মাঝে বেশ কিছুদিন শ্রীলঙ্কায় চরম ডামাডোল চলার পর সম্প্রতি সরকার বদলেছে। সে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দীনেশ গুণবর্ধনে। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে এই খবরের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের এক বিশেষ পর্বের দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে।

দীনেশ গুণবর্ধনে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতৃ-পিতৃব্য এবং পরিবারের অনেকেই শ্রীলঙ্কায় স্মরণীয় নাম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তাঁদের অবদান কম নয়। কারণ দুই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল অঙ্গাঙ্গীকভাবে জড়িত, দুইই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই – যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল মতাদর্শভিত্তিক এক বৃহত্তর সংগ্রামও।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সময়টা গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়ার দিক। সিংহলের সমাজ ও রাজনীতিতে উদয় হয়েছিল উজ্জ্বল একঝাঁক তরুণ তরুণীর। অধিকাংশই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে, বিলেত-আমেরিকা থেকে ঘুরে আসা। উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী, সেইসঙ্গে আদর্শবাদী। কেউ বা লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের প্রাক্তনী, যা তখন ছিল বামপন্থীদের ঘাঁটি। স্বদেশের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা এঁদের পীড়িত করেছিল, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এঁরা তৎপর হলেন। সকলেই সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ। ছাত্রাবস্থায় এঁদের যাতায়াত ছিল লন্ডনের ইন্ডিয়া লীগ অফিসে। হ্যারল্ড ল্যাস্কি, জওহরলাল নেহরু, জয়প্রকাশ নারায়ণ, মিনু মাসানি, ভি কে কৃষ্ণ মেনন, রজনীপাম দত্ত, শাপুরজি সাকলাৎওয়ালা প্রমুখের সঙ্গে তখন নিয়মিত যোগাযোগ। সেখানেই সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন তাঁরা। ফিরে এসে দেখলেন সিংহলে এক রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ম্যালেরিয়া মহামারীতে সেবার কাজ, সুরিয়া-মাল আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করতে লাগলেন। এর সঙ্গে চলতে থাকল সিংহলের চা ও রবার বাগিচার নিপীড়িত শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের দাবিদাওয়া আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। একইসঙ্গে অন্যান্য শিল্পেও শ্রমিক আন্দোলন চলল। এছাড়া স্বাধীনতার লড়াই তো ছিলই। (ভারতে যেমন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চা-বাগানে আদিবাসী কুলি পাচার করা হত, শ্রীলঙ্কাতেও একইভাবে ভারত থেকে তামিল কুলি রপ্তানি করা হত)। তাঁরা ১৮ ডিসেম্বর ১৯৩৫ তারিখে গঠন করলেন নতুন রাজনৈতিক দল লঙ্কা সম সমাজ পার্টি (এলএসএসপি)। দলের প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন ফিলিপ গুণবর্ধনে, লেসলি গুণবর্ধনে, ডঃ এন এম পেরেরা, কলভিন আর ডি সিলভা, ডাঃ এস এ বিক্রমসিংহে, রবার্ট গুণবর্ধনে, এডমন্ড সামারাকোড়ি, ভার্নন গুণশেখর, সেলিনা পেরেরা, ডোরিয়েন বিক্রমসিংহে প্রমুখ।

ফিলিপ গুণবর্ধনেকে সিংহলি সমাজবাদের জনক বলা হয়ে থাকে। ফিলিপ ও কুসুমাসিরি গুণবর্ধনের তৃতীয় সন্তান আজকের প্রধানমন্ত্রী দীনেশ। ফিলিপেরই ভাই রবার্ট এবং ভাগ্নি ভিভিয়েন। ভিভিয়েনের স্বামী লেসলি গুণবর্ধনে দুর্দান্ত এক সংগঠক। দলের জন্মলগ্ন থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত একটানা সাধারণ সম্পাদক। পুরোদস্তুর এক রাজনৈতিক পরিবার, তবে সবার কথা এই প্রতিবেদনে না এলেও চলবে। দীনেশের মা কুসুমাসিরি এবং পিসতুতো দিদি ভিভিয়েনও বিশিষ্ট সমসমাজী নেতা।

