মানুষ যেমন হয়েছে তেমন নয়, মানুষ যেমন হতে পারত তেমন এক আদল রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছেন প্রায় সমস্ত জীবন ধরে। মানুষের চারপাশটা যেমন আছে তেমন নয়, যেমন হলে হতে পারত মানুষের পূর্ণতার বিকাশ – সেই ছবি বুনতে চেয়েছেন তাঁর জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত।
জীবনযাত্রার জটিলতা যত বাড়ে প্রকৃতির সাথে মানুষের স্বচ্ছন্দ সম্পর্ক তত নষ্ট হয়, বিচ্ছেদ বেড়ে চলে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কালে সঠিক জীবনযাত্রা রচনার গুরুত্ব আছে। এইসব প্রসঙ্গ তাই নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যেকার বিস্তর ফারাক প্রকৃতি থেকে মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে চলেছে। আর্থসামাজিক বৈষম্য নানা ব্যাধি সৃষ্টি করছে। সামগ্রিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের প্রশ্নে নগর ও গ্রামের সত্যিকারের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার দিকটি আজ গভীর চর্চার বিষয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পরিবেশ বিপর্যয়ের যুগে গোটা পৃথিবীতেই পরিবেশবান্ধব বাসস্থান নির্মাণের প্রসঙ্গ বারবারে উঠে আসছে। সংগত কারণেই ভয়াবহ বায়ুদূষণ, জলদূষণ, বর্জ্য নিক্ষেপণ, শব্দদূষণ, দৃশ্যদূষণ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত পরিকল্পনার পাশাপাশি মানুষের আচরণের বিভিন্ন দিক নিয়েও আলোড়ন হচ্ছে। মানবিক, আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশবান্ধব নির্মাণ ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
আজকের সংকটে ১৯১৬ সালে ‘জাপান যাত্রী’ রবীন্দ্রনাথের লেখাকে বোধহয় নিছকই একটি ডায়রি হিসাবে দেখার উপায় নেই, দেখা উচিত সতর্কবার্তা হিসাবে। ওই রচনায় তিনি নদীপথে যেতে যেতে শহর এবং তার পাশ দিয়ে বহমান নদীর নিত্য সম্বন্ধের মত জরুরি দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। “… পৃথিবীতে যে-সব শহর সত্য তা মানুষের মমতার দ্বারা তৈরি হয়ে উঠেছে। দিল্লি বল, আগ্রা বল, কাশী বল, মানুষের আনন্দ তাকে সৃষ্টি করে তুলেছে। কিন্তু বাণিজ্যলক্ষ্মী নির্মম, তার পায়ের নীচে মানুষের মানস – সরোবরের সৌন্দর্যশতদল ফোটে না। মানুষের দিকে সে তাকায় না, সে কেবল দ্রব্যকে চায়; যন্ত্র তার বাহন। গঙ্গা দিয়ে যখন আমাদের জাহাজ আসছিল তখন বাণিজ্যশ্রীর নির্লজ্জ নির্দয়তা নদীর দুই ধারে দেখতে দেখতে এসেছি। ওর মনে প্রীতি নেই বলেই বাংলাদেশের এমন সুন্দর গঙ্গার ধারকে এত অনায়াসে নষ্ট করতে পেরেছে।”
অব্যর্থ সত্যদৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎকে দেখেছিলেন। আমরা শহরবাসীরা অমন সুন্দর গঙ্গা নদী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। শহর পিছনে ফেলে দিয়েছে তার ঐতিহ্যকে। গঙ্গার পাড় দখলে, আবর্জনায় ত্রস্ত। আমাদের আজকের জীবনে গঙ্গা সংস্কৃতি তাই অনুপস্থিত।
