শতঞ্জীব গুপ্ত

বড়িশা হাইস্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সৌরনীলের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। এই কদিন মূলধারার সংবাদমাধ্যমের প্রথম সারিতে থেকেছে এই খবর। টিভিতে সন্ধেবেলা এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বরাবরের মত এবারেও এই কদিন প্রতিদিন পরপর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে পথ দুর্ঘটনার খবর। সৌরনীলের ঘটনার পরের দিন নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় ১২ বছরের রবিউল শেখের মৃত্যু হয়। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল সাইকেল নিয়ে, তখন একটি পিক-আপ ভ্যান তাকে ধাক্কা মারে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় রবিউল। সৌরনীলের ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে সৌরনীল ও রবিউল সমেত পশ্চিমবঙ্গে অন্তত পাঁচ জনের মৃত্যু হয় পথ দুর্ঘটনায়। গত মঙ্গলবারও ঠাকুরপুকুর এলাকায় ট্যাক্সির ধাক্কায় সোমু অধিকারী নামে বছর দশেকের আরেকজন ছাত্র গুরুতর জখম হয়। বেহালা চৌরাস্তার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ্যে এসেছে। খুব স্পষ্ট না হলেও এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে দুটো ট্রাকের মধ্য দিয়ে রাস্তা প্রায় পার হয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে সিগনাল সবুজ হয়ে যায় এবং পিছনের ভারি ট্রাকটা পিষে দেয় সৌরনীলকে।

মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার পর বেহালা চৌরাস্তায় বিক্ষোভ শুরু হয়। বিশাল পুলিসবাহিনী আসে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে স্তিমিত করে ফেলে সেই বিক্ষোভ। বড়িশা স্কুলের ভিতরেও নাকি কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। এই নিয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সাংবাদিকদের তিনি সরাসরি বলেন “আমাদের স্কুলে চারচাকা নিয়ে কেউ পড়তে আসে না। আসে সাইকেল নিয়ে। পাশে অন্য বেসরকারি স্কুলের সামনে ট্র্যাফিক পুলিস থাকে, কিন্তু আমাদের স্কুলের সামনে থাকে না।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই ঘটনা নানা দিক থেকে বর্তমান সময়ের কিছু মৌলিক প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে, যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্য বিতর্ক বাদ রেখে শহরের সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে পথ দুর্ঘটনার সম্পর্ক নিয়ে এই লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করব।

সৌরনীলের মৃত্যুর পর বেহালা চৌরাস্তায় ট্র্যাফিক পুলিসের ভূমিকা ও তৎপরতা নিয়ে কথা উঠেছে। বহু সংবাদমাধ্যমে এই নিয়েই আলোচনা হয়েছে অনেকটা সময় ধরে। এ কথা ঠিক যে শুধু ট্র্যাফিক বিভাগ নয়, অনেক সরকারি পরিষেবাই ব্যাহত হচ্ছে কম কর্মী দিয়ে ডিপার্টমেন্ট চালানোর জন্য। কিন্তু পুলিস থাকা বা না থাকার চেয়েও বড় কথা সাধারণ মানুষের যাতায়াত প্রসঙ্গে প্রশাসনের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ঠিক কীভাবে যাতায়াত করেন এই শহরে? কলকাতা ছোট ঠাসবুনোটের শহর। শহরের ৬০% যাতায়াত তিন কিলোমিটারের বেশি লম্বা নয়। কলকাতার অধিকাংশ মানুষ এইরকম স্বল্প দূরত্বের মাইক্রো-মোবিলিটির উপর নির্ভর করেন, যার প্রধান মাধ্যম হাঁটা বা সাইকেল চড়া। কখনো কখনো অটোর মতো প্যারা-ট্রানজিট, কিছুটা বাধ্য হয়ে ভিড়ে ঠাসা বাস এবং অবশ্যই মেট্রো রেল, একটু দূরে যাঁরা চাকরিবাকরি করেন তাঁদের জন্য। নগর পরিবহন সংক্রান্ত কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন নীতি সংক্রান্ত নথিপত্রে বিশেষ করে কলকাতার ক্ষেত্রে মাইক্রো-মোবিলিটির দিকে জোর দেওয়া এবং সাইকেল আরোহী ও পথচারীদের সুবিধাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা ব্যক্ত করা হলেও বাস্তবে তার বিন্দুমাত্র প্রয়োগ নেই। সমস্ত গুরুত্ব প্রাইভেট যানবাহনের অবাধ গতি ও সংখ্যা বাড়ানোর দিকে। সেই অনুযায়ী রাস্তা ও ফুটপাথের বিন্যাস এবং সিগনাল ব্যবস্থা। শহরের মাত্র ৪%-৫% মানুষের ছোট গাড়ি চলাচলের অবাধ গতির জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে একের পর এক ফ্লাইওভার বানানো হয়। কিন্তু বিরাটসংখ্যক মানুষ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রায় ৩৫%) শহরে রোজ হেঁটে যাতায়াত করলেও পথচারীদের কেন্দ্র করে প্রায় কোনো পরিকল্পনাই রূপায়িত হয় না। অথচ এ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশিকা আছে জাতীয় পরিবেশ আদালতের ২০১৬ সালের একটি রায়ে।