স্থাপনার সঙ্গে সঙ্গেই এলএসএসপির দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকে। লাগাতার শ্রমিক আন্দোলন, সামাজিক কার্যক্রম, যুব জাগরণ, সেইসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রচার। দলের প্রথম ইস্তাহারেই তিনটি লক্ষ্য স্পষ্ট: ১) পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন; ২) উৎপাদন, বন্টন ও বিনিময় ব্যবস্থার জাতীয়করণ; ৩) জাতি, জাতপাত, ধর্ম বা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য থেকে উদ্ভূত অসাম্যের বিলোপ। দলের অবস্থান জানিয়ে বলা হয়েছিল, এলএসএসপি কোনো কমিউনিস্ট দল নয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শ্রেণিচরিত্র নিয়ে সমসমাজীদের নানা প্রশ্ন থাকলেও কংগ্রেসের মধ্যেকার গোষ্ঠী কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টির (সিএসপি) সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল মতাদর্শের ভিত্তিতে। সিএসপির তরফে তখন কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় সমসমাজীদের কর্মসূচিতে নিয়মিত যোগ দিয়েছেন।

এলএসএসপির মধ্যে তখন মার্ক্সীয় ও লেনিনবাদী ধ্যানধারণা ছাড়াও বাড়ছে ট্রটস্কিবাদের প্রতি ঝোঁক। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে উত্থান ঘটেছে ট্রটস্কিপন্থী টি গ্রুপের। কমিন্টার্নের পপুলার ফ্রন্ট তত্ত্ব, স্পেনের গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত ভূমিকা, মস্কো ট্রায়াল, মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি প্রভৃতি ঘটনায় তারা ইতিমধ্যেই সোভিয়েত নেতৃত্বের প্রতি বিরূপ। ’৩৯ সালের শেষদিকে এরা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে। একই সঙ্গে ডাঃ বিক্রমসিংহে, ডোরিয়েন সহ অন্যান্য স্তালিনবাদীরা দল থেকে বহিষ্কৃত হন। ফলে এলএসএসপি তখন পুরোপুরি একটি ট্রটস্কিপন্থী দল। (তার আগের বছরই অবশ্য ট্রটস্কিবাদীরা গঠন করে ফেলেছেন চতুর্থ আন্তর্জাতিক)। ঠিক এই সময়েই সেলিনা পেরেরাকে লেখা লিওন ট্রটস্কির একটি দিকনির্দেশকারী চিঠি সমসমাজীদের যথেষ্ট উদ্দীপ্ত করেছিল।

শীলা
লিওন ট্রটস্কির চিঠির বয়ান

সেলিনা পেরেরার (জন্ম ১৯০৯) কথায় আসা যাক। ম্যালেরিয়া মহামারীতে সেবা ও সুরিয়া-মাল আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী সেলিনা এলএসএসপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং দলের প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সম্পাদকও হয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে দলের অন্যতম শীর্ষনেতা ডঃ এন এম পেরেরার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৩৮ সালে বিলেতে পাড়ি দেন লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে পড়াশোনা করতে। সেখানে ইউরোপের ট্রটস্কিপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় স্নাতক হয়ে পরের বছর আমেরিকায় যান। নিউ ইয়র্কে উত্তর আমেরিকার ট্রটস্কিবাদী দল সোশালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত হন। ইচ্ছে ছিল মেক্সিকোয় গিয়ে ট্রটস্কির সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু ভিসা সমস্যায় তা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর সাথে পত্র মারফত যোগাযোগ রেখেছিলেন।

ভারতে ট্রটস্কিপন্থীদের সংগঠন কিন্তু মোটেও সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন এবং কয়েকটি ছাত্রগোষ্ঠীর মাধ্যমে সংগঠন গড়ে উঠছিল। আর ছিলেন কিছু শহুরে মেধাবী মানুষজন। কলকাতাতেও তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে। ছাত্রাবস্থায় অনুশীলন সমিতি প্রভাবিত এবিএসএ (অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন) করে আসা কমলেশ ব্যানার্জী, ইন্দ্রদত্ত সেন সেখানে প্রধান মুখ। এঁরা তৈরি করেছেন রিভোল্যুশনারি সোশালিস্ট লিগ। আর ছিলেন বিলেতে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতালব্ধ, সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করা অজিত রায় মুখার্জি। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় ফিরে অল্প কিছুদিন থেকে ফের বিলেতে গিয়ে সেখানে শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেন, কালক্রমে ব্রিটেনের আরসিপি – ফোর্থ ইন্টারন্যাশনাল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও হয়েছিলেন। কলকাতায় তখন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সম্পাদনা ও সত্যপ্রসন্ন দত্তের কর্মোদ্যোগে প্রকাশিত হচ্ছে সাহিত্যপত্র পূর্ব্বাশা। সেই পত্রিকাকে ঘিরে ট্রটস্কিপন্থীদের ভিড়।

