ইতিহাস চর্চা মূলত দুই ধরনের – লিখিত ও শ্রুত বা পুরান। এই নিবন্ধে মূলত লিখিত ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোর সুযোগ নিয়েই কিছু কথা আলোচিত হবে। কারণ স্মৃতি-শ্রুত ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিশাল এবং বৈজ্ঞানিকভাবে ইতিহাস লিখতে গেলেও তার উপাদান সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং বাছাই করার কাজ এত বিস্তৃত যে, ইতিহাসবিদেরাই এই ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গিয়ে আড়াআড়িভাবে বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত হয়ে যান।

 

কিন্তু লিখিত ইতিহাসই বা কম যায় কিসে? হাল আমলের কথাই ধরুন। ধরা যাক, ২১০০ খ্রিস্টাব্দে কোনও গবেষক নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুর আন্দোলন নিয়ে যদি ইতিহাস লেখেন, সেখানেও লিখিতভাবে পরস্পর বিরোধী অনেক উপাদান পাবেন। সেখান থেকে তাঁকে বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিসঙ্গত ভাবে উপাদানগুলিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। ইতিহাসবিদ এরিক হবসবমের ভাষায় “জাতীয়তাবাদী, মৌলবাদী মতাদর্শের জন্য মূল রসদ হলো ইতিহাস, ঠিক যেমন হেরোইন আসক্তির জন্য আফিম”। এইসব মতাদর্শের জন্য অতীত একটি জরুরি উপাদান। সম্ভবতঃ অপরিহার্য উপাদান। আর যদি পছন্দসই উচ্ছ্বল অতীত না থাকে, তবে বরাবরই তা বানানো হয়।

 

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম নিয়ে ইতিহাস লেখার সময় ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা পার্থ চ্যাটার্জিদের দ্বারা লিখিত ইতিহাস পাবেন, ঠিক তেমনই বামপন্থীরাও এই সময়ে উক্ত বিষয় নিয়ে যা লিখে গেছেন তাও পাবেন। পরস্পরবিরোধী এই উপাদানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উদারনীতিবাদী ঐতিহাসিক স্যার আরজি ভান্ডারকারের মত হল “অতীত সংক্রান্ত তথ্য পুনরুদ্ধার করতে হলে ঐতিহাসিক পদ্ধতিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা দরকার”। আবার ইপি থমসনের ভাষায় “অতীত থেকে জ্ঞান আহরণ করতে হয় ইতিহাসের যুক্তির নিজস্ব কঠোর পদ্ধতি এবং তার নিজের প্রমাণের আলাপের অনুসরণ করে, যাকে আমরা বলি “বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি”।

 

সত্যিই কি বাস্তবে আমরা এই কঠোর পদ্ধতি অনুসরণের লেশমাত্র দেখতে পাই? মাত্র দেড়শো বছরের পুরনো ইতিহাসে, রবীন্দ্রনাথকে না কবি, না সাহিত্যিক, না প্রাবন্ধিক, কোন কিছুতেই মান্যতা না দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ রাস্তার ধারে সুসজ্জিত হোডিং লাগিয়েছে। একই ভাবে সুভাষচন্দ্র বসু ও তাদের কাছে ব্রাত্য। আগামী দিনে যদি সুসজ্জিত এইসব ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ইতিহাস লেখার সুযোগ আসে তাহলে তা একপেশে হতে বাধ্য।

 

১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের কলকাতা স্থিত প্রধান বিচারপতি উইলিয়াম জোন্স এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারিং হেস্টিংস প্রতিষ্ঠা করলেন এশিয়াটিক সোসাইটি। সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরও জন্য ত্রিশেক কর্মচারী। তাই ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু শাসন ও মুসলমান শাসন — এরকম সাম্প্রদায়িক এবং ভ্রান্ত সময়কালে বিভক্ত করেন। যেমন ইতিহাসবিদ কেএম মুন্সি (একজন হিন্দু সাম্প্রদায়িক চিন্তাবিদ) ১৫২৬ সালে সুলতান মামুদ দ্বারা সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসকে “অবিস্মরণীয় জাতীয় বিপর্যায় যা হাজার বছর ধরে হিন্দু জাতীয় সম্মিলিত অবচেতনে দগ্ধ হয়ে ছাপ রেখে গেছে” বলে অভিহিত করেছেন আবার ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার এ ব্যাপারে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, “প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করা হতো এইসব প্রতিষ্ঠানের সম্পদ লুঠ করার জন্য”। ধ্বংসের ১৫০ বছর পর জনৈক হিন্দুরাজা মন্দিরটি পুনঃনির্মাণ করেন, “মামুদ এটিকে ধ্বংস করেছিলেন” বলে কোনোপ্রকার উল্লেখ না করেই। ২৫০ বছর পর স্থানীয় হিন্দু শাসক, স্থানীয় বণিক এবং পুরোহিতদের অনুমোদনে একই মন্দিরের জায়গীরের জমিতে “মসজিদ” নির্মাণের জন্য স্থানীয় এক মুসলমান ব্যবসায়ীকে জমি দেওয়া হয়। হয়ত এভাবেই বাবরি মসজিদের পাশে রামলালা বা কাশীতে বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরেই মসজিদের অবস্থান হয়েছিল।

