প্রায় দু বছর ধরে করোনার প্রকোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ বললেই চলে। এর ফলে খানিকটা বাধ্য হয়েই, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, অনলাইন পড়াশুনো চালাতে হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই অনলাইন পঠনপাঠনকে শিক্ষার ভবিষ্যৎ বলে চিহ্নিত করছেন। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই সম্প্রতি ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটা নতুন প্রস্তাব এনেছে। এই প্রস্তাব অনুসারে, আপদকালীন অবস্থার মোকাবিলায় ব্লেন্ডেড মোডে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। খুব সোজা কথায় বললে, এটা অনলাইন ও অফলাইন পড়াশুনোর একটি সংমিশ্রণ। ইউজিসির প্রস্তাব অনুসারে, এই ব্যবস্থায় ৪০% কোর্স অনলাইনে পড়ানো হবে এবং ৬০% অফলাইনে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কারণ বিগত কিছু মাসে একবারের জন্যেও অফলাইন শিক্ষার সুযোগ ঘটেনি অন্তত এ রাজ্যে, এবং এর ফলে কলেজছুটের পরিমাণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এদিকে ডিজিটাল ডিভাইডের সমস্যা এদেশে অনলাইন শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা অনলাইন ক্লাস করতে সক্ষম অর্থাৎ যাদের অন্তত একটা স্মার্টফোন বা কম্পিউটার, এবং একটা নিয়মিত নেটওয়ার্ক কানেকশন রয়েছে তারা এই বিভাজন রেখার একদিকে, আর অন্যদিকে রয়েছে সেই সমস্ত ছাত্রছাত্রী যাদের এর একটা বা কোনটার সুবিধাই নেই। এবং বর্তমান “ডিজিটাল ভারতবর্ষের” দাবী কে নস্যাৎ করে দেখা গেছে এই দ্বিতীয় দলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেকটাই বেশি। এই পরিস্থিতিতে এক এক সময়ে ছাত্র ইউনিয়নগুলো অফলাইন কলেজ শুরুর জোরালো দাবি জানালেও করোনার প্রকোপে তা সম্ভব হয়নি। এবং ভবিষ্যতে কবে সম্ভব হবে তার কোন নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণও শক্ত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই পরিস্থিতিতে তাই দুরকম দাবি উঠে এসেছে। এক, সমস্ত শ্রেণীর শিক্ষার্থীর স্বার্থে আগের মতই উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে পুরোপুরি অফলাইন পড়াশুনো, অথবা, সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর স্বার্থে সম্পূর্ণভাবে অনলাইন শিক্ষা চালু করা। বাস্তবিক, এই দুটো দাবির একটিও সাধারণভাবে সম্পূর্ণ মেনে নেওয়া মুশকিল। তাই ইউজিসির এই ব্লেন্ডেড মোডের অবতারণা। আপাতদৃষ্টিতে হয়ত মনে হবে, সত্যিই এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি বাস্তবোচিত সমাধান সম্ভব নয়। এমনকি প্রযুক্তির সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর চোখে আগামীর উচ্চশিক্ষার প্রথম ধাপ এই ব্লেন্ডেড মোড। এতে সুবিধাহীন ও সুবিধাপ্রাপ্ত দুই শ্রেণীকেই শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে, একই সাথে শারীরিক দূরত্ব বা অন্যান্য ডাক্তারি সাবধানতা মেনে চলাও সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সত্যিই কি বিষয়টা এত সরলরৈখিক? একটু খতিয়ে দেখা যাক।

সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল একটা আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার আভ্যন্তরীন দর্শন। প্রথম বিশ্বের ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে যা সম্ভব, তা এই তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশের আদর্শ হতে পারে না। এখনো এদেশে বহু ছেলেমেয়ে স্কুলের মুখ দেখার সুযোগ পায় না, উচ্চশিক্ষা তো দূর অস্ত। কাজেই অনলাইন মোডের স্বাভাবিকীকরণ করার চেষ্টায় তারা পিছিয়ে পড়বে। ভারতীয় সংবিধানের দর্শন অনুযায়ী পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর অগ্রগতির জন্য সঠিক ব্যবস্থা নিতে সরকার দায়বদ্ধ। এই অগ্রগতির একটা বড় অংশ অবশ্যই তাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আনা, যা যে কোনো সরকারের প্রাথমিক ও নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