রাজ্যের পরিবহন বিভাগ এবং কলকাতা পুলিসের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী শহরে প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় মোটরগাড়ির সংখ্যা প্রায় ২,৫০০; গাড়ির ঘনত্বের নিরিখে ভারতের মেট্রো শহরগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি। দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি এখানে বাতিল করা হয়নি। উল্টে প্রতিদিন নতুন করে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয় অসংখ্য প্রাইভেট গাড়ি এবং দুচাকার গাড়িকে। বড় রাস্তাসহ প্রায় সমস্ত রাস্তার দুই ধার জুড়ে জায়গা দখল করে চলে প্রাইভেট গাড়ির পার্কিং। বহু জায়গায় ফুটপাথ কেটে ছোট করে বাড়ানো হয়েছে গাড়ির রাস্তা। নগর পরিবহন-পরিকল্পনাবিদরা বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ির সুবিধা যত বাড়ে, তত দুর্বল হয় গণপরিবহন ব্যবস্থা। আরও বাড়তে থাকে গাড়ি-নির্ভরতা, কোণঠাসা হয় সাইকেল এবং হাঁটার মতো জ্বালানি-নিরপেক্ষ, পরিবেশবান্ধব পরিবহনের মাধ্যম। আর এই অবস্থার মধ্যে প্রাণ হাতে করে চলাফেরা করতে হয় পথচারীদের।

কলকাতার রাস্তা মানে এখন একটা হুলুস্থুল ব্যাপার। হর্নের শব্দে কান পাতা দায়। সৌরনীল এইরকম একটা হুলুস্থুল অবস্থার মধ্যেই সকালবেলা রাস্তা পার হচ্ছিল তার বাবার সঙ্গে। ওইরকম একটা ভারি ট্রাকের সামনে দিয়ে যে ওঁদের যেতে হল – একে নিছক দুর্ঘটনা বা অসাবধানতা বলে ব্যাখ্যা করা হলে তা হবে পাহাড়প্রমাণ সমস্যা ও অব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা। ঘটনার দিন কলকাতার পুলিস কমিশনার মন্তব্য করেছিলেন “সব সময় যে গাড়ির চালকের ভুল থাকে, তেমনটা নয়। মাঝেমধ্যে পথচারীদেরও ভুল থাকে।” শুধু তিনিই এমনটা বলেননি, এই বয়ান এসেছে প্রশাসনের নানা মহল থেকেই। এই পরিচিত বয়ানকেই ইংরিজিতে বলা হয় ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’, অর্থাৎ যে ঘটনার শিকার তাকেই ঘটনার জন্য দায়ী করা। পথ নিরাপত্তা এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহনের বিশেষজ্ঞরা বলবেন, শহরের প্রতিটি পথ দুর্ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায় সেই রাস্তার ডিজাইনগত ত্রুটির জায়গা থেকে। এই বিচ্যুতি এড়ানো যায় যদি পথচারীর সুবিধাকে সেই রাস্তার ডিজাইনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষ করে সেই শহর যদি হয় জনঘনত্বের নিরিখে পৃথিবীর প্রথম সারির শহর।

