মণিপুর নিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর মুখ খোলাতে বিরোধীদের শেষমেশ অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হল। তারপরেও দীর্ঘ প্রায় সোয়া দুই ঘন্টার ভাষণে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ মিনিট সময়ও খরচ করলেন না। বাগ্মী হিসাবে ভক্তদের নয়নের মণি মোদীজি মণিপুর নিয়ে নির্বাক থাকেন। দেশে কোনো সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি হলেই তিনি নীরব থাকেন। সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন এলেই তাঁর বাকচাতুর্য উধাও হয়ে যায়। তাই তিনি প্রশ্নকে বড় ভয় করেন। সাংবাদিক বৈঠক, সংসদের বিতর্ক এড়িয়ে যান। বিগত নয় বছরে বাক্যবাগীশ প্রধানমন্ত্রীর এই ভয় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। আবার প্রমাণিত হল সদ্য শেষ হওয়া সংসদের বাদল অধিবেশনে। বিরোধীরা সংসদে মণিপুর নিয়ে বারবার প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবি করলেও তিনি সাহস পাননি। অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে প্রায় সোয়া দুই ঘন্টার দীর্ঘ ভাষণে তিনি কংগ্রেসের অপশাসন, পরিবারতন্ত্র এসব নিয়েই যথারীতি সময় কাটালেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যার জন্য কংগ্রেসকে দায়ী করলেন। অথচ ডবল ইঞ্জিনের সরকারের অধীন প্রায় গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের অগ্নিগর্ভ অবস্থা নিয়ে কিছু বললেন না।

কেবল প্রধানমন্ত্রীই নন। দেশে কোনো সমস্যা হলেই তা আড়াল করতে বিগত দিনের কংগ্রেসী অপশাসনকে দায়ী করা প্রত্যেক বিজেপি নেতার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনাস্থা নিয়ে বিতর্কে সরকারি তরফে জবাব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর ভাষণে দেশের নিরাপত্তার থেকেও বেশি গুরুত্ব পেল মণিপুরের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীকে রক্ষা করার প্রয়াস। তার সঙ্গে যথারীতি রাহুল গান্ধীর দিকে ছুড়ে দেওয়া কিছু ব্যঙ্গবিদ্রুপ। মণিপুরের মানুষের প্রাণরক্ষা নিয়ে কেউই দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে পারলেন না। শুধু মণিপুর প্রসঙ্গ নয়। মোদী সরকারের আমলে সংসদ অধিবেশনে বিতর্ককে বারবার গুরুত্বহীন করার চেষ্টা হয়েছে। সংসদে আলোচনা ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নানা বিল পাস করিয়ে নেওয়া হয়। বাগ্মী বিরোধী সাংসদদের নানা কৌশলে বহিষ্কারও করা হয়। এর আগে রাহুল গান্ধীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, এবারের বাদল অধিবেশনে বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরীকে বহিষ্কার করা হল। সংসদ যেন এক রাজদরবার। রাজার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বিরোধী দলনেতা পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্ট খতিয়ে দেখা এই কমিটির কাজ। সম্প্রতি সিএজির বিভিন্ন রিপোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে। তা ধামাচাপা দেওয়াও বিরোধী দলনেতাকে বহিষ্কারের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। দেশের সংসদীয় রীতিনীতি না মেনে, অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করাই বিজেপি সরকারের বৈশিষ্ট্য। এবারের বাদল অধিবেশনে আলোচনা ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করানো যার অঙ্গ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রধানমন্ত্রী যেদিন লোকসভায় জবাবি ভাষণ দেন, সেদিন রাজ্যসভায় পাস করানো হয় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত নতুন বিল। সেই বিলে নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের জন্য গড়া তিন সদস্যের কমিটি থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই কমিটিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকবেন। অর্থাৎ বিরোধী দলনেতার সঙ্গে মতবিরোধ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সরকারই নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করতে পারবে। অথচ সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষমতা একা সরকারের হাতে না রাখার কথা বলেছিল। গত মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট এক জনস্বার্থ মামলায় বলেছিল, যথাযথ আইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলনেতাকে নিয়ে গঠিত কমিটি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবে। লোকসভা নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি আইন করে সেই ক্ষমতা সরকার কুক্ষিগত করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীর লোকসভায় জবাবি ভাষণের দিনটিতেই রাজ্যসভায় এই বিল পেশ করাও হয়েছে ভেবেচিন্তে। এমন সাংঘাতিক বিল অনেকখানি আলোচনার আড়ালে চলে যাবে।

 

লোকসভা নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি আইন করে সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীর লোকসভায় জবাবি ভাষণের দিনটিতেই রাজ্যসভায় এই বিল পেশ করাও হয়েছে ভেবেচিন্তে। এমন সাংঘাতিক বিল অনেকখানি আলোচনার আড়ালে চলে যাবে।

