিক জাকির হোসেন, ভোটে জিতে বিধায়কও হয়েছেন। শিব বিড়ি কোম্পানির মালিক তিনি। তিনি নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় জানিয়েছিলেন ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে তাঁর আয় ৯ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। ওই হলফনামা থেকেই জানা যায়, ২০১৬-২০১৭ আর্থিক বর্ষে জাকিরবাবু আয় করেছেন ৩ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে জাকির হোসেনের স্ত্রীর আয় ছিল ১ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা। তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য ২৭,৭৯,৯০,২৬২ টাকা। স্থাবর সম্পত্তির মূল্য ১৪,৯২,২৮,৭৪১ টাকা।

বিধানসভা নির্বাচনে সামসেরগঞ্জে কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন বিড়ি শিল্পের আরেক মালিক জৈদুর রহমান। তাঁর হলফনামা অনুযায়ী অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য ৩ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা আর স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি ৪ লক্ষ টাকা। ২০১৯-২০ সালে জৈদুরবাবুর আয় ছিল প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা।

জঙ্গিপুরের সাংসদ জৈদুরবাবুর দাদা খলিলুর রহমান ২০১৯ সালে দাখিল করা হলফনামায় জানিয়েছিলেন, ২০১৭-১৮ সালে তাঁর আয় ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা, ২০১৬-১৭ সালে আয় ছিল প্রায় ৮৯ লক্ষ টাকা। ২০১৯ সালে খলিলুরবাবুর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা। স্থাবর সম্পত্তি দেখিয়েছেন প্রায় ২ কোটি টাকার।

স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিড়ি মালিকদের সম্পত্তির পরিমাণ। বিড়ি ছেড়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন তাঁরা, লাথি পড়ছে বিড়ি শ্রমিকদের পেটে।

শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির চিত্রটা কিন্তু করুণ। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ২০২১ সালে তাঁদের মজুরি বেড়েছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মজুরি বেড়ে হয়েছিল ১৫২ টাকা। সেই মজুরি চালু হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের বৈঠকে ঠিক হয় ২৬ টাকা মজুরি বাড়বে হাজার বিড়ি পিছু। নতুন মজুরি ১৫২ টাকা থেকে ২৬ টাকা বেড়ে হয় ১৭৮ টাকা। কিন্তু সেই মজুরিও পাচ্ছেন না শ্রমিকরা।

সামসেরগঞ্জের বিড়ি শ্রমিকরা জানাচ্ছেন, ১৭৫ টাকা মজুরি মিললেও সপ্তাহে বড়জোর পাঁচ দিন কাজ পাওয়া যাচ্ছে। আবার মোড়গ্রামের বিড়ি শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছেন ১২০ টাকা। সাগরদীঘির বালিকা, কাবিলপুর এলাকায় ১৫০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন বিড়ি শ্রমিকরা।

এই টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ থেকে নুন তেলের যোগান সবটাই করতে হচ্ছে বিড়ি শ্রমিকদের। সরকারি নজরদারির অভাবই মজুরির এই রকমফেরের কারণ। বিড়ি শ্রমিক সংগঠন এবং মালিকদের মজুরি সংক্রান্ত বৈঠকে কোনো সরকারি প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। বেশ কয়েক বছর হল রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত। রাজ্য সরকারের সমস্ত ব্লক এবং পৌরসভা এলাকায় শ্রম দপ্তরের অফিস রয়েছে, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য রয়েছেন সরকারি আধিকারিকরা। কিন্তু বিড়ি শ্রমিকদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

আরো পড়ুন ডানলপ শ্রমিকের অন্তহীন প্রতীক্ষা আজও শেষ হল না

অবশ্য নেওয়া সহজ নয়। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের জঙ্গিপুর এলাকার সাংগঠনিক সভাপতি সাংসদ খলিলুরবাবু নিজে বিড়ি শিল্পের মালিক। জাকিরবাবু জঙ্গিপুরের বিধায়ক, এক সময় শ্রম দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। সুতির বিধায়ক ইমানি বিশ্বাসও বিড়ি শিল্পের মালিক। সরকার এবং মালিক এখানে কার্যত একই পক্ষ।

শুধু মজুরি নিয়ে নয়, প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়েও বিড়ি শ্রমিকরা চরম অবহেলার শিকার। ১৯৭৭ সালে তাঁরা প্রফিডেন্ট ফান্ডের আওতায় আসেন। কিন্তু এখন অবধি বেশিরভাগ বিড়ি শ্রমিকেরই কোনো পিএফ নেই। পরিচয়পত্রই নেই অধিকাংশ শ্রমিকের। পিএফ জমা করতে উদ্যোগ নিচ্ছে না মালিক পক্ষও। বিড়ি শ্রমিক সংগঠক মহম্মদ আজাদ জানাচ্ছেন, রাজ্যে ২২ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক আছে। তার মধ্যে পিএফ আছে মাত্র ৩ লক্ষ ৬৮ হাজার শ্রমিকের। পিএফ না পাওয়ায় একটা বয়সের পর এঁদের অনাহারে মরতে হয়।

বিড়ি শ্রমিকরা আশংকা করছেন এখন যেটুকু সুযোগ আছে, সেটুকুও থাকবে না। তারাপুর বিড়ি হাসপাতাল ইএসআইয়ের আওতায় যাওয়া নিয়ে আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। শ্রমিকদের দাবি, সমস্ত বিড়ি শ্রমিককে ইএসআইয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ইএসআই (এমপ্লয়িজেজ স্টেট ইনশিওরেন্স) বাবদ অর্থ দিতে হবে সরকার এবং মালিকপক্ষকে।

মতামত ব্যক্তিগত। তথ্যের দায় লেখকের।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।