সম্প্রতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস্’, সঙ্গে তীব্র জলোচ্ছ্বাস, দিঘা ও সন্নিহিত শঙ্করপুর-মন্দারমনি’কে তছনছ করে দিয়েছে। রঙিন টাইলস্ আর পেভার ব্লকে মোড়া আধুনিক দিঘার তট বিধ্বস্ত। বোল্ডার আর কংক্রিটের বর্ম এই প্রলয়ের কাছে ছিল অসহায়। উপকূল রক্ষার আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এতদিন দিঘা এবং আশপাশের অপরিকল্পিত বিস্তার হয়েছে। ভবিষ্যতেও আশা করা যায় এমনটাই চলতে থাকবে।

দিঘা ও ঝাউবন। কেমন-কেমন লাগছে? এ যেন গল্পকথা। অথচ পাঁচ দশক আগেকার স্মৃতি বলছে, ঝাউপাতা ঘুমাত না। রাতভর তাদের ফিসফিসানি চলত। ১৯৬৮-তে পুজোর গানে পিণ্টু ভট্টাচার্য গাইলেন, “চলো না দিঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায় / শুরু হোক পথচলা, শুরু হোক কথা বলা।” তখন দিঘার বানানে চলত দীর্ঘ-ঈ। সূর্যসোনার তট দিঘায় কিন্তু ছায়াও ছিল, ঝাউবনের ছায়া— তা যেন পিণ্টু-কণ্ঠে ঝরে-পড়া প্যাথস্ (Pathos)! অনুরোধের আসরে সেই সুর, সেই গায়ন শুনলে ছেয়ে যেত এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা! যা দিঘার এক অদ্ভুত কল্পছবি মনে এঁকে দিয়েছিল। যদিও এ-গানের মর্ম বোঝার বয়স তখন হয়নি।


এর পরের বছরেই প্রথম বার দিঘা যাওয়া, বাড়ির সকলের সঙ্গে। ট্রেনে খড়্গপুর, সেখান থেকে বাসে। আমরা উঠেছিলাম সরকারি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলো বা কটেজে। সঙ্গে বাবার বন্ধুর পরিবার। একসারি কটেজর চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে ঘন ঝাউবনের মধ্য দিয়ে পাড়ে পৌঁছে কিছুটা নীচে নামলে তবেই সৈকত। এখনও সেই কটেজগুলো আছে, তবে মূল দিঘা থেকে ঝাউবন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বহুদিন আগে। সমুদ্র এগিয়েছে। তখনকার শান্ত দিঘা এখন এক চিৎকৃত উল্লাসভূমি, যার দরজায় দাঁড়িয়ে উৎকট এক প্রবেশতোরণ।

দিঘায় মুগ্ধ ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৫ নাগাদ সেখানে বাংলো বানিয়েছিলেন, অবকাশ যাপনে। তখন এলাকার নাম ছিল বীরকুল। দেখাদেখি সাহেবসুবোরাও নাকি বেশ ক’টি আস্তানা গড়েন! ছিল ম্যানগ্রোভের বন, সেইসঙ্গে বন্য জন্তুও। সমুদ্র ক্রমাগত এগিয়ে এসেছে, ঢেউয়ের নিরন্তর আঘাত আর ভূমিক্ষয়ে সে-সব বাড়িঘর পরের পঞ্চাশ বছরে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। আজকের দিঘা থেকে তা অন্তত পাঁচ কিমি দূরে, সমুদ্রগর্ভে। উনিশ শতকের বাঙালি কেউ কি গিয়েছিলেন সেখানে? হয়তো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। চাকুরিসূত্রে এই অঞ্চলে বেশ ঘোরাঘুরি করেছেন তিনি। উপকূলের টোপোগ্রাফি সম্যক্ জেনেছিলেন— হয়তো সরেজমিন পরিক্রমায়। ‘কপালকুণ্ডলা’ থেকে টুকরো অংশ : “রসুলপুরের মুখ হইতে সুবর্ণরেখা পর্য্যন্ত অবাধে কয়েক যোজন পথ ব্যাপিত করিয়া এক বালুকাস্তূপশ্রেণী বিরাজিত আছে।… এক্ষণে লোকে উহাকে বালিয়াড়ি বলে।… স্তূপতলে সামান্য ক্ষুদ্র বন জন্মিয়া থাকে… অধোভাগমণ্ডনকারী বৃক্ষাদির মধ্যে, ঝাটী, বনঝাউ এবং বনপুষ্পই অধিক।” এই রসুলপুরের মোহানা থেকে সুবর্ণরেখার মাঝেই কিন্তু তৎকালীন বীরকুল, আজকের দিঘা।