এদের মধ্যে আবার যারা উচ্চশিক্ষার গন্ডিতে পা রাখতে সক্ষম হয়, তাদের ক্ষেত্রে আরো বেশি করে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু উচ্চশিক্ষার কোনো কোর্সের ৪০% যদি অনলাইনে পড়ানো হয়, তবে তা প্রকৃতপক্ষে কি এদের জন্য উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সমতুল্য নয়? অর্থাৎ এখন থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পর্যাপ্ত নম্বর বা শিক্ষার প্রতি আগ্রহই আর যথেষ্ট নয়, প্রযুক্তি ব্যবহারের আর্থিক সঙ্গতি এবং একটা স্তর পর্যন্ত প্রযুক্তিবিদ্যার দক্ষতাও হয়ে দাঁড়াচ্ছে অত্যাবশ্যক। এই অবস্থায় পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর কত শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই দুটো বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে? অবশ্য এ কথা ঠিক যে উচ্চশিক্ষা আমাদের দেশে বাস্তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে, তা সে সংবিধান যাই বলুক। বলা যেতেই পারে, যে এমনকি প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতেও উচ্চশিক্ষা সকলের জন্য নয় — এই নীতিই অনুসৃত হয়। কিন্তু সেই নীতির অন্ধ অনুকরণ করে শিক্ষার পণ্যায়ন, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, তাকে উৎসাহ দেওয়া কাম্য নয়।

প্রসঙ্গত এই ব্লেন্ডেড মোডের উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীদের অবস্থা হবে বেশি শোচনীয়। করোনাকালে আমরা দেখেছি স্কুলছুট বা কলেজছুটদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর কোনো একটা পরিবারে যদি দুজন ছাত্রছাত্রী আর একটা মাত্র স্মার্টফোন থাকে, তবে শতাংশের হিসাবে সেই ফোনে ক্লাস করার সুবিধাটা প্রথমেই পাচ্ছে বাড়ির ছেলেটা। এবং, আরো সমস্যার বিষয়, যেহেতু মেয়েটা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না, আইনত বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ তো গেল ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা। আসা যাক শিক্ষকদের প্রশ্নে। এখানে মনে রাখতে হবে, উচ্চশিক্ষা লাভ করে অনেক ছাত্রছাত্রীই শিক্ষকের জীবন বেছে নেন। তাঁদের কেরিয়ারের প্রশ্নটাও আমাদের পরের অংশের প্রশ্নের সাথে জড়িত। এই সময়কালে আপনি টিভিতে নিশ্চয়ই পড়াশুনোর অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখেছেন? সেই বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে যে এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে আপনার ছেলে বা মেয়ে উচ্চশিক্ষার রাস্তায় একাই এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আবারও দর্শনের আরেকটা প্রশ্ন এসে যায়। পড়াশুনো সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়া কি সত্যিই মানবসভ্যতার প্রগতিকে চিহ্নিত করে? অনিয়ন্ত্রিত অটোমেশন হোক বা অ্যাপনির্ভর জীবনযাত্রা (যা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে, বা সার্বিকভাবে মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাকে একাকিত্বের দিকে, অবসাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে) — ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে সত্যিই কতটা প্রয়োজন? খেয়াল করছেন কি, যে এই অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা আপনার বাড়ির ছেলে বা মেয়েটার ভবিষ্যৎ চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করছে? আবারও, এই সমস্যার ক্ষতিকর প্রভাব বেশি পড়বে সুবিধাহীন শ্রেণীগুলোর উপর, কিন্তু এই সুযোগকে ব্যবহার করে সরকার শিক্ষার বেসরকারীকরণ তথা পণ্যায়ন সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করবে। আর সবসময় বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হয় না, এটা যারা বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত তাঁদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। সেখানে পরিষেবার ধার্য মূল্য সরকারি বা আধা সরকারি শিক্ষাকেন্দ্রের থেকে অনেক গুণ বেশি, এবং স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ ভারতীয়ের সাধ্যের বাইরে।

