সায়ন্তন চক্রবর্তী

প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের রাজধানীতে বাংলার কোনো ট্যাবলো থাকছে না। পশ্চিমবঙ্গের সরকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে একটি ট্যাবলো সাজিয়ে প্রদর্শন করার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তা পছন্দ হয়নি।

এ নিয়ে যতখানি আলোচনা হওয়া দরকার, তা কিন্তু হচ্ছে না। যতটা জোরে বাঙালির প্রতিবাদ করা উচিত, আমরা তা করে উঠতে পারছি না। আসলে এটা ঠিক আলোচনা বা বিশ্লেষণের বিষয় তো নয়, সোচ্চারে প্রতিবাদ জানানের বিষয়। যদি আমরা দলমত নির্বিশেষে তা না করতে পারি, তাহলে তা লজ্জার তো বটেই, একইসঙ্গে গভীর দুঃখেরও।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লীর রাজপথে অনুষ্ঠিত বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজে বিভিন্ন রাজ্যের ট্যাবলো প্রদর্শিত হয়, যার দ্বারা বিভিন্ন রাজ্যের সরকার সেই রাজ্যের গরিমা, উন্নয়ন, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের কথা সারা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পায়।

কেন্দ্রীয় সরকার এবার প্রজাতন্ত্র দিবসে থিম করেছে ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সেই কেন্দ্রীয় থিমের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নেতাজিকে নিয়ে একটি ট্যাবলোর পরিকল্পনা করে কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্র মন্ত্রকে জমা দিয়েছিল। থ্রি ডি ছবির মাধ্যমে নেতাজির জীবন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস দেখানোর পরিকল্পনা ছিল। কবিগুরুর সাথে নেতাজির যুগলবন্দী এবং আইএনএ-র সেই বিখ্যাত গান “কদম কদম বঢ়ায়ে যা” গানটি আবহে বাজানোরও পরিকল্পনা ছিল।

এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন আধিকারিক কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিকদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেন গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। রহস্যজনকভাবে নতুন বছরের জানুয়ারি থেকে তাঁদের আর বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বক্তব্য পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এ বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে কোন ট্যাবলোকে অনুমোদন দেওয়া হবে না।

স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সেনাপতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর হাতে গড়া আইএনএ-র ইতিহাস দেশের মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয়?

স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির অবদানকে খাটো করার চেষ্টা নতুন নয়। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের বকলমে একটি রাজনৈতিক দলের একটি রাজ্যের মানুষের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এই ঘৃণ্য প্রয়াসে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহান যোদ্ধাকে তাঁর ১২৫তম জন্মোৎসবের বছরে যেভাবে দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল, তা ইতিহাসে বিরল।

অথচ গত বছর পরিস্থিতি একেবারে আলাদা ছিল। এ রাজ্যে তখন নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে এবং দীর্ঘ সাত বছর পরে, নির্বাচনের আগেই নেতাজির জন্মদিবস পালন করতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পরিচালনায় এক বিরাট অনুষ্ঠান হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিমন্ত্রিত ভারতীয় জনতা পার্টির কর্মীরা জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বক্তব্য শুরু করতেই দেননি। নেতাজি সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন উপলক্ষ মাত্র, মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করা।

অর্থাৎ নির্বাচনের আগে নেতাজিকে প্রয়োজন। কবিগুরুর অনুকরণ করে সাদা দাড়ি এবং লম্বা চুল রাখা দরকার এবং নির্বাচনের ফল এদিক ওদিক হলেই দেশের মনীষীদের শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে অসম্মান করতে হবে।

ছেলেবেলায় গরু রচনা মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে যাওয়া নিয়ে অনেক মজার গল্প শুনেছিলাম। এই কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপ সেই গল্পগুলো মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। বিজেপি পরিচালিত উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে নির্বাচন আসন্ন। কাজেই তাদের ট্যাবলো বাদ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। উত্তরপ্রদেশের ট্যাবলোর থিম কাশী বিশ্বনাথ মন্দির এবং উত্তরাখণ্ডের থিম কেদারনাথ মন্দির। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের কেন্দ্রীয় থিমের সাথে এই দুই থিমের কোনো সামঞ্জস্য আছে? কিন্তু নির্বাচন বড় বালাই, উপলক্ষ যা-ই হোক, গরু রচনাই লিখতে হবে। ধর্ম ছাড়া বিজেপির প্রচার করার মত কিছু নেই, অতএব।

এ রাজ্যের প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি এবং অধুনা বিজেপি কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক মাননীয় দিলীপ ঘোষ এতে অন্যায় কিছু দেখছেন না। তাঁর মতে রাজ্য সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করছে, তাই রাজ্যের কোনো ট্যাবলোকে অনুমোদন না দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক কাজই করেছে। অর্থাৎ নেতাজির জীবন ইতিহাস এবং আইএনএ-র ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা মানে বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন জানানো। দিলীপবাবু সরল মানুষ, যে কথা তাঁর দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রকাশ্যে বলেন না তা উনি অবলীলাক্রমে বলে ফেলেন। আসলে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে নেতাজিকে প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের বাংলা বিজেপিকে মুখের মতো জবাব দিয়েছে। তাই কি তিনি এ বছর ব্রাত্য? এ ছাড়া রাজ্যের ট্যাবলো বাদ দেওয়ার আর কী কারণ থাকতে পারে?

ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনতার পর থেকেই বাঙালি বঞ্চিত। বাম আমলে জ্যোতিবাবু যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গুরুত্বের কথা বলতেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের রাজ্যগুলোকে শোষণ ও বঞ্চনা করার কথা তুলে ধরতেন, সেই একই কথা আজও শুনি আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। এই শোষণ ও অবিচার বিজেপির আমলে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঙালিকে দলীয় ভেদাভেদ ভুলে নিরলস ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে।

মতামত ব্যক্তিগত।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.