সপ্ততিবর্ষ পরিসমাপ্তি উপলক্ষে কলকাতা মহানগরীর পৌরবৃন্দের অভিবাদনের উত্তরে, ১৯৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, রবীন্দ্রনাথ বাসভূমির জনস্বাস্থ্য, জনস্বাচ্ছন্দ্যব্যবস্থার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ‘পৌরকল্যাণ সাধনে’ শিল্প-শিক্ষা-সংস্কৃতির ভূমিকাকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন নগরীর চরিত্র নির্মাণের অন্যতম প্রধান অঙ্গ হিসাবে। সেদিন অল্প কথায় তিনি যে সার কথাগুলি বলেছিলেন, আজকের প্রযুক্তি-সংস্কৃতি চর্চায় আবারও সেই কথাগুলিকেই অপরিহার্য সমাধান সূত্র হিসাবে দেখতে হবে। “.. এই পুরসভা আমার জন্মনগরীকে আরামে আরোগ্য আত্মসম্মানে চরিতার্থ করুক; ইহার প্রবর্তনায় চিত্রে, স্থাপত্যে, গীতিকলায়, শিল্পে এখানকার লোকালয় নন্দিত হউক, সর্বপ্রকার মলিনতার সঙ্গে অশিক্ষার কলঙ্ক এই নগরী স্খালন করিয়া দিক, – পুরবাসীদের দেহে শক্তি আসুক, গৃহে অন্ন, মনে উদ্যম, পৌরকল্যাণ সাধনে আনন্দিত উৎসাহ। ভ্রাতৃবিরোধ বিষাক্ত আত্মহিংসার পাপ ইহাকে কলুষিত না করুক – শুভবুদ্ধি দ্বারা এখানকার সকল জাতি, সকল ধর্ম সম্প্রদায় সম্মিলিত হইয়া এই নগরীর চরিত্রকে অমলিন ও শান্তিকে অবিচলিত করিয়া রাখুক – এই কামনা করি।”
বাসস্থানের অধিকারভেদের মত অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্নও তিনি তুলেছিলেন। বসবাসের যোগ্যতার প্রশ্নে মানুষের আচরণের দিকটিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে লোকালয়ে, নগরে, গ্রামে গঞ্জে, আজ কি বিপুল প্রয়াসই না চালাতে হচ্ছে। জনসচেতনতা গড়ে তোলার বিশাল কর্মযজ্ঞের মূল উদ্দেশ্যই হল সাধারণ মানুষকে দায়িত্ববান করে তোলা। আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকলেই চলবে না, বাসস্থানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতাও অর্জন করা চাই। দায়িত্ব পালনে যোগ্যতারও একটা প্রশ্ন থাকে, তা পর্ণকুটিরে এবং শহরে সমানভাবে প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাপী জনজীবনে এখন তা পদে পদে উপলব্ধি করা যাচ্ছে।
জল, প্রাণ, জনস্বাস্থ্য আমাদের জীবনে মিলেমিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ, আপন প্রাণাত্মবোধের পরিচয়কে জনকল্যাণের বৃহত্তর পটভূমিকায় দেখতে চেয়েছিলেন। “ধরণীর অন্তঃপুরগত সম্পদ” জীবজন্তু ও সমস্ত প্রাণসম্পদকে ফিরে পাবার সাধনাকে তিনি সকল সাধনার গোড়ার কাজ বলেছিলেন। “এই সহজ কথাটি স্বীকার করবার শুভদিন বোধ হচ্ছে আজ অনেককাল পরে এসেছে।” বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ অনেকাংশেই একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান মাত্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে স্টকহোম বিশ্ব সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষার যে সংকল্প নেওয়া হয়েছিল, তাকে এখনো সর্বত্রগামী করা যায়নি। রিও ডি জানেইরোর অতি সাম্প্রতিক বসুন্ধরা সম্মেলন এবং জি-৭ বৈঠকে দূষণ রোধে মতানৈক্য সেকথাই প্রমাণ করে। আজও পৃথিবীর জলরাশি দূষণে আক্রান্ত হয়ে চলেছে । “আত্মঘাতিনী মাটি আপন বুকের সরসতা হারিয়ে রিক্তমূর্তি ধারণ” করেছে। “বস্তুকোলাহলপূর্ণ” বিপন্ন পরিবেশে আক্রান্ত মানুষ, অরণ্যভূমি ও প্রাণীজগৎ। জনশক্তি সমবায়ের দ্বারা পরিবেশ পুনর্নির্মাণের দৃষ্টান্ত ভুবনডাঙায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের মানুষকে সচেতন করে ভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণের কমিটির মধ্যে দিয়ে প্রাণাত্মবোধের পরিচয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিলেন “এর অজস্র দানে চারদিক স্বাস্থ্যে সৌন্দর্যে পূর্ণ হয়ে উঠুক ।”
