“নাম?”

“লুই বেনোয়া জামর। জন্মস্থান বাংলা, ভারতবর্ষ।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আজ থেকে সোয়া দুশো বছর আগের কথা। স্থান ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। রেভলিউশনারি ট্রাইব্যুনালের বিচারসভায় আসামীর নাম কাউন্টেস দ্যু ব্যারি। এককালের ডাকসাইটে সুন্দরী, রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের শেষ ‘স্বীকৃত’ উপপত্নী। উপরোক্ত পরিচিতিটি তাঁরই তরুণ ক্রীতদাস, এবং সম্ভবত, ফরাসি বিপ্লবের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকা একমাত্র বাঙালির।

এতটুকু পড়ে কল্পকাহিনী বা ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস ভাবলে পাঠকের দোষ নেই। লুই বেনোয়া জামর (Louis Benoit Zamor)-এর জীবন উপন্যাসের চেয়ে কম কিসে? অর্ধেক বিশ্ব পরিক্রমার জীবনের অধিকাংশটাই ঢাকা অজানা আঁধারে, মাঝেমাঝে যেটুকু আলোয় আসে, সেটুকুই চমকে দেবার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য স্বদেশে জামরের পরিচিতি চিরকালই নেহাত কম। সেটা বদলের ইচ্ছাতেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।

এই ইতিহাসের শুরু ১৭৭০-এর দশকে ধরাই ভাল। ততদিনে জামর ফ্রান্সের মাটিতে পা রেখেছে, আর ক্রীতদাসও নয় আইনত। তার আগে জামরের অবস্থা ঠিক কী ছিল, তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। তার জন্ম সম্ভবত ১৭৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে বা তার আশেপাশে। তার আসল নাম যেমন অজানা, তেমনই বহুবার তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে আফ্রিকান হিসাবে। কালা আদমি, সে এশিয়ারই হোক বা আফ্রিকার, ফারাক কী? (অবশ্য সে সিদ্দি বা হাবসি বংশোদ্ভূত হতে পারে, কিন্তু ভারতের পূর্ব উপকূলে তাদের উপস্থিতি ছিল নেহাতই নামমাত্র।) নবাবি বাংলার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তাকে ক্রীতদাস হিসাবে কিনেছিলেন এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন, তারপর মাদাগাস্কারের ফরাসি দাসব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে ফ্রান্স। ডিউক অফ রিচেলিউ তাকে উপঢৌকন হিসাবে দিলেন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের উপপত্নী কাউন্টেস দ্যু ব্যারি ওরফে জিন বেকু (Jeanne Becu)-কে। আর তখনই শিশু জামর হঠাৎই ক্রীতদাসবাহী জাহাজের খোল থেকে ঢুকে পড়ল ইউরোপীয় সম্ভ্রান্ত সমাজের অন্দরমহলে, ভৃত্য হলেও।

তবে এটা উত্তর আমেরিকার তুলো বা আখ খেত নয়, প্রাচ্যের সুলতানের প্রাসাদও নয়। তাই জামরের ভূমিকাও চিরপরিচিত ক্রীতদাসের ভূমিকার মতো নয় এখানে। সে বরং ‘শো পিস’: অজানা এক বন্য দেশ থেকে আগত রহস্যময় জীব। জামর শুধু একা নয় এক্ষেত্রে। ইউরোপের নানা দেশের অভিজাত ধনী বা রাজপুরুষদের এরকম ‘দুর্লভ খেলনা’ সংগ্রহ করার উদাহরণ কম নেই সেই যুগে। যত দুর্লভ পোষ্য, ততই তাদের পালকদের খ্যাতি ‘প্রকৃত ধনী’ হিসাবে। রাজা ষোড়শ লুই যেমন এরকমই একটি পোষ্য রেখেছিলেন — সেনেগাল-জাত জাঁ আমিলকার। মালকিন হিসাবে কাউন্টেস দ্যু ব্যারিও কম কিছু নন। তাই ১৭৭০ সালে জামরের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষার (baptism) উৎসব হল বিশাল জাঁকজমক করে, ভার্সেইয়ের নতর দাম চার্চে (প্যারিসের নতর দাম নয়)। নামের আগে লুই বেনোয়াও জুড়লো সেদিনই। গডমাদারের ভূমিকায় মাদাম দ্যু ব্যারি স্বয়ং। আর গডফাদার? রাজকুমার লুই ফ্রাঁসোয়া জোসেফ দ্য বুর্বোঁ, রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের জ্ঞাতি ভাই। অবশ্য মাদাম দ্যু ব্যারির প্রিয় পোষ্যের জন্য এ আর আশ্চর্য কী?

