“গত মঙ্গলবার (২৪ মে, ২০২২) ব্যাঙ্কে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল, তাতে আমার এখনো অবাক লাগছে,” বললেন অভিনেত্রী দোয়েল রায় নন্দী। “স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সোদপুর শাখায় চেক জমা দিতে গিয়ে ডিপোজিট স্লিপ লিখতে গিয়ে দেখি সেটার ভাষা পুরোপুরি হিন্দি। আমার হিন্দির চর্চা নেই, ফলে বাংলা বা ইংরেজিতে লেখা ফর্ম খুঁজলাম। কিন্তু পাওয়া গেল না।”
“বাংলায় ডিপোজিট স্লিপ নেই কেন ব্যাঙ্ককর্মীদের জিজ্ঞেস করায় তাঁরা বললেন, কেন্দ্র থেকে যা এসেছে তা-ই মানতে হবে, এ বিষয়ে তাঁদের কিছু করণীয় নেই। এর বেশি কিছু বলতে গেলে সরকারকে প্রশ্ন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপর নিরুপায় হয়ে কিয়স্ক মেশিনে পাসবই আপডেট করতে গেলাম। দেখি সেখানেও কেবল হিন্দি, ইংরেজি রয়েছে; বাংলা উধাও। অথচ কয়েকদিন আগেও যখন ব্যাঙ্কে গেছি, তখন বাংলা ছিল। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে মোটেই সাহায্য করলেন না।”
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে দোয়েল বললেন “হিন্দি ফর্ম থাকুক তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু যিনি হিন্দি বুঝবেন না তাঁর কি হবে? ইংরাজি বা যে কোনো স্থানীয় ভাষার ফর্ম থাকাও জরুরি।”
দোয়েলের এই অভিযোগ শোনার পর নাগরিক নেটের পক্ষ থেকে ব্যাঙ্কের চিফ ম্যানেজার বিশ্ব দীপক চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হয়, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কথা মানলে, এ বিষয়ে কথা বলতে পারে একমাত্র সরকার, যারা স্টেট ব্যাঙ্কের মালিক।
এখন কথা হল, সম্প্রতি হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্যসভার সাংসদ ইরান্না কাডাডি সহ একাধিক নেতা, মন্ত্রীর মন্তব্য যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে – সোদপুরের স্টেট ব্যাঙ্কে গিয়ে দোয়েলের অভিজ্ঞতাকে তার থেকে আলাদা করে দেখা চলে কি? বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়ই, বরং এমন আশঙ্কা অমূলক নয়, যে এ হল সবার উপরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার নিভৃত সূচনা।
ভাষা শুধু আমাদের অভিব্যক্তির মাধ্যম নয়; আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আমাদের পরিচিতি সত্তার সঙ্গে জড়িত। অনেকটা সেই কারণেই আবার কোনো ভাষার উপর অন্য এক ভাষার আধিপত্য কায়েম করতে চাওয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। শাসকের দিক থেকে শাসিতের উপর একটা ভাষাকে জোর করে করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এই উপমহাদেশে একাধিকবার ঘটেছে। উর্দু ভাষাকে বাংলাভাষী মানুষের জাতীয় ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন অধুনা বাংলাদেশের জনগণ।
১৯৪০ সালের মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলন অথবা ১৯৬১ সালের আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনও কম উল্লেখযোগ্য নয়। এছাড়া ১৯৬০-এর দশকে লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এবং ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে হিন্দিকে প্রাধান্য দেবার কেন্দ্রীয় সরকারি সিদ্ধান্ত বিপুল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও একমাত্র হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসাবে ব্যবহার করায় চিরকালীন আপত্তি দেখা গেছে।
পড়ুন > ১৯ মে: কলকাতায় বিস্মৃত একটি ভাষা আন্দোলন
এই ইতিহাস অস্বীকার করে নতুন করে হিন্দিকে “জাতীয়” স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচেষ্টা অনিবার্যভাবেই সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান নীতির কথা মনে করায়। ২০১৯ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে হিন্দিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছিল। সমালোচনার মুখে সংশোধন করে বলা হয়েছে, হিন্দি বাধ্যতামূলক নয়, তবে শিক্ষার্থীরা ভাষা হিসাবে হিন্দি বেছে নিতে পারবে, অর্থাৎ তিন ভাষার ফরমুলা বহাল রইল।
এমতাবস্থায় দোয়েলের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সোদপুরের ব্যাঙ্কে, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখা অসঙ্গত নয়।