সমস্যা শুধু যে কলকাতার তা নয়। ভারতে এখন দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রতিবছর পথ দুর্ঘটনায় মারা যান, প্রতি ঘন্টায় ১৮ জন। এর প্রধান কারণ সর্বত্রই এক – পরিবহন ব্যবস্থায় প্রাইভেট যানবাহনের প্রতি পক্ষপাত, গতি এবং গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে প্রশাসনের উন্মাদনা। এইসব দুর্ঘটনায় মৃতরা অধিকাংশই পথচারী, যাঁরা হয়ত সরাসরি মোটরগাড়ি ব্যবহারই করছেন না। তথ্য বলছে, পথচারী নিজের ভুলে মারা যান মাত্র ২% ক্ষেত্রে, ৭৮% ক্ষেত্রে গাড়ির চালকের ভুলেই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রায় ১৬% ক্ষেত্রে কাজ করে অন্য কারণ। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সৌরনীলের মৃত্যুকে হয়ত এই ধরনের কিছু নির্দিষ্ট কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। পথচারী বা সাইকেল আরোহীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া সম্ভবত মূল সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা বা চর্চা এড়িয়ে যাওয়ার সহজতম পথ। আমাদের প্রশাসন এই সহজ পথ বেছে নিয়েছে।

এখন যেমন ছোট্ট সৌরনীলের মৃত্যুতে গোটা রাজ্যে শোকের আবহ, ঠিক তেমনটাই ছিল ১৯৭১ সালে নেদারল্যান্ডসে, যখন দেশজুড়ে ৫০০ জন শিশু মারা গিয়েছিল পথ দুর্ঘটনায়। এরপর শুরু হয় Stop de kindermoord (শিশুদের খুন করা বন্ধ করো) আন্দোলন। গাড়ি অধ্যুষিত ডাচ শহরগুলোতে দীর্ঘ এক দশক ধরে চলা সেই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নতুনভাবে জন্ম হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বাসযোগ্য, নিরাপদ, সাইকেল, গণপরিবহন ও পথচারীকেন্দ্রিক কয়েকটা শহরের – যেমন আমস্টারডাম বা ইউট্রেখট। শুধু পরিবহন ব্যবস্থা নয়, এই বদল দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে ও দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক ন্যায়ের ক্ষেত্রে। কলকাতার কফি হাউসে সেইসময় মুক্তির দশকের ডাক উঠছে, কিন্তু সম্ভবত কলকাতার কানে এই আন্দোলনের খবর তখন ততটা পৌঁছয়নি। কারণ বিশ্বায়ন-পরবর্তী গাড়ির স্তূপের কলকাতা দেখতে তখনো ৪৫-৫০ বছর দেরি।

আরো পড়ুন যানজট বাড়ায় প্রাইভেট গাড়ি, রাস্তা কারও একার নয়

প্রশ্ন উঠবে, ১৯৭১ সালের নেদারল্যান্ডসে ৩,৩০০ জন মারা যাওয়ায় যে মাত্রার গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, এদেশে প্রতি বছর দেড় লক্ষ মানুষ অসহায়ভাবে মারা গেলেও তেমন কিছু হচ্ছে না কেন? আমরা কি পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে ভবিতব্য মনে করছি? নাকি আমরা নিজেরাই হয়ে উঠছি নিজেদের ঘাতক?

ইতিহাস বাঁক নেয়। যেমন বাঁক নেয় রাস্তা।

*দুর্ঘটনার পরের দিন কলকাতা সাইকেল সমাজের কয়েকজন বন্ধু মিলে বেহালা চৌরাস্তায় দুর্ঘটনার জায়গাটিতে পৌঁছই। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করি দুর্ঘটনার দিনের পরিস্থিতি। এরপর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় সিসিটিভি ফুটেজ। আমাদের বন্ধু অরিত্র মুখার্জি নিজের মত করে দুর্ঘটনার নিম্নলিখিত বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করে। সারা পৃথিবীতে পথচারীদের প্রাধান্য দিয়ে কী ধরনের পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, কেমন করে নতুনভাবে জনমুখী করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে পরিবহন ব্যবস্থাকে – এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক খবরগুলো অরিত্র রাখে।

 