পিন্টু ভট্টাচার্যের গানের বছর-ছয়েক বাদে, ১৯৭৪-এ মুক্তি পেল ‘বিকালে ভোরের ফুল’ ছবিটি। পীযূষ বোসের ছবি মানেই উত্তমকুমার। এখানেও তা-ই। আগাগোড়া প্রায় পুরো লোকেশন-ই দিঘা। শুরুতেই বাসভর্তি একঝাঁক ছেলেমেয়ের গান— চলেছে দিঘার উদ্দেশে— সঙ্গে তাদের ক’জন শিক্ষক— সেই চনমনে কোরাস : “ওই ডাকছে, শুনি ডাকছে, নীল সমুদ্র ডাকছে / চলো চলো চলো চলো বেরিয়ে পড়ি।” সন্দেহ নেই, গানটি সে-সময়ে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা : “এই কলকাতা ছাড়িয়ে / যাই হাওড়া ব্রিজটা পেরিয়ে / বম্বে রোডের পথ ধরি / মরি মরি / ডাকছে আমায় দিঘাসুন্দরী।” তরুণ মুখগুলো সত্যিই যেন সে-সময়কার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের। এদের মধ্যে ওই যে-ছেলেটি— দাড়িওলা, সিটের উপর পা তুলে গিটার হাতে আমেজে গলা মেলাচ্ছে— বিলক্ষণ চিনতাম। দীপক রবসন। বেশ ভালো গাইতেন, ও-ই গিটার বাজিয়ে। একবার মঞ্চে ওনার গলায়, কিশোরকুমারের সদ্য তোলপাড়-করা “জিন্দেগি কে সফর মেঁ গুজর যাতে হ্যায় জো মকাম…” গানটি (ছবি : আপ কি কসম) শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম, খুব মনে আছে। পেশায় ছিলেন শিক্ষক, ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলে। প্রসঙ্গান্তর, তবু মনে-পড়ে-যাওয়া কথাগুলো বলে ফেললাম।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তো দ্যাখো কাণ্ড! এই হুল্লোড়ের গানে হেমন্তবাবু কিনা শিবরঞ্জনী লাগিয়েছেন! এর বছর-বারো আগে এই রাগেই তিনি বেঁধেছিলেন সেই মনছোঁয়া গান “কহিঁ দীপ জ্বলে ইয়া দিল…”— ‘বিস্ সাল বাদ’ ছবিতে। কিন্তু সে-গান ছিল চাপা কান্নার। শিবরঞ্জনী মানে তো জমাট নিঃসঙ্গ বিষাদ। দলবদ্ধ উচ্ছ্বাসে সোনাবেলার দিকে যেতে-যেতে শিবরঞ্জনী! তবে কি ঝাউবনের ছায়ায় মিশে থাকে অনিবার্য বিষণ্ণতা? রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে : আমার বেদনা ব্যাপিয়া যায় গো ঝাউবনমর্মরে মর্মরে…!
এর ঠিক সাত বছর পর আবার সাগরবেলা, আবার শিবরঞ্জনীর দিগ্বিজয়। ছবি : এক দুজে কে লিয়ে (১৯৮১)। গান : তেরে মেরে বিচ মেঁ…। (‘Beach মেঁ’-ও বলা যায়)। দু’টো ভার্সন। অপ্রতিম লতা মঙ্গেশকর ছন্দোময়তায়, এবং বিষাদরূপে লা-জবাব এস পি বালসুব্রহ্মণ্যম্, সদ্য-উদিত। ছবির অন্তিমে শোকাবহ পরিণতি। কাহিনির সেই অপার বিচ্ছেদই কি সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল’কে প্রণোদিত করেছিল শিবরঞ্জনীতে আবিষ্ট হতে? গানের লোকেশন গোয়া আর ভাইজাগের বেলাভূমি— পশ্চিমঘাট আর পূর্বঘাটের শেষ তরঙ্গ সেখানে লবণঢেউয়ের সঙ্গে মিশছে! পাথুরে সাগরতট, কোথাও-বা খাড়া পাথরের। পাম গাছের সারি।
এই যে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার দিঘা ধরা রয়েছে ‘বিকালে ভোরের ফুল’-এ, সেটুকু আমরা চোখ ভ’রে দেখে নেব না? যেমন ছ’ দশক আগেকার পুরী-কোণার্কে হারিয়ে যেতে হয় তপন সিংহের ‘নির্জন সৈকতে’ (১৯৬৩) দেখতে বসলে। অমূল্য ডকুমেন্টেশন।

