সায়ক ঘোষ চৌধুরী
দেশের শেষ ‘নিরপেক্ষ’ সর্বভারতীয় খবরের চ্যানেল এনডিটিভি কেনার দিকে হাত বাড়াল আদানি গোষ্ঠী, এনডিটিভির মালিক প্রণয় রায় এবং রাধিকা রায়ের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই। ঘটনার সূত্রপাত ২০০৯ সালে। বিশ্বপ্রধান কমার্শিয়াল প্রাইভেট লিমিটেডের (ভিসিপিএল) কাছ থেকে এনডিটিভির প্রোমোটার সংস্থা আরআরপিআর হোল্ডিংস (রাধিকা রায় প্রণয় রায় হোল্ডিংস) ৪০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছিল। এখন আদানি গোষ্ঠী তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এএমজি মিডিয়া নেটওয়ার্কস লিমিটেডের মাধ্যমে ভিসিপিএলের ১০০% ইকুইটি কিনে নিয়েছে। এর অর্থ হল, ২০০৯ সালের সেই ঋণের ফলে এনডিটিভির মোট শেয়ারের ২৯% চলে গেছে আদানি গোষ্ঠীর হাতে। কিন্তু কারা এই ভিসিপিএল, যাদের সব শেয়ার কিনে নিয়ে আজ আদানি গোষ্ঠী এনডিটিভির মালিক হয়ে বসতে চলেছে?
একসময় ওই কোম্পানির মালিক ছিল রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সর্বেসর্বা মুকেশ আম্বানির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কোম্পানি। আদানি গোষ্ঠী কিনে নেওয়ার ঠিক আগে মুকেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহেন্দ্র নাহাতা এই কোম্পানির সাথে যুক্ত বলে জানা গেছে। তাহলে ১৪ বছর ধরে শেল কোম্পানি (বা অধীনস্থ ভূতুড়ে সংস্থা), যার কোথাও কোনো অফিস নেই, বানিয়ে এনডিটিভির অংশীদার হয়ে বসেছিলেন আম্বানি, যা এখন আদানির ঝুলিতে গেল? এখানে কি নরেন্দ্র মোদী সরকারের কোনো ভূমিকা আছে? প্রশ্ন উঠছে, কারণ মুকেশ আম্বানি এই ১৪ বছর এনডিটিভির সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে তেমন নাক গলিয়েছেন বলে অভিযোগ নেই। অথচ এনডিটিভি বিজেপির চক্ষুশূল। অতএব আদানি, আম্বানির মধ্যে এ নিয়ে কোনো চুক্তি হওয়া অসম্ভব নয়। পুরো বিষয়টা পরিষ্কার না হওয়ার কারণ ভারতীয় কর্পোরেট জগতের অস্বচ্ছ কাঠামো। কিন্তু ওই জগৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ লোকেরাও জানেন, আম্বানি এবং আদানি – বিজেপি সরকারের দুই ঘোড়া – একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামেন না। পেট্রোকেম, টেলিকম, রিটেল, টেক্সটাইল হল আম্বানির সাম্রাজ্য। অন্যদিকে বন্দর, বিদ্যুৎ, এফএমসিজি, খনিজ সম্পদ আদানির সাম্রাজ্য। এর বেশিরভাগটাই মোদীর দান। আম্বানি যা-ও বা নতুন প্রযুক্তির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, আদানি এখনো পুরনো প্রযুক্তিনির্ভর। কিন্তু যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম আধুনিক ব্যবসার হাতিয়ার হয়ে উঠছে, তাতে স্রেফ ডাল, তেলের ব্যবসা করলে চলবে না। নতুন ব্যবসাক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশ করা চাই। এনডিটিভির ২৯% শেয়ার ভিসিপিএলের মাধ্যমে দখল করার পর তিনি আরও ২৬% শেয়ার চাইছেন বাজার থেকে কিনবেন বলে জানা গেছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
কিন্তু গৌতম আদানির ব্যবসার প্রকৃত চেহারা কী? বর্তমানে গৌতম আদানি এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটসকেও ছাপিয়ে গেছেন। কিন্তু সবটাই কাগজে কলমে, ভিতরে বিস্তর গোলমাল। আন্তর্জাতিক সংস্থা CreditSights-এর রিপোর্ট বলছে, আদানি গোষ্ঠী বিপুল পরিমাণ ঋণে জর্জরিত। নিজের সংস্থাকে বড় করার নেশায় গৌতম আদানি তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত সংস্থায় পরিণত করেছেন। ভারতের সব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা তাঁর পাওনাদার। ভারতে সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণকারী সংস্থা আদানি এন্টারপ্রাইজ, যে সংস্থার শেয়ারের মূল্যের উপরে ভিত্তি করেই গৌতমের বিত্ত। সেই সংস্থার প্রায় গ্যারান্টার হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এটাই ওঁর গুজরাট মডেল।
আদানি গোষ্ঠীর কিছু কার্যকলাপ লক্ষ করা যাক।
(১) আদানি গোষ্ঠী সুইটজারল্যান্ডের কোম্পানি হোলসিম গ্রুপকে ১০.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে রাতারাতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সংস্থা হয়ে গেছে, অথচ এদের সিমেন্ট তৈরির কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
(২) ইজরায়েলের হাইফা বন্দরকে ১.১৮ বিলিয়ন ডলারে কিনে নিয়েছে।
(৩) অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল কয়লা খনি কিনে নিয়ে পরিবেশ সম্পর্কিত বিরাট বিতর্ক তৈরি করেছে।
(৪) তারা নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচগুণ বাড়াতে চায়। তাই গ্রীন হাইড্রোজেন, এয়ারপোর্ট, কয়লা, এলুমিনা, কপার শুদ্ধিকরণ, ডেটা সেন্টার, পিভিসি ক্ষেত্রে বিরাট বিনিয়োগ করছে।
আরো পড়ুন ‘১৯৯১ থেকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পথ ত্যাগ করার ফল গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১০১তম স্থান’
কোথা থেকে আসছে বিনিয়োগ করার মত এত টাকা? হাওয়া থেকে বললেই ভাল হয়। একটি টাকাও নিজস্ব তহবিল থেকে বেরোচ্ছে না। সবটাই চলছে ঋণ থেকে। এবং তারা এই বলে লগ্নিকারীদের আশ্বস্ত করছে যে বহু দেশি, বিদেশি সংস্থা তাদের প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এই আদানি গোষ্ঠী নামক চোরাবালির উপরে ভরসা করেই মোদী নতুন ভারত নির্মাণ, পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।