
একজন মানুষ জীবনের পঁয়ত্রিশটা বছর হয় আত্মগোপন করে থেকেছেন অথবা কারাগারে কাটিয়েছেন, কিন্তু মাথা নীচু করেননি কখনও। যে মতাদর্শে আস্থা রাখতেন, কখনও সরে আসেননি তার থেকে। ১৯শে আগস্ট সেই আশ্চর্য মানুষটির মৃত্যুদিন গেল। কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী। আমরা হয়তো তাঁকে মনে রাখিনি সেভাবে, কিন্তু এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে অগ্নিযুগের বিপ্লবী, প্রথমে অবিভক্ত ভারত, পরে পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবাদপ্রতিম নেতা জ্ঞান চক্রবর্তীর নাম। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে, ১৯৭৭ সালের ১৯শে আগস্ট আমাদের এই কলকাতা শহরেই মারা গিয়েছিলেন তিনি।
জ্ঞান চক্রবর্তীর জন্ম পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের গোবিন্দ দাস লেনে। ১৯০৫ সালের ৭ই জুলাই। জ্ঞানবাবু যখন স্কুলের ছাত্র, তখন দেশজুড়ে স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ। মাত্র ১২ বছর বয়সে যুক্ত হলেন অনুশীলন সমিতির শাখা বাণী সংঘে। একটু বড় হওয়ার পর যোগ দিলেন যুগান্তরে। ১৯৩০ সালের আশেপাশে তিনি ঢাকা এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বদেশি সংগঠক। পুলিশের নজর এড়াতে বাড়ি ছাড়লেন। আত্মগোপন করলেন। লাভ হল না। প্রথম গ্রেফতারি ’৩১ সালে। একটানা সাত বছরের জেল। প্রথমে কলকাতা, সেখান থেকে বক্সা দুর্গ, শেষে দেউলি কারাগার। এই সময়েই আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট হয়ে ওঠা। মার্কস পড়া। জেলের মধ্যে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট কনসলিডেশনে যোগ দেওয়া। ১৯৩৮ সালে জেলমুক্তির পর যে জ্ঞান চক্রবর্তী খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালেন, তিনি এক নতুন মানুষ — একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী। ওই বছরেই ডিসেম্বর মাসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেলেন। দলের নির্দেশে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের অলিগলি চষে ফেললেন। ঢাকা ও তার আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় তৈরি হল লাল পতাকার সংগঠন। কাজ করতে লাগলেন জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরেও।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সেই সময়টা ছিল আশ্চর্য। সময়ের সন্তানরাও তাই। একজনের নাম করলে আরও কতজনের কথা ভিড় করে আসে! ঢাকায় রেবতী মোহন বর্মন মার্কসবাদী প্রকাশনার কাজ শুরু করলেন৷ নেপাল নাগ, রণেন বসুদের সঙ্গে সেই উদ্যোগে ভিড়ে গেলেন জ্ঞান চক্রবর্তীও। তৈরি হল প্রগতি লেখক সংঘ। জ্ঞানবাবু সেখানেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। এলাকায় এলাকায় তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠল গোপন কমিউনিস্ট পাঠচক্র। ১৯৪০ সালের এপ্রিলে ঢাকায় কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন আহ্বান করলেন। সেই অপরাধে পুলিশ আবার গ্রেফতার করল। আট মাস পর ছাড়া পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবারও গ্রেফতার। এবার সঙ্গে কমিউনিস্ট বইপত্র রাখার অভিযোগে।
জ্ঞান চক্রবর্তীর জীবনটাই এমন। একবার জেল খেটে বেরনোর পরপরই আবার হয় জেলে, অথবা আত্মগোপনে। ইতিমধ্যে রেল শ্রমিক ইউনিয়নের শক্ত সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সেখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন সোমেন চন্দ। কাজ শুরু হয়েছে পোশাক ও জুটমিল শ্রমিকদের মধ্যেও। এর মধ্যেই এল ১৯৪৩ সাল — মন্বন্তর। ভাত নেই। ফ্যানটুকুও বাড়ন্ত। কলকাতায়, ঢাকায় হাজার হাজার লাশ। অনাহার আর মৃত্যু। ঝাঁপিয়ে পড়লেন কমিউনিস্টরা। ঝাঁপিয়ে পড়লেন জ্ঞান চক্রবর্তী। ঢাকায় লঙ্গরখানা খুললেন। মানুষকে বাঁচাতে দিন-রাত এক করে ছুটে বেড়ালেন মহল্লার পর মহল্লা।
এরপর দেশভাগ। এরপর দাঙ্গা। ১৯৪৬, ১৯৫০, ১৯৬৫ — যখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বলেছে ওই বাংলায়, তখনই বুকটান করে রুখে দাঁড়িয়েছেন কমিউনিস্টরা। দাঁড়িয়েছেন জ্ঞান চক্রবর্তী। ঠিক যেমন এই বাংলায় কমরেড ইসমাইল। প্রতিটি দাঙ্গায় অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা কমিটির নেতা জ্ঞানবাবু। জেল আর আত্মগোপন কিন্তু তখনও পিছু ছাড়েনি। প্রায় গোটা পাকিস্তান আমলটাই তিনি হয় জেলে, অথবা আত্মগোপনে। প্রথমে ’৪৮ সালে নিষিদ্ধ হল কমিউনিস্ট পার্টি। তারপর ’৫৮ সালে আইয়ুব খান তাঁর নামে জারি করল গ্রেফতারি পরোয়ানা। আত্মগোপনে থেকেই জ্ঞান চক্রবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম, শহর, মফস্বলে গড়ে তুললেন কমিউনিস্ট সংগঠন।
ছয়ের দশকের শেষ প্রান্ত। গণআন্দোলনে, গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তান। রক্তে ভেজা রাজপথ বাঁক নিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের দিকে। ততদিনে তিনি প্রায় বৃদ্ধ। দশকের পর দশক জেলে, আত্মগোপনে থাকা শরীর বেশ অশক্ত। তবুও জনসমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় হীরের মতো ঝলমল করছেন কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী। ’৬৯ সালের অভ্যুত্থান পেরিয়ে, ২৫শে মার্চের অন্ধকারকে পিছনে ফেলে কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে তিনি পথ হাঁটছেন স্বাধীন বাংলাদেশের দিকে।
স্বাধীনতা এল। গণমুক্তি এল কি? জ্ঞান চক্রবর্তীরা যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন, তা কি শেষ পর্যন্ত সফল হল? বাংলাদেশে? ভারতে? পাকিস্তানে? এই উপমহাদেশের কোথাও? সেই স্বপ্নে কি মিশে গেল স্বৈরাচারের সঙ্গে সমঝোতার গ্লানি? ইতিহাসের নিবিড় চর্চা নিশ্চয় সব উত্তর খুঁজে পাবে আগামীতে।
১৯৭৭ সালের ১৯শে আগস্ট কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী মারা যান। আমাদের এই কলকাতা শহরে। আদর্শের জন্য লড়তে গিয়ে জীবনের সাড়ে তিন দশক জেল আর আত্মগোপনে কাটানো এই আশ্চর্য কমিউনিস্টকে কি আদৌ মনে রেখেছে অপার বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন?
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।