 

বিল আইনে পরিণত হলে সরকারের বশংবদ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনে আর কোনো বাধাই থাকবে না। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা সোনার পাথরবাটির মতোই অবাস্তব হবে। প্রথম থেকেই মোদী সরকার নির্বাচন কমিশন, সিবিআই, ইডি প্রভৃতি সংস্থাগুলোকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে। কার্যত অনেকখানি সফলও হয়েছে। নতুন বিল সেই লক্ষ্যেই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এমনকী বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতেও তারা সদা সক্রিয়। বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বারবার বিচারবিভাগের সঙ্গে সরকারের সংঘাত হয়েছে। আদালতের রায় নিজেদের বিপক্ষে গেলেই তা অমান্য করার জন্য প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স জারি করতেও সরকার পিছপা হয়নি। বাদল অধিবেশনেই সংসদের উভয় কক্ষে পাস করানো হল দ্য গভমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অফ দিল্লি (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২৩। উদ্দেশ্য দিল্লির নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা আরও খানিকটা কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতা বাড়ানো। দিল্লির বিরোধী সরকারের সঙ্গে মোদী সরকারের সংঘাত নতুন নয়। একের পর এক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে দিল্লি সরকারকে তারা প কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করতে চায়। দিল্লি বিধানসভা ভোটে হেরে কেন্দ্রের জেদ আরও বেড়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, সংসদীয় ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি বিন্দুমাত্র মর্যাদা দেখাতে এই ফ্যাসিবাদী সরকার প্রস্তুত নয়। হয় তাদের অন্ধ আনুগত্য স্বীকার করতে হবে, নয় দেশদ্রোহী তকমা জুটবে।

 

বাদল অধিবেশনেই সংসদের উভয় কক্ষে পাস করানো হল দ্য গভমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অফ দিল্লি (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২৩। উদ্দেশ্য দিল্লির নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা আরও খানিকটা কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতা বাড়ানো।

 

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ঘুরিয়ে নিজেদের পক্ষে আনার লক্ষ্যে বাদল অধিবেশনে নির্বাচন কমিশন বা দিল্লি সংক্রান্ত বিল এনেই সরকার ক্ষান্ত থাকেনি। বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে শাসনব্যবস্থার সংস্কার করতে আরও তিন তিনটে বিল পেশ করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন আইন বদলে সরকার ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত ভারত গড়ার কৃতিত্ব দাবি করল। ১৮৬০ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধির বদলে আনা হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বিল, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধির বদলে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের বদলে ভারতীয় সাক্ষ্য বিল। নিঃসন্দেহে এই বিলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ আমলের আইন, দণ্ডবিধি এত বছর ধরে চালু থাকা নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। ঔপনিবেশিক আইনগুলোকে স্বাধীন ভারতে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। কংগ্রেসের আমলে তো বটেই, বিজেপির আমলেও সেই অভিযোগ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু নতুন বিলগুলোর অভিমুখ যদি হয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও পাকাপোক্ত করে মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া, তাহলে তা নিয়ে বিতর্ক হতে বাধ্য।

সেই বিতর্ক এড়াতেই বাদল অধিবেশনের শেষদিনে রীতিমত লুকিয়ে এই তিনখানা বিল পেশ করা হল। শেষদিনের প্রথমেও এই তিনটে বিল নিয়ে আলোচনার উল্লেখ ছিল না। হঠাৎ অতিরিক্ত কাজের তালিকায় যুক্ত করা হয়। বিরোধীদের আলোচনার প্রস্তুতি না দিতেই এই স্বেচ্ছাচারের পথ নেয় সরকার। গণপিটুনিতে মৃত্যদণ্ড, নারী নির্যাতনে কঠোর সাজা, দ্রুত বিচারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই বিলগুলোতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু সরাসরি নাম না করেও রাষ্ট্রদ্রোহে কঠোর সাজার কথা বলা হয়েছে। ন্যায় সংহিতার ১৫০ নং ধারায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে লেখা বা বক্তব্যের মাধ্যমে দেশবিরোধী কাজ, বিচ্ছিন্নতাবোধের মানসিকতায় উৎসাহ দেওয়া, দেশের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতাকে বিপদের মুখে ফেলার মত কাজে যুক্ত থাকার অপরাধে সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হতে পারে।

 

ন্যায় সংহিতার ১৫০ নং ধারায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে লেখা বা বক্তব্যের মাধ্যমে দেশবিরোধী কাজ, বিচ্ছিন্নতাবোধের মানসিকতায় উৎসাহ দেওয়া, দেশের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতাকে বিপদের মুখে ফেলার মত কাজে যুক্ত থাকার অপরাধে সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হতে পারে।