ছোটবেলার সেই শান্ত, নিঝুম দিঘা এখনও অনুভবে। সেই দিঘাসুন্দরী এখনও আমায় ডাকে। দিঘার জনক বলা যায় জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ-কে, রূপকার বিধান রায়। বেহালা ফ্লাইং ক্লাব থেকে স্নেইথ সাহেব দিঘায় আসতেন প্লেনে, মারা যান এখানেই ১৯৬৪-তে, সেই প্লেন নামত সৈকতে। তারপর তাঁর উত্তরাধিকারীও কিছুদিন এ-ভাবেই যাতায়াত করেছেন। ট্যুরিস্ট ব্যুরোর (প. ব. সরকার) সে-সময়কার প্রচারপত্রী-তে প্লেনের ছবি দেখা যায়। তখন হাতেগোনা ক’টি মাত্র থাকার জায়গা। এখন তো অগুনতি হোটেল, লাগামছাড়া বেআইনি নির্মাণ, এমনকী চোখে পড়ে সৈকতের বালিখাদান-ও!
একেক সাগরের একেক চরিত্র। এবং প্রতিটি সৈকতেরও। দিঘা, পুরী, গোপালপুর, বিশাখাপত্তনম্ বা মহাবলীপুরম্— নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আমাদের আকর্ষণ করে চলেছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এদের একই জঁর। আর তা হল বঙ্গোপসাগর। যা থেকে আমাদের কল্পনা প্রসারিত হয়ে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, পূর্বজদের বাণিজ্যযাত্রায়, সেইসঙ্গে পাল-রাজত্বে বা বিজয়নগরে। আমাদের সঙ্গে থাকবেন চাঁদ সদাগর। এসে পড়বে পুলিকট, মসুলিপত্তনম্, চাঁদবালি, তাম্রলিপ্ত, খেজুরি, বেতড়, হুগলি প্রভৃতি হারিয়ে-যাওয়া বন্দরনামা। মালাক্কা প্রণালী পেরোলেই অবাধ বাণিজ্যের হাতছানি! প্রণালীর দোরগোড়ায় ‘বন্দর-আচে-দার-উস-সালাম’ জবরদস্ত এক বন্দর, বিবর্তিত নাম ‘বান্দা আচে’।
মনে আছে, সেই যাত্রায় কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বালক আমি। দুপুরবেলা। ঘন মেঘ ও গর্জন। ঝাউবন দুলছে। বৃষ্টি শুরু হতেই অন্য কোনও কটেজ থেকে ভেসে এল সনৎ সিংহের গান : “ঠিক দুক্কুরবেলা ঘুরঘুট্টি / থইথই মেঘ কালো কুরকুট্টি /… / ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঢিল / চিল কয় ঢিল নয়, শিল শিল শিল।” কটেজের বিছানায় ছিল তখনকার জীবনযাত্রার লোভনীয় এক উপাদান, ‘ডানলোপিলো’-র গদি। সক্কলে আমরা হাঁ হয়ে দেখেছিলাম, পূর্ববর্তী কোনও আবাসিক-পুঙ্গব কী নির্মম নিপুণতায় গদির এক বড় অংশ কেটে নিয়ে গেছে! (স্টেট বাসের গদিরও একই পরিণতি হত। শেষ পর্যন্ত নারকেল ছোবড়াতেই আমাদের সন্তুষ্টি)। ফেরার পথে সে-ই খড়্গপুর পর্যন্ত বাসে, প্রাইভেট বাস। ওই রুটে তখনকার ডিলাক্স বাস মোটে দু’টি, নাম এখনও গেঁথে আছে— সি-কিং আর সি-গ্রেট। তারই একটিতে এসে বাকিটা ট্রেনে।

(চিত্রসৌজন্য : লেখক)
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
প্রিয় পাঠক,
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
রেজিস্টার করুন আমাদের ওয়েবসাইটে
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।