১৯৩৯ সালের ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিলেন লেসলি গুণবর্ধনে। পরের বছর রামগড় কংগ্রেসে এলেন ফিলিপ গুণবর্ধনে। ফেরার পথে কলকাতায় কমলেশের সঙ্গে পরিচয়। কলকাতা আর কলম্বোর মধ্যে যোগাযোগ দ্রুত বাড়তে লাগল। ইতিমধ্যে চা ও রবার বাগিচার মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলন, হরতাল ইত্যাদির জেরে শ্রীলঙ্কায় এলএসএসপির কাজকর্মের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। চলছে ব্যাপক ধরপাকড়। শীর্ষনেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ফিলিপ, ডঃ পেরেরা, কলভিন, এডমন্ড। লেসলি পলাতক। অনেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। তা সত্ত্বেও আন্দোলন দমানো গেল না। এই অবস্থাতেই ক্যান্ডিতে দলের দুটি গুপ্ত সম্মেলনে কারাকর্মীদের ‘সহযোগিতায়’ জেলবন্দি চার শীর্ষ নেতা রাতের অন্ধকারে যোগ দিয়েছিলেন। এ দেশ থেকে কমলেশ ব্যানার্জিরাও ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয়: ১) শ্রীলঙ্কার বিপ্লব ভারতীয় বিপ্লবেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং তার উপর নির্ভরশীল; ২) বৃহত্তর একটি দল গঠন, যা সর্বভারতীয় একটি [ট্রটস্কিবাদী] দলের প্রত্যাশা মেটাবে এবং এলএসএসপি সেই দলের সিংহলি শাখা হিসাবে কাজ করবে।

শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি পর্ব। তখন প্রশাসনিক দমনপীড়নে অগুনতি সমসমাজী নেতাকর্মী ভারতে পালিয়ে আসছেন। কলম্বো হারবারে জাপানি বোমাবর্ষণের পরপরই ৭ এপ্রিল, ১৯৪২ জেল থেকে পালালেন চার শীর্ষ নেতা। পরের মাসে তেরি হল সেই ঈপ্সিত মঞ্চ – বলশেভিক-লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া, সিলন অ্যান্ড বার্মা (বিএলপিআই)। এলএসএসপি মিশে গেল তাতে। চতুর্থ আন্তর্জাতিকের স্বীকৃতি মিলল। সিংহল থেকে পালিয়ে আসা নেতাকর্মীরা একযোগে কাজ করতে লাগলেন। এর আগেই ভারতের ট্রটস্কিবাদীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এবং আওয়াজ তুলেছিল “যুদ্ধে এক পয়সাও দেওয়া নয়, একজনকেও যুদ্ধে পাঠানো নয়।”

এর অব্যবহিত পরেই ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়। বিএলপিআই এতে সর্বাত্মক অংশ নিয়েছিল, সমসমাজীরাও। আত্মগোপনকারী সমসমাজী নেতারা ছদ্ম পরিচয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন, পালিয়ে বেড়িয়েছেন এখানে ওখানে। ফিলিপের নাম হয়েছিল গুরুস্বামী, ডঃ পেরেরার বিশ্বনাথ, কলভিনের গোবিন্দন। কে তিলক ছদ্মনামে লেসলির লেখা প্রকাশিত হতে থাকল। যা-ই হোক, ’৪৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এঁদের বহু নেতা কর্মী ধরা পড়লেন। তাঁদের সিংহলে ফেরত পাঠিয়ে জেলে রাখা হল। এঁদের মধ্যে ফিলিপ ও কুসুমাসিরিও ছিলেন। সঙ্গে তাঁদের প্রথম সন্তান, পাঁচমাস বয়স, ভারতে জন্মেছে বলে তার নাম রাখা হয়েছে ইন্ডিকা। তিনি আজকের প্রধানমন্ত্রী দীনেশের বড়দা, পরে শ্রীলঙ্কার নামী রাজনীতিক ও মন্ত্রী হবেন।