 

শুনতে ভাল। কিন্তু বিগত নয় বছরের অভিজ্ঞতায় এর পরিণাম ভয়ঙ্কর হওয়ার আশঙ্কা। আজকের ভারতে সরকারবিরোধিতা আর দেশদ্রোহিতা সমার্থক। এই ভারতে দাঙ্গাবাজরা সরকারি নিরাপত্তা পায় আর দাঙ্গা রুখতে গেলে ইউএপিএ আইনে জেল হয়। এমনকি নারী নির্যাতনের তথ্যানুসন্ধানও এই ভারতে নাশকতা বলে বিবেচিত হয়। গণপিটুনিতে হত্যার নায়করা মুক্ত থাকে, আক্রান্তদের বাড়ি, দোকান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই দানবীয় ধারার সাহায্যে সরকার যে কোনো প্রতিবাদকে দমন করবে করবে বলেই আশঙ্কা। নাশকতামূলক কার্যকলাপ কোনগুলো তার যথাযথ ব্যাখ্যা সংহিতায় নেই। বিলটা তড়িঘড়ি সংসদে পেশ করেই সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, নানা মহলে আলাপ আলোচনা না করেই তাড়াহুড়ো করে সরকার সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে নিতে চাইছে, যাতে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে তা পাস করিয়ে নেওয়া যায়। লোকসভা ভোটের আগেই এমন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ সরকার সেরে ফেলতে চায়।

সরকারের মনোভাবে অতিকেন্দ্রীকরণ ও স্বৈরাচারী ঝোঁক স্পষ্ট। যার অন্যতম লক্ষ্য হল, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে কর্পোরেট লুঠের পথ আরও মসৃণ করা। বাদল অধিবেশনেই আলোচনা ছাড়া বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিল ধ্বনি ভোটে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে। ২৫ জুলাই যখন মণিপুর নিয়ে সংসদ উত্তাল, তখন তড়িঘড়ি অরণ্য আইন সংশোধনী বিল ও জৈব বৈচিত্র্য সংশোধনী বিল ধ্বনি ভোটে পাস করিয়ে নেওয়া হয়। অরণ্য আইন সংশোধনীতে অরণ্যের সংজ্ঞাই বদলে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে কেন্দ্র স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৯৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা বন জঙ্গল অরণ্য আইনের আওতায় আসবে। বনাধিকার আইন অরণ্যে বনবাসীর অধিকার দিয়েছিল। বিজেপি সরকার প্রথম থেকেই বনাধিকার আইনকে লঘু করতে চেয়েছে। গ্রামসভা বা জনশুনানি ছাড়া কীভাবে বনাঞ্চল দখল করা যায় তার ছক কষেছে। বনবাসীদের পাট্টা না দিয়ে বনবাসী হিসাবে তাদের স্বীকৃতিই কৌশলে বাতিল করেছে। সংশোধিত আইন অনুসারে সরকারি খাতায় অরণ্য বলে চিহ্নিত জায়গা ছাড়া আর কোনো এলাকাকেই বনাঞ্চল বলা যাবে না। বনবাসীদের অধিকারও থাকবে না। দেশের সীমান্তের একশো কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় দেশের নিরাপত্তার অজুহাতে অরণ্য ধ্বংস করেও পরিকাঠামো গড়া যাবে। কেবল সরকার নয়, বেসরকারি সংস্থাও পরিকাঠামো গড়ার দায়িত্ব পেতে পারে। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত, সুন্দরবন, হিমালয় পাদদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বনভূমি দেশের নিরাপত্তার নামে অবাধে ধ্বংস করা যাবে। উন্নয়নের নামে বনাঞ্চল কর্পোরেট সংস্থাগুলো দখল করতে পারবে। সংশোধিত আইন অনুসারে কোনো প্রতিরোধ চলবে না। অর্থাৎ গ্রামসভার অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই।

 

২৫ জুলাই যখন মণিপুর নিয়ে সংসদ উত্তাল, তখন তড়িঘড়ি অরণ্য আইন সংশোধনী বিল ও জৈব বৈচিত্র্য সংশোধনী বিল ধ্বনি ভোটে পাস করিয়ে নেওয়া হয়। অরণ্য আইন সংশোধনীতে অরণ্যের সংজ্ঞাই বদলে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে কেন্দ্র স্বীকৃতি দেয়নি।

 

