৭ সেপ্টেম্বর কন্যাকুমারী থেকে শুরু হওয়া ভারত জোড়ো যাত্রা ৭৫ দিন অতিক্রম করেছে। দক্ষিণের পাঁচ রাজ্য পেরিয়ে যাত্রা এখন মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশে, অর্থাৎ তথাকথিত হিন্দি বলয়ের দুয়ারে। দক্ষিণ ভারতে দারুণ সাড়া পাওয়ার পর এই যাত্রা হিন্দি বলয়ে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যাত্রা যেখানে যেখানে গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল মহারাষ্ট্র।
কারণ মহারাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই উত্তর ভারত আর দক্ষিণ ভারতের বিভাজনরেখা। সংস্কৃতি, ভাষা, আদর্শ – সবদিক থেকেই মহারাষ্ট্রের স্থান দুই ভারতের মাঝখানে। কেবল দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই মহারাষ্ট্রে নয়, রাজ্যটা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদরও বটে। আরএসএসের হিন্দুত্বের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বরা – বিনায়ক দামোদর সাভারকর, কেশব বলিরাম হেড়গেওয়র এবং মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর যে মহারাষ্ট্রের লোক এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
অন্যদিকে মহারাষ্ট্র প্রার্থনা সমাজ আর সত্যশোধক আন্দোলনের মত সমাজ সংস্কার আন্দোলনেরও গর্ভগৃহ। এমনকি আম্বেদকরের আন্দোলনের জন্মও মহারাষ্ট্রে, যার তাৎপর্য সম্ভবত এইসব আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
আবার আধুনিক জোট রাজনীতির গতি কোন দিকে তা বুঝে নিতেও মহারাষ্ট্র জরুরি ভূমিকা পালন করে। ভারত জোড়ো যাত্রার পথে এটাই প্রথম রাজ্য যেখানকার রাজনৈতিক জোটগুলো ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পক্ষে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই ওই রাজ্য ভারত জোড়ো যাত্রায় কেমন সাড়া পাওয়া যায় তা নিয়ে প্রচুর কৌতূহল ছিল। শুধু কংগ্রেসের সদস্য, সমর্থক নয়; অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আগ্রহী ছিলেন। ভারত জোড়ো যাত্রার মহারাষ্ট্র পর্বের বিশেষ মুহূর্তগুলো নিম্নরূপ:
প্রথমত, এই পর্বে বিনোদন জগতের বহু ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও বলিউডের মহাতারকারা এই যাত্রাকে এড়িয়ে গেছেন, পূজা ভাট, সুশান্ত সিং এবং অমল পালেকর রাহুল গান্ধীর সঙ্গে হেঁটেছেন।
দ্বিতীয়ত, শরদ পাওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) এবং শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে গোষ্ঠীর মত জোটসঙ্গীরা যাত্রায় পা মিলিয়েছে। সুপ্রিয়া সুলে আর আদিত্য ঠাকরের আগমন রীতিমত সাড়া জাগিয়েছে। ঠাকরে পরিবারের একজন গান্ধী পরিবারের একজনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটছে – এ দৃশ্য অনেকের কাছেই খুব জোরালো বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। বার্তাটা হল তীব্র আদর্শগত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখা সম্ভব। রাহুল আর আদিত্য – দুজনকেই বহুদূর হাঁটতে হয়েছে তাঁদের আদর্শগত পার্থক্যকে অতিক্রম করে পাশাপাশি এসে দাঁড়াতে। দিল্লি আর মুম্বাইয়ের রাজনৈতিক মহলের গুঞ্জন যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাদি (এমভিএ) গঠন করার সময়ে শিবসেনার হাত ধরতে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল রাহুলের।
তৃতীয়ত, শেগাঁওয়ে রাহুলের সভা। বিজেপিচালিত সরকারের সূত্রগুলোই বলছে ওই সভায় নাকি দেড় থেকে দু লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছিল। কংগ্রেসের বক্তব্য তিন লক্ষের বেশি মানুষ এসেছিলেন। যদি বিজেপি সূত্রের খবরটাই ঠিক হয়, তাহলেও ওই সভা মহারাষ্ট্রে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় সভা।
এসবের কোনোটাই কিন্তু জাতীয় সংবাদমাধ্যমের তেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। সেটা ঘটল মহারাষ্ট্র পর্বের একেবারে শেষদিকে এসে। হঠাৎ সকলের ক্যামেরা তথা মনোযোগ রাহুলের উপর হামলে পড়ল, যখন যাত্রা চলাকালীন এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি সাভারকরকে তীক্ষ্ণ ভাষায় আক্রমণ করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস তুলে ধরে। প্রত্যাশিতভাবেই বিজেপির নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো হাঁউ মাউ খাঁউ করে তেড়ে এল। জাতীয় সংবাদমাধ্যম এ পর্যন্ত ভারত জোড়ো যাত্রাকে ব্ল্যাক আউট করেছিল। রাহুলের তোলা বেকারত্ব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, কৃষকদের দুর্দশার মত বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই করেনি। অথচ এইবার তারা সাভারকরকে নিয়ে প্রাইম টাইম বিতর্ক চালু করল।