শিক্ষার বেসরকারিকরণের পাশাপাশি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ খরচ কমাবার চেষ্টা করবে সরকার, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে। খেয়াল করে দেখলে দেখতে পাবেন গত কয়েক বছরের বাজেটে এই ধরণের উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত রয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে এদেশে গবেষণার পরিকাঠামোর উন্নতি হয়নি, বরং গবেষকদের ভাতায় টান পড়েছে বা তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে কোন সম্ভবনা নেই তা বোঝাই যায়। আসলে বিজ্ঞানভিত্তিক জরুরি গবেষণার ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়া কতটা সরকারের লক্ষ্য সে প্রসঙ্গও এখানে তোলা যায়। এমন পরিস্থিতিতে ব্লেন্ডেড মোডে উচ্চশিক্ষা হলে তার বিরূপ প্রভাব গবেষণার ক্ষেত্রেও এসে পড়বে বইকি।

প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার আমাদের সামনে আরেকটা সংকট তৈরি করবে। প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসবে। অর্থাৎ চাকরির আরেকটা ক্ষেত্র বন্ধ, এবং বেকার সমস্যা বৃদ্ধি। প্রযুক্তির কুমিরছানা দেখিয়ে খুব সহজেই শিক্ষকদের চাকরি থেকে ছাঁটাই, মাইনে বন্ধ ইত্যাদি চলবে অবাধে। এবং আপনিও ভাববেন, কী দরকার শিক্ষকদের? ওরা তো শুধু বাড়ি বসে মাইনে পাচ্ছে। অর্থাৎ এই শিক্ষক ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তের আপনিও পরোক্ষ অংশীদার হয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা আপনার পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার অধিকারে আঘাত করবে কিনা, ভেবে দেখার হয়ত এই শেষ সুযোগ। এই সময় যদি আপনি সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে ইউজিসির ব্লেন্ডেড মোডের উচ্চশিক্ষার বিরোধিতা না করেন, এই ভেবে যে মাত্র তো ৪০% শতাংশ অনলাইন হচ্ছে, একদিন হঠাৎ চোখ খুলে দেখবেন ওই ৪০ শতাংশটা ৮০ শতাংশ হয়ে ১০০ শতাংশের দিকে এগিয়ে চলেছে। ছোট আধা সরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে, এবং তখন আপনার বাড়ির ছেলে বা মেয়েটাকেও প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে উচ্চশিক্ষার জন্য। ল্যাবরোটরি বা ফিল্ড ওয়ার্ক নির্ভর বিষয়গুলো পড়বে সমস্যায়। কারণ সেখানে হাতে কলমে শিক্ষার একটা প্রয়োজনীয়তা থাকে, যা এক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই ছাত্রের নিজের দায়িত্ব হয়ে পড়বে।

সব শেষে বলা দরকার যে, ভারতের মত দেশে শিক্ষাব্যবস্থার এই অভিন্ন নীতি একেবারেই কার্যকর নয়। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর কোন দেশেই বোধহয় উচ্চশিক্ষার সমস্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই ধরনের অভিন্ন নীতি প্রযোজ্য নয়। ভারতের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি, কারণ এখানে আঞ্চলিক ও সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে শিক্ষানীতির আদর্শগত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তাই অঞ্চলভিত্তিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন নীতি নির্ধারণ করাটা হয়ত স্বশাসিত সরকারি বা আধা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়াই উচিত। বাঁকুড়ার কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজ, যেখানে প্রযুক্তি সেভাবে প্রবেশ করেনি, আর দিল্লীর কোনো নামজাদা ইউনিভার্সিটিতে একই ব্লেন্ডেড মোড চলবে, এমনটা সম্ভব নয়। তাই ইউজিসির এই নীতির তীব্র বিরোধিতা প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সংগঠনগুলো এর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু যতক্ষণ না এই বিরোধিতা সমাজের সব স্তর থেকে আসছে, ততক্ষণ মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশিকায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। তাই শ্রেণি নির্বিশেষে এই ব্লেন্ডেড মোডের বিরোধিতা করা দরকার। না হলে ভারতের উচ্চশিক্ষার কফিনে শেষ পেরেকটা বিনা বাধায় পোঁতা হয়ে যাবে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।