সংশোধিত জৈব বৈচিত্র্য আইনে প্রাকৃতিক জৈব সম্পদ অবাধে কর্পোরেটগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। ২০০২ সালে দেশে প্রথম এই সংক্রান্ত আইন চালু হয়। আইনে জৈব সম্পদ ব্যবহারে স্থানীয় জনজাতির সম্মতির কথা বলা হয়েছে। তাদের সম্মতি ছাড়া জৈব সম্পদ লুঠ করা যেত না। দেশের বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর জৈব সম্পদ ব্যবহারে পরম্পরাগত জ্ঞান ও অভ্যাস পুঁজি আগ্রাসনের বিরোধী। তাঁদের কাছে জৈব সম্পদ সামাজিক সম্পদ। তাঁরাই এতদিন এগুলোকে রক্ষা করে এসেছেন। কিন্তু এখন সেই সামাজিক সম্পদকে নিজেদের সম্পদে পরিণত করতে চায় বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা। সেই লক্ষ্যেই আইন সংশোধন করা হল। জৈব সম্পদের ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলা রয়েছে। জনজাতি গোষ্ঠীগুলোর দীর্ঘকালের রক্ষণাবেক্ষণে সুরক্ষিত জৈব সম্পদ এখন চলে যাবে কর্পোরেটের দখলে। সংশোধনী অনুসারে, দেশ বা বিদেশের যে কোনো সংস্থা জৈব সম্পদের উপর করা কোনো গবেষণা বা তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে কোনো আবিষ্কার, পরম্পরাগত জ্ঞানসহ এই সংক্রান্ত মেধা সম্পত্তির অধিকার পেতে পারে। তার জন্য সরাসরি জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষের থেকে পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। পঞ্চায়েত বা রাজ্যের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। স্থানীয় মানুষ, এমনকি রাজ্য সরকারও নয়, কেন্দ্রীয় অনুমোদন নিয়েই দেশের এই প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করা যাবে। বিনিময়ে উচ্ছেদ হবেন এতকাল ধরে জৈব বৈচিত্র্য রক্ষা করা স্থানীয় জনজাতি গোষ্ঠীগুলো।

বাদল অধিবেশনে মাইনস অ্যান্ড মিনারেলস (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) আইন সংশোধনের বিলও পাস করা হয়েছে। সেটাও হয়েছে আগেরগুলোর মতই আলোচনা ছাড়া, ধ্বনি ভোটে। লিথিয়াম, বেরিলিয়াম সহ ছটা খনিজ সম্পদ বেসরকারি হাতে চলে যাবে। সোনা, রুপো, তামা, সিসা প্রভৃতি খনিও নিলাম ডেকে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে দিয়ে দেওয়া হবে। অতি মূল্যবান খনিজ সম্পদের মালিকানা চলে যাবে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার হাতে।

আরো পড়ুন বেসরকারিকরণে বেলাইন ভারতীয় রেল

সংসদের বাদল অধিবেশনে এভাবে তিনটে সংশোধনী বিল এনে দেশের জল-জমি-জঙ্গল-খনি বড় বড় কোম্পানির হাতে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হল। বিগত দিনগুলোতে বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠী এগুলো রক্ষা করতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। জনশুনানি, গ্রামসভা ইত্যাদি তাঁদের বড় হাতিয়ার। প্রাকৃতিক, সামাজিক সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা বারবার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যকে এখনো তাঁরাই রক্ষা করে চলেছেন। মধ্য ভারতের বনাঞ্চল থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব ভারত, কাশ্মীর থেকে আমাদের দক্ষিণের সুন্দরবন – চারিদিকে এখন কর্পোরেট শকুনের নজর। দেশের নিরাপত্তার নামে, উন্নয়নের নামে তাদের লুঠের স্বাধীনতা দিতে হবে। না দিলেই নয়া দণ্ড সংহিতায় দেশদ্রোহিতার চরম শাস্তি। স্থানীয় জনজাতি গোষ্ঠীগুলোকে উচ্ছেদ না করলে এই লুঠ চলবে না। তাই আজ তাঁরাই দেশের সরকারের কাছে দেশদ্রোহী, অনুপ্রবেশকারী। জনজাতি গোষ্ঠীগুলোর নিজেদের মধ্যে মণিপুরের মত দাঙ্গা লাগানোর লক্ষ্যও তাই। এতে উচ্ছেদের রাস্তা সুগম হবে। সংসদে আলোচনা না করে, সংসদীয় রীতিনীতি না মেনে কর্পোরেট লুঠের সুযোগ করে দিতে রচিত বা সংশোধিত হবে নানা আইন। সুপ্রিম কোর্টকেও তোয়াক্কা করার দরকার নেই। নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব সরকারের হাতে চলে এলে নির্বাচন তো স্রেফ আনুষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়াবে। ফ্যাসিবাদ এক নতুন ভারত গড়তে চাইছে – প্রতিবাদহীন কর্পোরেটতান্ত্রিক ভারত। এবারের সংসদের বাদল অধিবেশন সেই পথে অনেকটা এগিয়ে গেল।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.