তাতে কেউই খুব অবাক হয়নি, কিন্তু বহু মানুষ চমকে গেছেন শিবসেনার উদ্ধব শিবিরের তীব্র প্রতিক্রিয়ায়। সেই প্রতিক্রিয়ার পুরোভাগে ছিলেন সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া সঞ্জয় রাউত। তারপর উদ্ধব স্বয়ং এ নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। অমনি গেল গেল রব ওঠে।

দিল্লিবাসী বিশেষজ্ঞরা একের পর এক উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সেসবের মর্মার্থ – ভারত জোড়ো যাত্রার বারোটা বেজে গেছে; রাহুল তাঁর মতাদর্শগত অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে ৭০ দিনের পরিশ্রমে পাওয়া সাফল্যের উপর জল ঢেলে দিয়েছেন। মতাদর্শ সম্পর্কে ধোঁয়াশা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা আঁচ করার প্রবৃত্তি এবং রাজনৈতিক নৈপুণ্যই নাকি তাঁর নেই। সুতরাং এতদ্বারা এমভিএ-র মৃত্যু হল।
কিন্তু কথায় বলে, শকুনের শাপে গরু মরে না। কয়েক দিনের মধ্যেই রাউত এক সোশাল মিডিয়া পোস্টে রাহুলকে ধন্যবাদ জানালেন ফোন করে তাঁর শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়ার জন্য। সেই পোস্টে রাউত উল্লেখ করতে ভোলেননি, রাহুল বলেছেন আগামীদিনেও হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যেতে হবে। রাউত আরও দুটো জরুরি জিনিস স্বীকার করেছেন – ১) কংগ্রেস আর শিবসেনার মধ্যে মতাদর্শগত তফাত আছে, ২) ভারত জোড়ো যাত্রা প্রবল সাড়া জাগিয়েছে, কারণ তা ঠিক পথেই চলছে।

তাহলে সাভারকর প্রসঙ্গে রাহুল-শিবসেনার মতপার্থক্য নিয়ে এত হট্টগোল কিসের? চায়ের কাপে তুফান তোলা ছাড়া এর অন্য কোনো সার্থকতা আছে কি?
একটা কথা পরিষ্কার বুঝে নেওয়া দরকার। এমন নয় যে রাহুল এই প্রথম সাভারকর সম্পর্কে মন্তব্য করলেন এবং ভবিষ্যতে আবার করবেন। সেনাও এই প্রথম তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করল তা নয়। রাহুল ফের সাভারকর নিন্দায় লিপ্ত হলে তারাও আবার অসন্তোষ প্রকাশ করবে। কিন্তু তা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলে স্রেফ বোকামি হবে যে গত ৭০ দিনের ভারত জোড়ো যাত্রা পণ্ডশ্রম হয়ে গেল।
শিবসেনার উদ্ধব শিবির আর কংগ্রেস – দু পক্ষকেই কিছু নির্বাচনী এবং মতাদর্শগত বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। একনাথ শিন্ডে ঠাকরে পরিবারের সঙ্গ ত্যাগ করার যে যে কারণ বাতলেছেন তার অন্যতম হল এমভিএ-র সদস্য হিসাবে হিন্দুত্বের আদর্শকে ছোট করা। এই অভিযোগে কোনো ফল হবে কিনা তার পরীক্ষা এখনো বাকি। কিন্তু ঠাকরে পরিবার যে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রশমিত করতে চাইবে তা বলাই বাহুল্য। সাভারকরের হয়ে কথা বললে যদি সে কাজটা হয় তাহলে তাঁরা তাই করবেন। অবশ্য ঠাকরে পরিবার বা শিবসেনা দলকে কেন সাভারকরের ধামা ধরে থাকতে হয় সে এক রহস্য। ছত্রপতি শিবাজীর নামে যে দলের নামকরণ হয়েছে তাদের সাভারকর বন্দনার প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।
আরো পড়ুন বুলবুলির সওয়ার সাভারকর ও আরএসএস ইতিহাস
সে যা-ই হোক, এখন প্রশ্ন হল, মহারাষ্ট্রের রাজনীতি কি এখন তাহলে থিতু হল? উদ্ধব কি পাকাপাকিভাবে বিজেপিবিরোধী হয়ে গেছেন, নাকি সব পথ খোলা রাখছেন? ভারত জোড়ো যাত্রা এখন উত্তরমুখী, মহারাষ্ট্রে আপাতত আর নতুন কিছু হবে না বলেই মনে হয়। কিন্তু রাজনীতি জিনিসটা পাহাড়ি এলাকার আবহাওয়ার চেয়েও দ্রুত বদলায়; সম্পর্ক বদলাতে কতক্ষণ? এদিকে উদ্ধব এনডিএ-তে ফেরার জন্য দুটো পরিষ্কার শর্ত দিয়ে রেখেছেন। প্রথমত, শিন্ডেকে একেবারে বাদ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেবেন্দ্র ফড়নবীশকে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি থেকে সরে যেতে হবে। প্রথম শর্তটা তবু পূরণ হওয়া সম্ভব, কিন্তু দ্বিতীয়টা বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। বিজেপি বিবেচনা করলেও দেবেন্দ্র এ নিয়ে ভাবতে রাজিই হবেন না। কারণ রাজ্য রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে তাঁর কোনো বৃহত্তর প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। তিনি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কেন্দ্রীয় সরকারের পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মধ্যে জায়গা পাওয়া ছাড়া অন্য কিছুই তিনি মেনে নেবেন না।
ফলে এই মুহূর্তে এমভিএ-র উদ্ধবকে যতটা দরকার, তার চেয়ে তাঁর এমভিএ-কে বেশি প্রয়োজন। সুতরাং তিনি লেগে থাকবেন এবং সব বিকল্পই মাথায় রাখবেন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।