সুব্রত মুখোপাধ্যায়
জরুরি অবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাকে প্রথমেই যেটা বলতে হবে, তা হল, আমার জীবনে এটা কেবল একটা রাজনৈতিক ঘটনা নয়। জরুরি অবস্থা আমার কাছে খুব ব্যক্তিগত একটা বিষয়। জরুরি অবস্থার সঙ্গে আমি একদম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম। এক কথায় বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গে আমিই ছিলাম জরুরি অবস্থার প্রধান সরকারি কুশীলব। সে জন্য আমাকে বিস্তর গালমন্দও করা হয়েছে। তাতে আমার দুঃখ নেই। এসব রাজনৈতিক জীবনের অঙ্গ। আমি যেটা বলতে চাই, ইন্দিরা গান্ধীর সৈনিক হিসাবে দেশের একটা ক্রান্তিলগ্নে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেনাবাহিনীকে যখন বিদ্রোহ করতে উস্কানি দেওয়া হচ্ছিল, পুলিশ প্রশাসনকে যখন বলা হচ্ছিল সরকারি আদেশ অমান্য করতে, গোটা দেশজুড়ে যখন লাগামছাড়া নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা চলছিল, তখন আরও অনেকের মতো আমিও নিজের কর্তব্যে অবিচল ছিলাম। তাই পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থার ভালমন্দের দায় আমারও। ভাল কাজের কৃতিত্বেরও যেমন আমি ভাগীদার, তেমনই যে বাড়াবাড়ি হয়েছিল, তার দায়ও আমাকে নিতে হবে। আমি তা নিয়েও থাকি। এড়িয়ে যাই না।
কেন জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল, সেই আলোচনায় আমি যেতে চাই না। সকলেই তা জানে। আমি এখনও দৃঢ়ভাবে এমার্জেন্সির পক্ষে৷ ১৯৭৫ সালের জুন মাসের শেষের দিকে এমার্জেন্সি জারি না করে যে কোনও উপায় ছিল না, এই কথাটা সুব্রত মুখার্জি দৃঢ়ভাবে মনে করে। মিসেস গান্ধী যা করেছিলেন, একদম ঠিক করেছিলেন। সংবিধান মেনে, দেশের আইন মেনে সবকিছু করা হয়েছিল। বেআইনি ভাবে তো কিছু হয়নি৷ দেশের মানুষের একটা বড় অংশ তা সমর্থন করেছিলেন। সেই জন্যই তো সাতাত্তরের ধাক্কার পর আবার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মিসেস গান্ধী ফিরে এলেন। মানুষ যদি জরুরি অবস্থার এতই বিরোধী হবে, তাহলে তো ওঁকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করত। তা তো হয়নি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এমার্জেন্সির সময় সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। ঠিক কথা। তবে সেটা সংবিধান মেনেই করা হয়েছিল। আমি নিজে খবরের কাগজে কী ছাপা হচ্ছে দেখতাম। রাজ্যের মন্ত্রী হিসাবে এটা আমার কাজ ছিল। আমি দেখে অনুমোদন দিলে তবে সেটা ছাপা হত৷ কাজ করলেই ভুল হয়। এক্ষেত্রেও হয়েছিল। গণশক্তির সরোজ মুখার্জি আমার কাছে এসেছিলেন। ওঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির” ছাপতে চান। আমি সটান না করে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল দেশের যা অবস্থা তাতে ওই কবিতার অন্য অর্থ হবে। এটা আমি ঠিক করিনি৷ এখন ভাবলে খারাপ লাগে। আনন্দবাজার সহ আরও কিছু পত্রিকার নামজাদা সাংবাদিকরাও সরকারি নজরদারির প্রতিবাদ করেছিলেন। কেউ কেউ তো গলায় বকলস বেঁধে মিছিলও করেছিলেন। কী আর বলব! তবে সার্বিকভাবে আমি মনে করি সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি ছিল। আবারও বলছি, এটা বেআইনি নয়। সংবিধানসম্মত৷ তাহলে এত বিতর্ক কেন?
তবে এমার্জেন্সির ভাল দিকগুলোকে অনেকটাই ঢেকে দেয় তার বাড়াবাড়িগুলো। হ্যাঁ, সে সময় বাড়াবাড়ি হয়েছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রচুর সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কেন এটা হবে? এটা ঠিক হয়নি। এগুলোর জন্য আমি লজ্জিত। আমার গ্লানি বোধ হয়। তবে এগুলো নিছকই বাড়াবাড়ি। এমার্জেন্সি দেশের মানুষকে ডিসিপ্লিনড করেছিল। ট্রেন-বাস ঠিক সময়ে চলত। ঘুষ বন্ধ হয়েছিল। বিরোধীদের নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা বন্ধ হয়েছিল। এগুলোকে বাদ দিয়ে যদি কেউ কেবল বাড়াবাড়িগুলোর কথা বলেন, তাহলে সঠিক বিচার হবে না। আর সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালই ছিল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় যখন রাইটার্সের প্রেস কর্নার ভেঙে দিলেন, তখন আমি সাংবাদিকদের নিজের ঘরে এনে বসিয়েছিলাম, চা খাইয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী খুব একটা ভাল নজরে দেখেননি বিষয়টা। আরে, আমি তো দেশের স্বার্থে কাজ করছি৷ খামোকা দুর্ব্যবহার করব কেন মানুষের সঙ্গে?
জরুরি অবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার প্রিয়দার কথা মনে পড়ে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হল। তখন আর ‘প্রিয়-সুব্রত’ নেই৷ প্রিয় একা, সুব্রতও একা। তার বছর দুয়েক আগেই আমাদের জুটি ভেঙে গেছে। সঞ্জয় গান্ধী তখন নতুন নক্ষত্র। উনি প্রিয়দাকে সরিয়ে যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব দিলেন অম্বিকা সোনিকে। প্রিয়দা মিসেস গান্ধীকে ছেড়ে শরদ পওয়ারের দিকে চলে গেল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি প্রিয়দার বাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসেছিলাম। বলেছিলাম, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেই থাকব। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর বিকল্প নেই। ইতিহাস প্রমাণ করেছে আমি ঠিক ছিলাম।
আমার কোনও আক্ষেপ নেই। জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত আমি এখনও একইরকমভাবে সমর্থন করি৷ হ্যাঁ, বাড়াবাড়িগুলো না হলেই ভাল হত। সে জন্য লজ্জিত। কিন্তু দেশের জন্য ওই সময় জরুরি অবস্থা জারি না করে উপায় ছিল না৷ আরেকটা কথা বলি, ওটা তো সংবিধান মেনে করা হয়েছিল। ঘোষণা করে, আইন মেনে করা। আর এখন তো অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। বেআইনি, সংবিধানবিরোধী জরুরি অবস্থা। এটা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
ইন্দিরা গান্ধী পরে বলেছিলেন, আর কখনও দেশে জরুরি অবস্থা জারি হবে না। হয়তো তাই। কিন্তু সেই সময়ে আমার ভূমিকার জন্য সার্বিকভাবে আমি গর্বিত। যা করেছি, ঠিক করেছি।
অনুলিখন: অর্ক
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।