ছিন্নপত্রাবলী-র সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ “প্রাণময় বিশ্বাত্মীয়তা”-র কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রগাঢ় অনুভূতির জগৎ ও নিশ্চিত বিশ্বাসের বোধ থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন “আমি একদিন সমুদ্রস্নানসিক্ত তরুণ পৃথিবীতে গাছ হইয়া পল্লবিত হইয়া উঠিয়াছলাম। … আমার মধ্যে গাছের প্রাণের গূঢ় স্মৃতি আছে, আজ মানুষ হইয়াছি বলিয়াই এ কথা কবুল করিতে পারিতেছি। শুধু গাছ কেন সমস্ত জড়জগতের স্মৃতি আমার মধ্যে নিহিত আছে। বিশ্বের সমস্ত স্পন্দন আমার সর্বাঙ্গে আত্মীয়তার পুলক সঞ্চার করিতেছে — আমার প্রাণের মধ্যে তরুলতার বহু যুগের মূক আনন্দ আজ ভাষা পাইয়াছে … আমার মধ্যে একটা বিপুল আনন্দ আছে সে এই জল স্থল গাছপালা পশুপক্ষীর আনন্দ … ।” বিশ্বমহিমার মধ্য দিয়ে সজীব ভক্তি ও বিস্ময়; বিশ্বের সমগ্র স্পর্শ অন্তরবীণায় নতুন স্পন্দন সৃষ্টি করে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। সেই যেন তাঁর আত্মপরিচয়। ছিন্নপত্রাবলীতেই “জলরেখাবলয়িত” পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের একাত্মতার নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।
“সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধ উত্তাপ” হল জীবনীশক্তি। তাঁর এই যে মনের ভাব, এ যেন এই “প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যস্নাত আদিম পৃথিবীর ভাব”। যেন “আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে … ।”
পৃথিবীকে তিনি দেখেছেন, জেনেছেন “অনেক জন্মকার ভালোবাসার মতো”। এ মস্ত সপ্রাণ ভাব, বৃহৎ সত্য অনুভূতি। প্রাণ মনের এই প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তিই পরিবেশ সংকট মোকাবিলায় আধুনিক বিজ্ঞানের প্রধানতম বিষয়। এই বসুন্ধরাকে প্রবল প্রাণ রূপে এখন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরাও দেখতে চাইছেন। সমগ্র বায়ুমণ্ডল আর প্রাণলোক নিয়ে পৃথিবী এক সপ্রাণ অস্তিত্ব। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখেছিলেন, মানবিক আচরণের মাধ্যমে রোমাঞ্চকর সক্রিয়তায় বিশ্বাসযোগ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কথা। প্রয়োজন এক নতুন জীবনদর্শন, যা মানুষকে জল, মাটি, হাওয়া এবং জীববৈচিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখবে। পরিবেশ ও প্রাণিজগতের আন্তঃসম্পর্ক এবং মানুষের ভূমিকা, বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে সমন্বয়ী বিদ্যাচর্চায় সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির খোঁজ চলছে দিকে দিকে। মানুষ আর প্রকৃতি যে এক অখন্ড সত্তা – এই চেতনার উদ্বোধনই গড়ে তুলতে পারে মানবিক পরিবেশ সংস্কৃতি। এই প্রেক্ষিতে প্রয়োগবিদ রবীন্দ্রনাথের চর্চাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ভবিষ্যতের নিবিড় স্পর্শ অনুভব করে ১৯৪১ সালে জীবদ্দশায় শেষ ‘জন্মদিনে’ লিখেছিলেন
আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি…
এই ধ্বনি শোনা, অনুভব করা এবং তাতে সাড়া দেওয়ার সাধনাই আজ অন্তরময় পরিবেশ সাধনার আদর্শ। সমন্বয়ী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আলোকে ভবিষ্যৎমুখী রবীন্দ্রনাথকে আরও নিবিড়ভাবে গ্রহণ করে পরিবেশ পুনর্গঠনের কাজে প্রয়োগ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ মানবিক বাসভূমি নির্মাণে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে মানবিক মূল্যবোধের যে প্রয়োগক্ষেত্র রচনা করেছিলেন তার গুরুত্ব আজ অপরিসীম।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।