জামরের মালকিন কাউন্টেস জিন দ্যু ব্যারি নিজেও চরিত্র হিসাবে যথেষ্টই রঙিন। তাঁর উল্কার গতিতে উত্থান, দ্রুত পতন এবং গোটা সময়জুড়ে প্যারিসের গসিপ মহলের সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকা — সবই প্রায় একইরকম চমকপ্রদ। জিন বেকুর জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৭৪৩ সালে পূর্ব ফ্রান্সের Vaucouleurs শহরে। মা অ্যানি বেকু পেশায় দর্জি। পিতা সম্ভবত জাঁ জাক গোমর্ড, খ্রিস্টান পাদ্রী। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের সন্তান জিনের ছোটবেলাটা কেটেছিল অর্থকষ্টে। তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে অ্যানি প্যারিসে এসে ওঠেন পরিচিত মঁসিয়ে ডুমনসো-র সাহায্যে। ডুমনসোই অ্যানিকে কাজও জোগাড় করে দেন। অ্যানি রাঁধুনির কাজ পান সে যুগের বিখ্যাত ইতালীয় রূপোপজীবিনী ফ্রান্সেসকা ওরফে ল্য ফেদেরিকার বাড়িতে। জিন কিছুদিন পর স্থান পান সঁ আউরের কনভেন্টে। শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষার দায় চার্চের, যাতে ‘সভ্য নারী’ তৈরি করা যায়। তবে বছর পনেরো বয়সে স্বাধীনচেতা জিনকে কনভেন্ট ছাড়তে হয় উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগে।

অনিশ্চয়তার জীবনে পথই একমাত্র পথ তখন। মাঝে দু-একটা কাজ পেলেও বিতর্কে জড়িয়ে টেকেনি একটাও। এমন সময় হঠাৎ একদিন পরিচয় রাজকর্মচারী কাউন্ট জাঁ ব্যাপতিস্ত দ্যু ব্যারির সাথে। পরিচয় গড়াল প্রণয়ে। কিন্তু দুজনের কাছেই সম্ভবত এ সম্পর্ক ছিল আরো উপরে ওঠার সিঁড়ি। জিন যেমন তুলনামূলক সুস্থ জীবনের পথ হিসাবে দেখলেন সম্পর্কটাকে, জাঁ-র কাছে জিন হয়ে উঠলেন রাজনৈতিক অস্ত্র। কাউন্ট দ্যু ব্যারির মাথায় ভাবনা তখন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের প্রধানা উপপত্নী মাদাম পম্পাদওরকে সরিয়ে এমন কাউকে বসানো, যার চাবি থাকে তাঁর হাতে। জিন ঠিক সেইরকমই। পরিকল্পনা সফল হওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু মার্শাল অফ ফ্রান্স, ডিউক অফ রিচেলিউ সহায় হলেন। ফলে বৃদ্ধ রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠলেন কিছুদিন আগেও পথে পথে ফেরা জিন বেকু — ততদিনে যিনি নাম বদলে কখনো জিন ভাউবার্নিয়ে, কখনো বা মাদমোয়াজেল লাঁজে।

কিন্তু রাজার অনুগ্রহ লাভ করলেই হল না শুধু, স্বীকৃতি পেতে গেলে বংশপরিচয় চাই। দ্যু ব্যারিই তার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর দাদা কাউন্ট গিয়াওমে দ্যু ব্যারিই জিনের পাণিগ্রহণ করলেন। বিয়ের জন্য জন্মের জাল শংসাপত্রও বানিয়ে ফেললেন জাঁ দ্যু ব্যারি। হঠাৎ করে অভিজাত পূর্বপুরুষ পেয়ে গেলেন জিন, কাউন্টেস পদমর্যাদার উপযুক্ত হতে যা চাই আর কি। জিন বেকু কাউন্টেস জিন দ্যু ব্যারি হবার পর রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের সাথে সম্পর্কেও আর কোন সামাজিক বাধা থাকলো না। অবশেষে ১৭৬৯ সালের ২২ এপ্রিল এক বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে রাজদরবারের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হলেন কাউন্টেস দ্যু ব্যারি।