অরিত্র মুখার্জির সংযোজন

সিসিটিভি ফুটেজ এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথাবার্তা থেকে যা বুঝলাম, জোকার দিক থেকে এসে একটি অটো থেকে নামে সৌরনীল ও তার বাবা। তখন সিগনালে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে প্রথমে একটা বাস ও ছোট লরি, আর ঠিক পিছনে বড় লরিটা। বাসটাকে পিছন দিক দিয়ে পার করে, পিছনের বড় লরিটার সামনের ফাঁক দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন তাঁরা। প্রায় পার হয়েই গেছিলেন। এমন সময়ে সিগনাল সবুজ হয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। হতে পারে বড়/উঁচু লরি হওয়ায় বা জায়গাটা অন্ধকার থাকায় চালক ঠিক দেখতে পাননি।

কিছু পর্যবেক্ষণ

  • অটো যেখানে সৌরনীলদের নামায়, সেই জায়গায় ফুটপাথ নেই, সেই জায়গা নবনির্মিত মেট্রো রেল প্রকল্পের জন্য অধিকৃত। সামনে এগোলেও মোড় অবধি ফুটপাথ নেই। তাঁদের, বিশেষ করে বাচ্চাটার, দাঁড়ানোর কোনো সুরক্ষিত জায়গা ছিল না।
  • তাঁরা যখন রাস্তা পার হবেন সিগনাল তখনো সবুজ হয়নি, তবে শিগগির হবে। হতে পারে সুরক্ষিত দাঁড়ানোর জায়গা না পেয়ে এবং জেব্রা ক্রসিং আরও খানিকটা সামনে থাকায় তাঁরা গাড়ির মাঝের ফাঁক ফোকর দিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেন বা ভাবতে বাধ্য হন।
  • কিন্তু লক্ষ্য করবেন, রাস্তাটা অর্ধেক পেরোবার পরে ডিভাইডারে দাঁড়ানোর ব্যবস্থাও নেই, বন্ধ করা আছে রেলিং দিয়ে। হতে পারে সেখানে দাঁড়ানোর মত অবস্থা থাকলে এই ঘটনা ঘটত না। তাঁরা হয়ত লরিটার পিছন দিয়ে গিয়ে ডিভাইডারে দাঁড়াতে চাইতেন। হতে পারে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না বলেই যতটা সম্ভব সামনের দিকে চলে আসছিলেন, যাতে মোড়ের কাছে দাঁড়াবার জায়গা পান। নিশ্চিত করে বলা যাবে না, আর সিসিটিভি থেকেও পরিষ্কার বোঝা গেল না।
  • মাথার উপরে মেট্রো স্টেশন থাকায় জায়গাটা দিনের বেলাতেও দেখলাম অন্ধকার। আলোর অভাব যানবাহনের চালক বা পথচারী – উভয়েরই ভুল করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও তার পরোক্ষ প্রভাব থেকে থাকতে পারে।
  • এছাড়া এই আবদ্ধ জায়গায় শব্দ প্রতিধ্বনি তৈরি করছে। গাড়ির/হর্নের আওয়াজ বহুগুণ বেড়ে গিয়ে পাশের মানুষের কথা শুনতেই অসুবিধা হয়। জানি না সৌরনীলের বাবা শেষ মুহূর্তে তাঁদের উপস্থিতি জানিয়ে লরিটাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন কিনা, কিন্তু চেয়ে থাকলেও চালক শুনতে না পেয়ে থাকলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না।

তাই আমাদের মনে হয়েছে:

১) বাস বা অটো স্টপের কাছে রাস্তার পাশে ফুটপাথ (রেলিংমুক্ত, যাতে নেমে ফুটপাথে ওঠা যায়) ভীষণ জরুরি।

২) রাস্তার ডিভাইডার খোলা রেখে সেখানে মানুষ দাঁড়ানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা উচিত, বিশেষ করে যেখানে মানুষ রাস্তা পারাপার হবেন।

৩) বেহালা চৌরাস্তা ভীষণ ব্যস্ত মোড়, অথচ সেখানে রাস্তা পারাপার হওয়ার পরিসর পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া ডাকঘরের দিক থেকে আসা রাস্তা (বীরেন রায় রোড-পশ্চিম) যেহেতু তেরছাভাবে ডায়মন্ড হারবার রোডকে ক্রস করেছে, তাই মোড়টা সাধারণ মোড়ের চেয়ে প্রশস্ত। তাই জেব্রা ক্রসিং দুদিকেই মোড়ের আরও একটু আগে থাকা দরকার, বিশেষ করে যেখানে বাস ও অটো যাত্রী নামায় তার আগে। তাহলে যথেষ্ট জায়গা মেলে, গাড়ির মাঝখান দিয়ে পার হতে হয় না এবং রাস্তা পারাপার করা পথচারী এবং গাড়িকে পাশাপাশি যেতেও হয় না, এখন যেমন হয়।