দেশের সংবিধান প্রণয়নের সময়ে বিস্তর আলাপ আলোচনার পর কোনো একটা ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে ২৯(১) অনুচ্ছেদে, আমাদের দেশের যে কোন জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার পূর্ণাঙ্গ অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেসময় দেখা গিয়েছিল দেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ হিন্দিতে কথা বলেন না। তবে হিন্দি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা। তাই সংবিধান প্রণেতারা ইংরাজি আর হিন্দিকে বাছেন সরকারি ভাষা হিসাবে। কিন্তু পরিকল্পনা ছিল ১৫ বছরের মধ্যে ক্রমশ ইংরেজির বদলে হিন্দিকেই একমাত্র সরকারি ভাষা করে ফেলা হবে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টার বারবার বিরোধিতা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে সেই কারণেই আইন করে ইংরেজি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে বহাল রাখা হয়। উপরন্তু রাজ্য সরকারগুলোকে নিজ নিজ রাজ্যের সরকারি ভাষা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে সংবিধানের অষ্টম তফশিল অনুসারে সরকারি ভাষা বাইশটা। সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এই বাইশটা ভাষায় কথা বলেন। হিন্দি নিয়ে মাতামাতি করার পাশাপাশি ভারতে আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে কতটা অবহেলা করা হয় তার প্রমাণ ইউনেস্কোর বিশ্ব ভাষা মানচিত্র। সারা বিশ্বে বিপন্ন এবং বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া ভাষার দেশগুলোর মধ্যে ভারত এক নম্বরে রয়েছে। আমাদের দেশে ১৯৭টা ভাষা বিপন্ন এবং বিলুপ্তির পথে। এদিকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর হিন্দি দিবস পালন করেছে, শাহ যোগাযোগের ভাষা হিসাবে সকলকেই হিন্দি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সরকার এতেই ক্ষান্ত নয়। রাজনীতির বাইরের লোকেদেরও হিন্দি বন্দনায় কাজে লাগানো হচ্ছে বলে সন্দেহ হয়। সম্প্রতি বলিউডি অভিনেতা অজয় দেবগন এবং অভিনেতা কিচ্চা সুদীপের টুইটারে হিন্দি ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব এর উদাহরণ। অজয় তো বিজেপির চেয়েও এককাঠি উপরে উঠে বলেছেন হিন্দি রাষ্ট্র ভাষা ছিল, আছে, থাকবে।
হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়ার সাম্প্রতিক ঘোষণার বিরোধিতা করেছে অসম সাহিত্য সভা, মণিপুরী ভাষাকে রক্ষা করার জন্য সদ্য গঠিত সমিতি এমইইএলএএল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও খাপ্পা। দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত শিল্পীরাও সরব। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিশেষত দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে ক্ষতি হবে বলে হয়ত বিজেপির ধারণা। তাই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের সব ভাষাই ভারতীয়ত্বের আত্মা, এবং দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের উপাদান বলে বিজেপি মনে করে।
অর্থাৎ বিজেপি আঞ্চলিক ভাষার বিরোধী নয় — এমন একটা ভাব করে ভাষা বিতর্কে জল ঢালা হল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একবারও বলেননি, এক রাষ্ট্র এক ভাষা নীতি বাতিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দিন তিনেক পরেই দোয়েলের অভিজ্ঞতা কিন্তু ইঙ্গিত দিচ্ছে, প্রক্রিয়া যেমন চলার তেমনই চলছে। নইলে হঠাৎ ব্যাঙ্কের কাগজ এবং কিয়স্ক থেকে বাংলা তো বটেই, ইংরেজিও বাদ পড়ে কেন?
তথ্যসূত্র
১। দ্য কুইন্ট
২। দ্য নিউজমিনিট
৩। দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন
৪। দ্য হিন্দু
৫। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি – ১৯৬৮
৬। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি – ২০১৯
আরো পড়ুন : অমিত শাহের মন্তব্য এবং ভাষার আগ্রাসন নিয়ে কিছু কথা
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
অতি প্রয়োজনীয় এবং জরুরী বার্তা। অধিক পরিমাণে অধিক গুরুত্ব দিয়ে জনমত তৈরী করা দরকার। বাংলা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন (বিশেষ করে সব ধরনের পত্রিকা ) তাঁদের নিয়ে সংগঠিত আলোচনা ও লাগাতার প্রচার দরকার। ভাষা যদি হারিয়ে যায় পাঠক থাকবে না, নাকের ডগায় বিজ্ঞাপনের যে লোড তাও থাকবে না।
ত্রিভাষা সূত্রের সম্মিলিত বিরোধিতা করা দরকার। হিন্দি ভাষাকে সর্বব্যাপী করা এবং হিন্দিভাষী মানুষের আগ্রাসনের অন্যতম কৌশল ত্রিভাষা সূত্র। দাবি তোলা দরকার দ্বিভাষা র। ইংরেজি এবং আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে মাতৃভাষা বাঁচবে, আন্তর্জাতিক ভাষার গুরুত্বের সাথে হিন্দি আগ্রাসন রোধ করা যাবে।
(লেখাটি শেয়ার করলাম)।