গত কয়েক দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরে ভাষা সন্ত্রাস যে নতুন মাত্রা লাভ করেছে তা নিয়ে বোধহয় সন্দেহের অবকাশ নেই। এই সন্ত্রাস দ্রুত রাজনৈতিক সীমানা অতিক্রম করে বারবার আঘাত করছে সামাজিকভাবে প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলিকে, বাদ যাচ্ছেন না প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরাও। ফলে বারবার অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কয়েকদিন আগে ধর্মতলা থেকে পাবলিক বাসে উত্তর কলকাতার বরানগরে চলনজনিত প্রতিবন্ধকতার জাতীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পূর্বতন NIOH) যাচ্ছিলাম। বাস থেকে নামার সময় কন্ডাকটর সাবলীলভাবে বললেন “পঙ্গু নামছে, আস্তে!” কথাগুলি শুনে এখন আর কষ্ট লাগে না। ফলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ইচ্ছাও হল না। আর দিয়েই বা কী হবে? যখন দেখি রাজ্য তথা দেশের তাবড় তাবড় পরিবারের তথাকথিত শিক্ষিত নেতারা বিরোধী দলগুলোকে হীনতর প্রতিপন্ন করতে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে তুলনা করেন। এই তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন কলকাতার মহানাগরিক ও রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট মন্ত্রী। একদা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বা চিত্তরঞ্জন দাশের মত মানুষ যে চেয়ারে বসতেন, সেই চেয়ারের বর্তমান অধিকারী ফিরহাদ হাকিম রামপুরহাটের এক সভায় রাজ্যের বিশ লক্ষাধিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের (২০১১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী) পক্ষে কিছু অপমানজনক শব্দ প্রয়োগ করেছেন। শুধুমাত্র শব্দপ্রয়োগে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি অতি উৎসাহে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের প্রাত্যহিক অসুবিধাগুলি নিয়েও সমানভাবে বিদ্রুপ করেছেন। যদিও পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে এ ঘটনা একেবারেই নতুন নয়। বছর কয়েক আগে অধুনা রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী, তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিখ্যাত গায়ক বাবুল সুপ্রিয় প্রতিবন্ধী মানুষদের সহায়তামূলক যন্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক ব্যক্তির উদ্দেশে বলেছিলেন “মেরে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব, তারপর একটা ক্রাচ ধরিয়ে দেব”। শুধু এ রাজ্যে নয়, বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের মন্ত্রিসভার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মন্ত্রী সত্যদেব পাচৌরি তাঁর দপ্তরে কর্মরত এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে প্রতিবন্ধকতার জন্য অপমানজনক কথাবার্তা বলেছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের বারংবার এহেন আচরণের কারণ নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে।

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সম্বোধন বা পরিচয় সত্তার প্রকাশে কী ধরণের ভাষার ব্যবহার শোভনীয় বা অশোভনীয়, তা নিয়ে বাজার চলতি বা প্রচলিত কোনো অভিধান নেই। তবে মানুষের দুর্বলতা যে তার পরিচয় হতে পারে না, এটা বোধহয় অস্বীকার করা যায় না। প্রসঙ্গক্রমে, ঐতিহাসিক পরিসরে প্রতিবন্ধকতার পরিচয় বা সত্তা নির্মাণের ইতিহাস একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর এক সমীক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে অবগত হতে ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ (specially abled) কথাটি যুক্ত করেছে। গত এক দশকে গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় differently able person বা ‘অন্যভাবে সক্ষম ব্যক্তি’ কথাটিও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যদিও তার ভিত্তি বা দর্শন নিয়ে প্রতিবন্ধকতা অধিকার কর্মী বা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানারকম মত দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, প্রত্যেক মানুষই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অন্যের থেকে বেশি সক্ষম, ফলে ‘অন্যভাবে সক্ষম’ কথাটি আদতে দ্বিধার জন্ম দেয়। কিন্তু এক বিপুল অংশের মানুষের ধারণা রয়েছে, এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করলে প্রতিবন্ধী মানুষদের বেশি সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে এই পরিবর্তনের ইতিহাস আরও কিছুটা প্রাচীন। ১৯৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে handicapped-এর পরিবর্তে disabled (অক্ষম) শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা গিয়েছিল। পরের দশকে disabled শব্দের পরিবর্তে persons with disabilities (প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তি) ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তার পিছনে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের দীর্ঘকালীন আন্দোলনকে অস্বীকার করা যায় না।

এই ধরনের ভাষার প্রয়োগ নিঃসন্দেহে প্রতিবন্ধকতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। পাশ্চাত্য প্রভাবিত এহেন ভাষাগত পরিবর্তন ভারতেও গত কয়েক দশকে বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকে প্রতিবন্ধী মানুষদের ‘সামাজিকভাবে দুর্বল গোষ্ঠী’ (weaker section of the society) হিসাবে প্রতিপন্ন করা হত বলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ একাধিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। ১৯৭০-এর দশকে থেকে সর্বভারতীয় স্তরে ‘handicapped’ শব্দটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করে, যার প্রচলন আজকের দিনেও অনেকাংশে দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থায় তার ব্যবহার বেশি চোখে পড়ে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে অবশ্য সরকারী প্রতিবেদনগুলিতে ‘অক্ষম ব্যক্তি’র (disabled persons) ব্যবহার লক্ষ কররা যায়। পরবর্তীকালে প্রতিবন্ধী মানুষদের দ্বারা সংগঠিত আন্দোলনের ফলস্বরূপ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারতে ‘প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তি’ (persons with disabilities) কথাটির প্রয়োগ শুরু হয়। যার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৯৫ সালে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ (সমান সুযোগ, অধিকার রক্ষা ও সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ) আইন এবং ২০১৬ সালের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ অধিকার আইনে।

ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি ভাষায় প্রতিবন্ধী মানুষদের দীর্ঘদিন ‘বিকলাঙ্গ’ প্রতিপন্ন করা হচ্ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর হঠাৎ খেয়ালে একদিন ‘দিব্যাঙ্গ’ (মন কি বাত নামক বেতার অনুষ্ঠানে প্রথম এই শব্দ ব্যবহার করেন ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর) বলতে শুরু করলেন। তাঁর ভক্তরা অতি দ্রুত শব্দটিকে জনপ্রিয় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ট্রেন, বিমানবন্দর সর্বত্রই দিব্যাঙ্গ কথাটি চোখে পড়ে। আবার আঞ্চলিক পরিসরে প্রতিবন্ধকতাকে বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য সরকারি স্তরে দীর্ঘদিন persons with disabilities-এর বাংলা তর্জমা ‘প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তি’ ব্যবহার হয়। রাজ্য সরকারের প্রতিবন্ধকতা কমিশনারের দপ্তরের প্রকাশিত প্রতিবেদনেও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তি কথাটি আনুষ্ঠানিক স্বাকৃতি লাভ করেছে। যার আক্ষরিক অর্থ করা যেতে পারে, প্রাত্যহিক চলার পথে যারা বাধা বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে ‘প্রতিবন্ধী মানুষ’-ও বলা যেতে পারে। আবার ব্যক্তির প্রতিবন্ধকতার ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা শব্দের ব্যবহার করা হয়। যেমন বধির, দৃষ্টিহীন বা চলনজনিত প্রতিবন্ধী। তবে গ্রামবাংলায় প্রচলিত ভাষায় তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ অনেক সময় কানা, খোঁড়া, হাবা, বোবা, পাগলা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। তবে তাঁদের ব্যবহারের সঙ্গে মহানাগরিক বা মন্ত্রীমশাইয়ের ব্যবহারকে কখনই সমগোত্রীয় বলা যাবে না। কারণ তিনি শারীরিক দুর্বলতাগুলিকে অপমানজনকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। জনসমক্ষে ওভাবে কথা বলা কার্যত অপরাধ।

আরো পড়ুন প্রতিবন্ধী মানুষের উপর আঘাত নামছে কলকাতার বুকে

বছর ছয়েক আগে পাস হওয়া ২০১৬ সালের এ ব্যাপারে তেমন আভাসই দিয়েছে। এই আইনে প্রথমবার স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত হয় প্রতিবন্ধকতার প্রতি বৈষম্যমূলক বা অপমানজনক ভাষার ব্যবহার একটি অপরাধ। আইনের ১২ক ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের প্রতি প্রকাশ্যে এমন কোনো মন্তব্য করেন বা এমন কাজ করেন যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে অপমানজনক, তাহলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সেই ব্যক্তির ছমাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা – দুটোই হতে পারে। সুতরাং মহানাগরিকের বক্তব্যের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আইনের সংস্থান ছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই নিয়ে রাজ্যে তেমন কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। এমনকি প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন মানুষের অধিকার বা স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলি কোনো অজ্ঞাত কারণে সম্পূর্ণ নীরব। ভারতের প্রতিবন্ধী মানুষদের সর্ববৃহৎ সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী শুধুমাত্র প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে একই অভিজ্ঞতা বারবার হচ্ছে।

আসলে স্বাধীনোত্তর ভারতের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ ভোট রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠতে না পারায় রাজনৈতিক দর কষাকষিতে অপারগ। আবার আমাদের দেশে সামাজিকভাবে প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সেবার ধারণা যুক্ত থাকায় অধিকারের চেয়ে দয়া, করুণার চেতনা বেশি সক্রিয়। স্বাধীনতার সাত দশক পরেও ভারতের আনুমানিক ১৫ কোটি (২০১৫ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী) মানুষের প্রতিবন্ধকতার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত ছিল না। তাছাড়া সংবিধানের ১৪ থেকে ১৮ নং অনুচ্ছেদে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সাম্যের কথা বলা হলেও শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার কথা অনুপস্থিত। সংবিধানের ৪১ নং অনুচ্ছেদে অবশ্য বয়স্ক, দুর্বল, অসুস্থ মানুষদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী মানুষকেও ‘সাধ্যমত’ সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এই ‘সাধ্যমত’ শব্দবন্ধের কারণেই হয়ত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ স্বাভাবিক অধিকার পাননি। তাই ভারত রাষ্ট্রের কাছে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের অধিকার এবং সমস্যাগুলি কোনো ইস্যুই নয়, আর রাজনীতির কারবারীরা অবলীলাক্রমে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষকে মনুষ্যেতর প্রাণি হিসাবে দেখতে পারে।

~ মতামত ব্যক্তিগত।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.