৪) এখানে আরও অনেক জোরালো আলো দিতে হবে দিনের বেলাতেও। দিনের বেলা বাইরের উজ্জ্বল রোদ থেকে সদ্য অন্ধকারে ঢোকা গাড়ির চালক বা পথচারীর চোখ প্রথমে ধাঁধিয়ে যায়। ভিতরেও যথেষ্ট আলো থাকলে তেমনটা হবে না।

৫) ওই মোড়ের জায়গায় যানবাহনের সর্বোচ্চ অনুমোদিত গতি কম রাখা দরকার। বাচ্চাদের স্কুল যখন আছে, আওয়াজও এতে কমবে।

৬) ডায়মন্ড হারবার রোডে অনেক মানুষ সাইকেলে যাতায়াত করেন (সৌরনীল এবং তার বাবাও অন্যদিন সাইকেলে আসতেন বলে জানা গেছে), কিন্তু সাইকেল সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। কিছু ব্যবস্থা অবশ্যই দরকার, না হলে আরও অবাঞ্ছিত কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে।

শেষে বলি, একটা রাস্তা তৈরি করতে গেলে আগে কী ধরনের এবং কত গাড়ি যাবে তার একটা ধারণা নেওয়া হয় এবং সেই অনুযায়ী রাস্তাটাকে তৈরি করা হয়। কত মানুষ হাঁটবে বা সাইকেল চালাবে তার কোনো ধারণা কি নেওয়া হয়, বা পরিকল্পনায় সেগুলো গুরুত্ব পায়? মনে হয় সঠিকভাবে পায় না, না হলে আজ উপরিলিখিত প্রশ্নগুলো তুলতে হত না। বেহালা চৌরাস্তা শহরের অন্যতম ব্যস্ত একটা মোড়, সেখানে সাইকেলের জন্য ব্যবস্থা দূরস্থান, কোনোদিকেই চলাফেরার উপযুক্ত ফুটপাথ নেই।

খবরে দেখলাম ফুটপাথ বেদখল হওয়ার জন্য হকারদের দায়ী করা হচ্ছে। যা অনুল্লিখিত থেকে যাচ্ছে তা হল, গতির প্রয়োজনে রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে ফুটপাথ তো এমনিতেই কেটে ছোট করে দেওয়া হয়েছে। তার উপর রাস্তার পাশে অসংখ্য গাড়ি, ম্যাটাডোর ও বাইক রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া যেটুকু ফুটপাথ ছিল তাও মেট্রো তৈরির জন্য অধিগৃহীত হয়েছে। বদলে অন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।

আমরা অনেকেই মানুষের হঠকারিতাকে দায়ী করে থাকি, এক্ষেত্রেও করছি। কিন্তু এটাও ঠিক যে সার্বিক অব্যবস্থা স্বাভাবিক মানুষকেও অস্বাভাবিক কাজ করার দিকে ঠেলে দেয়। মানুষমাত্রেই ভুল করে। তাই পরিকল্পনা মানুষের ভুল করার প্রবণতাগুলোকে মাথায় রেখে করাই তো নিয়ম। সবকিছু সাইন বোর্ড দিয়ে তো আটকানো যায় না, স্কুলের সামনে দেওয়া গেলেও সর্বত্র পুলিসও দেওয়া যাবে না। তাই সঠিক পরিকল্পনা দরকার। সহজ, সুরক্ষিত ও উপযুক্ত হাঁটাচলার, পারাপার করার ব্যবস্থা থাকলে কেউ কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চলার রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটবে বা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার করবে? এই পরিকাঠামোগত ব্যর্থতাগুলোকে যদি তুলে না ধরি, যারা দায়বদ্ধ তাদের যদি সঠিক প্রশ্ন না করি, তাহলে আমরা এই অবস্থার উন্নতির একটা সুযোগ হাতছাড়া করব।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.