তখন কলকাতায় আত্মগোপন করে দলের কাজ চালাচ্ছেন সেলিনা, ভিভিয়েন ও কলভিন। এরপর ফিলিপ ও ড. পেরেরা এলএসএসপির পুনরুজ্জীবন ঘটালেন। অন্যদিকে লেসলি, কলভিন ও এডমন্ড বিএলপিআইয়ের সিংহলি শাখা হিসাবেই চলতে চাইলেন। নৌবিদ্রোহের সমর্থনে কিংবা আইএনএ বন্দীমুক্তির দাবিতে ভারতে বিএলপিআইয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পরপরই সিংহলও স্বাধীন হল, তবে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস পেয়ে। এদিকে বিএলপিআই ভারতের সোশালিস্ট পার্টিতে মিশে যাওয়ায় লেসলিদের বলশেভিক সমসমাজ পার্টি চতুর্থ আন্তর্জাতিকের স্বীকৃতি পেল (১৯৪৮)। তবে সমসমাজীদের দুপক্ষের পুনর্মিলন ঘটে ১৯৫০ সালে। তখন ফিলিপ গুণবর্ধনে এই সংযুক্তি মেনে নিতে না পেরে দল ছাড়েন।

ততদিনে সমসমাজী নেতারা সকলেই স্বদেশে কারাবাস শেষে ফের সক্রিয় হয়েছেন। কালক্রমে একেকজন হয়ে উঠেছিলেন সিংহলের বামপন্থী রাজনীতির তারকা। স্বদেশে ফেরেননি শুধু একজন – সেলিনা পেরেরা। কেন? ভারতের প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের রাজনীতিতে তাঁর আশাভঙ্গ হয়েছিল? তাঁর সমসমাজী সতীর্থদের মধ্যেকার বিভাজন অথবা তাদের কোনো ‘রূপান্তর’ তাঁকে ব্যথিত করেছিল? কলকাতা তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত ছাড়োর ঝোড়ো সময়ে। কলকাতার বামপন্থী চরিত্র কি তাঁকে এতটাই টেনেছিল যে এই শহর হয়ে উঠেছিল তাঁর স্বভূমি? স্বনাম পরিত্যাগ করে, আত্মগোপনকালে ব্যবহৃত নামেই বাকি জীবন কাটিয়েছেন সেলিনা। শীলা পেরেরা – এই নামেই সকলে তাঁকে জেনেছে। বিএলপিআই সোশালিস্ট পার্টিতে মিশে গেল, শীলা বাংলার প্রাদেশিক কর্মসমিতির সদস্য হলেন। দলে ভাঙাগড়া চলল, ’৫২ সালে গান্ধীবাদী প্রজা সোশালিস্ট পার্টি (পিএসপি) গঠনের সময়ে শীলার নেতৃত্বে দলের মার্ক্সবাদী একটি অংশ পিএসপিতে গেল না। আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখল। ’৫৮ সালে ট্রটস্কিবাদী তিনটি দল মিলে তৈরি হল রিভোল্যুশনারি ওয়ার্কার্স পার্টি (আরডব্লুপি), শীলা কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হলেন। এই দল ’৬০ সালে আরসিপিআই (কুমার) দলে মিশে গেল (অবশ্য চীন-ভারত যুদ্ধ নিয়ে মতপার্থক্যে বিযুক্তি ঘটে)। তারপর থেকে শীলা পেরেরার রাজনৈতিক কার্যক্রম স্পষ্ট জানা যায় না। তবে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করে গেছেন হিন্দ মজদুর সভাতেই।

গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ মধ্য কলকাতার একটি প্রশস্ত রাস্তা। সেই রাস্তারই পি-১৩ নং বাড়ি। দোতলা। শক্তপোক্ত। চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধ থেকেই সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির গুণীজনদের আনাগোনা। দোতলায় একদিকে আতাউর রহমানের ফ্ল্যাটে চতুরঙ্গ পত্রিকার দপ্তর, হুমায়ুন কবীরের পৃষ্ঠপোষকতায়। পাশেই একজোড়া ফ্ল্যাটে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্যপ্রসন্ন দত্তের বাস, সেইসঙ্গে পূর্ব্বাশা এবং কৃষিভিত্তিক সংস্থা মডেল ফার্ম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির অফিস। একতলায় পূর্ব্বাশা প্রেস। ওই দশকের শেষদিক থেকেই পূর্ব্বাশার পড়তি অবস্থা। ক্রমে মডেল ফার্ম বন্ধ হল, প্রেস নিলাম হয়ে গেল। একটা ফ্ল্যাট আগেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল, বাকি অংশ থেকে উচ্ছেদ হতে হল। অসুস্থ সঞ্জয়বাবুকে নিয়ে সত্যপ্রসন্ন দত্ত এ বাড়ি ছাড়লেন। সালটা ১৯৫৭। ততদিনে সে বাড়ির ঠিকানা হয়ে গেছে – ৫৪, গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ। ইতিমধ্যে এখানেই একটি ঘরে ভাড়ায় এসেছেন শীলা পেরেরা। সত্যপ্রসন্ন দত্তের স্মৃতিচারণে: “…ডঃ পেরেরা [শ্রীলঙ্কার] অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ডঃ পেরেরার স্ত্রী শ্রীমতী শীলা পেরেরা ৪০-এর দশক থেকে আমৃত্যু কলকাতায় কাটিয়ে গেছেন। যে কোন কারণেই হোক তিনি স্বামীর সঙ্গে থাকতেন না। শীলা আমাদের বিশিষ্টা বান্ধবী ছিলেন। … দু-একজন ছাত্রীকে ইংরেজী পড়িয়ে খরচ চালাতেন। পঞ্চাশের দশকেই বোধ হয় পূর্ব্বাশা এবং ‘চতুরঙ্গ’-এর গণেশ অ্যাভিনিউর বাড়িতে শীলা একটি বড় ঘর ভাড়া করেছিলেন, সম্ভবত সেখানেই আশির দশকে তাঁর মৃত্যু হয়।” অশোক মিত্রের লিখনে “গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউর ওই দালানেই পাশের অন্য-একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন শিলু পেরেরা, শ্রীলঙ্কার একদা ডাকসাইটে ট্রটস্কিপন্থী নেতা এন এম পেরেরার একদা-সহধর্মিণী, এন এম পেরেরা একটা সময় সিরিমাভো বন্দরনায়েকের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। শিলু পেরেরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পুলিশ এড়িয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন, যুদ্ধ শেষ হলেও কলকাতাতেই থেকে গেলেন, হয়তো কলম্বোর খেয়ালি মেজাজের সঙ্গে কলকাতার কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই।”

আরো পড়ুন ফরাসি বিপ্লবের বাঙালি সৈনিক ১
ফরাসি বিপ্লবের বাঙালি সৈনিক ২

ডঃ পেরেরা ছিলেন শ্রীলঙ্কার লোকপ্রিয় নেতা। কলম্বোর মেয়র, সংসদে বিরোধী দলনেতা, দেশের অর্থমন্ত্রী প্রভৃতি অনেক মাইল ফলক পেরিয়েছেন। জীবনোপান্তে সে দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কিন্তু সেলিনা? জীবনের শেষ সাড়ে চার দশকের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছেন মোটে একটিবার। জীবনের সফলতা ও চাকচিক্য সরিয়ে রেখে একটি ভাড়ার ঘরে থেকে ইংরেজির টিউশানি করে নিজের রাজনৈতিক সাধনায় নিরত থেকেছেন মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের প্রতি অটল প্রতীতি নিয়ে, লেনিন ও ট্রটস্কির পথরেখা বেয়ে। মারা যান ১৯৮৬ সালে। বিস্ময়ের যে কলকাতার মার্ক্সীয় বুধমণ্ডলী তাঁকে কোনও জায়গা দিলেন না।

ট্রটস্কির সেই পত্রের বয়ান আজ সহজলভ্য। কিন্তু লেফাফার অন্তর্গত কাগজ-কালির সেই চিঠিখানি? সেলিনা, ওরফে শীলা, কি সেটি তাঁর দলকে দিয়েছিলেন? নাকি গণেশ অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে সন্তর্পণে সেই চিঠির হেফাজত তিনি করে গিয়েছেন আমৃত্যু?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. সবটাই নতুন করে পাওয়া। কলকাতার বাম পরিবেশের অজানা ইতিহাস, এমনটা আগে জানা ছিল না। লেখককে অশেষ ধন্যবাদ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.