সে যুগের ফরাসি রাজাদের প্রধান উপপত্নীদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ছিল অপরিমেয়। কাউন্টেস দ্যু ব্যারির পূর্বসূরি মাদাম পম্পাদওরই তো কার্যত সিংহাসনের পিছনে আসল ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বোড়ের চালে নতুন ক্ষমতা পেয়েও দ্যু ব্যারি নিজেকে অতটা জড়ালেন না রাজনীতিতে। বরঞ্চ বিলাসব্যসন আর শৌখিনতায় আবদ্ধ থাকল তাঁর মন। বৈভবে, ঠাট-বাটে যুবরানি মেরি আঁতোয়াঁনেতের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়েছেন জিন দ্যু ব্যারি। এমনকি পঞ্চদশ লুইয়ের মৃত্যুর পরও ফরাসি রাজকোষের টাকায় পৃষ্ঠপোষকতা করছেন একেবারে শ্রেষ্ঠ শিল্পী, স্বর্ণকার, ভাস্করদের। অভিজাত সমাজের যেকোনো উৎসব, পার্টির মধ্যমণি তিনি। বিলাসের বহরটা ঠিক কীরকম? যে সময়ে অভিজাত পরিবারগুলোর বার্ষিক খরচ ওই তিরিশ হাজার লিভরা (তৎকালীন ফরাসি মুদ্রা)-র আশেপাশে, সেই সময়ে মাদাম দ্যু ব্যারি একটি হীরকখচিত bodice বা জামা বানান সাড়ে চার লাখ লিভরা খরচ করে! তাঁর স্প্যানিয়েল কুকুর ডোরিনের গলার বকলেসে অবধি হীরে ও চুনি বসানো। কাউন্টেসের প্রিয় পোষ্য তথা শো পিস হিসাবে অধিকাংশ পার্টিতেই ঝলমলে পোশাকে উপস্থিত থাকতে দেখা যেত জামরকেও। বস্তুত, জামরের উপস্থিতি ও জীবন সম্পর্কে জানার অন্যতম বড় সূত্র এইসব অনুষ্ঠানের বর্ণনা।

কাউন্টেস জিন দ্যু ব্যারির অধীনে ঠিক কেমন ছিল জামরের জীবন? ফ্রান্সে এমনিতেই ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ। তাই জামরের ভূমিকা ছিল, খাতায় কলমে, কাউন্টেসের page বা বেয়ারার। তবে আগেই বলেছি, জামর ছিল শো পিস। তাই মাদাম দ্যু ব্যারির ফাইফরমাশ খুব একটা খাটতে হত না তাকে। বরং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিল কাউন্টেসের পার্শ্বচর হিসাবে। সেরকমই এক অনুষ্ঠানে জামরের পোশাকের বর্ণনা এরকম: “গোলাপি ভেলভেটের জ্যাকেট এবং ট্রাউজার, মাথায় সফেদ পাগড়ি, কোমরে ছোট তরবারি”। দ্যু ব্যারির পার্শ্বচর হিসাবে সমাজের অভিজাত মহলে জামরের যাতায়াত ছিল অবাধ। স্বয়ং রাজা পঞ্চদশ লুইও নাকি মাঝেমাঝে বেশ পছন্দ করতেন শিশু জামরের উপস্থিতি। কাউন্টেস দ্যু ব্যারির স্মৃতিকথা নামে একটি বই পাওয়া যায় এখনো, যদিও ওটি মোটেও তাঁর লেখা নয়। আসল লেখকের নাম ব্যারন এতিয়েনা লিওঁ দে লামথ-লংগঁ, নিজেকে যিনি এই বইটির সম্পাদক হিসাবে দাবি করেছেন। বইটিতে জামরের (এবং তার সাথে কাউন্টেসের সম্পর্কের) একটি বর্ণনা আছে, যার সত্যতা প্রশ্নাতীত নয়। তবে লেখক শুরুতেই জামরকে আফ্রিকান ঠাউরেছেন, ফলে তাঁকে বিশ্বাস করা শক্ত।

জামরের প্রতি কাউন্টেস দ্যু ব্যারির মনোভাব ছিল মাতৃসুলভ, এবং “অকৃতজ্ঞ নিগ্রো” জামর কাউন্টেসের মৃত্যুর কারণ, কার্যত এই হল সেই পরিচ্ছেদের প্রতিপাদ্য। মজার কথা, তা সত্ত্বেও দ্যু ব্যারির জবানিতে জামরের প্রতি স্নেহের উল্লেখ থাকলেও সে যে আদতে নিম্নবর্গের মানুষ, ইতরশ্রেণীর প্রাণী — সে কথা গোপন থাকে না। বরঞ্চ এত মাতৃসুলভ স্নেহের উল্লেখের পরেও গুরুত্বের বিচারে প্রথম স্থান লাভ করে কাউন্টেসের প্রিয় কুকুর। জামরের স্থান তার নীচে।

দ্বিতীয় পর্ব >>

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.