 

অর্থাৎ, ঘটনা যা ঘটেছিল তার বিশ্লেষণ শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে বিকৃতি ঘটতে থাকে। এই বিকৃতি ঘটানো হয় মূলতঃ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেমন ইতিমধ্যেই রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, “অবতার” রূপে আবির্ভূত হয়েছেন কিন্তু বিদ্যাসাগর বা – রামমোহন নয়। এখন মহাত্মা গান্ধীকেও অবতার রূপে বর্ণনা করা শুরু হয়েছে। এগুলি সবই একটা বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে ইতিহাসকে নির্মাণ করা হয়। যেমন, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর RSS-র পাঠ্যক্রমে লেখা হয়েছে “বহিরাক্রমণ কারীরা একহাতে তরবারি অন্য হাতে কোরান নিয়ে এসেছিল। তাদের সামনে যে দেশ পড়েছে তা ধ্বংস হয়ে গেছে। দয়া এবং ন্যায় বিচার ছিল তাদের কাছে অজানা। এই রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়েই তারা NCERT/UGC/ICSSR/ICHR-এর মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে যোগ্য লোকেদের সরিয়ে নিজেদের পেটোয়া অযোগ্য লোকেদের বসিয়ে দেয়। এইসব নব্য ইতিহাসবিদদের পাল্লায় পড়ে অমর্ত্য সেন, কে আর নারায়ণের মতো পন্ডিত প্রবররা পরিচিত হচ্ছেন “হিন্দু বিরোধী ইউরো-ভারতীয় হিসাবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও পুরান নিয়ে নাড়াচড়া করে করিয়ে দেখিয়েছেন “গণেশের মাথায় তখন প্লাস্টিক সার্জারী” হয়েছিল বা আমাদের প্রাক্তন রাজ্যপাল ধনখড় সাহেবও “অর্জুন পারমাণবিক শক্তি সম্মিলিত ভিরের অধিকারী ছিলেন” অথবা কেএস সুদর্শন কীভাবে ঋষি ভরদ্বাজ ও রাজা ভোজ বিমানে নির্মাণ প্রক্রিয়া কত উচ্চতায় উড়লে কী জাতীয় সমস্যা হতে পারে এবং তার সমাধান কী আলোচনা করে গেছেন। সম্প্রতি ডারউইনের বিবর্তনবাদ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান এবং অচল বলে এই নিদান দিয়েছেন। তিন মাস জেল খাটা অমিত শাহ। সব মিলিয়ে, একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ইতিহাস নির্মিত হয়ে চলেছে।

 

শুধুমাত্র ভারতে ইতিহাস নিয়ে এই কচলাকচলি হয়েছে তা কিন্তু নয়। সারা পৃথিবী জুড়েই পরশ্রমভোগী রাজনীতিকরা এই কাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে করে চলেছে। নিকট অতীতে অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে যুগোশ্লোভিয়ার সেব্রেনিকা, যেখানে খ্রীষ্টান ও মুসলমানেরা এতদিন ধরে একত্রে শান্তিতে বসবাস করছিলেন, সেখানেই ৮০০০ বসনিয় মুসলিম গণহত্যার শিকার হন, কারণ চতুর্দশ শতকে মুসলিম তুর্কি ও খ্রিষ্টান সার্বদের মধ্যে হওয়া একটি যুদ্ধের স্মৃতি নির্মাণ এবং সেই অপমানের স্মৃতি কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।

 

তাই ধর্মকে অনুষঙ্গ করে ইতিহাস লেখার রীতি বহু পুরনো এবং বর্তমানে ইতিহাসের সীমা ছাড়িয়ে চলে এসেছে মানব সভ্যতার প্রতিটি দিক যার মধ্যে পড়ে অর্থনীতি, শ্রেণীবিন্যাস, নারীদের ইতিহাস এবং পরিবেশ এমন কি পুরাতত্ত্ববিদ্যা ও তার পদ্ধতি এবং হাতিয়ারগুলিকে আরো পরিশীলতা করে চলেছে। অতীতে বিভিন্ন পর্বে মানুষ কিভাবে মিলেমিশ হয়েছে জিন সংক্রান্ত বিদ্যা সে বিষয়ে নতুন নতুন জ্ঞানের উন্মোচন করেছে। এসবই ঐতিহাসিকদের কারখানার মাল-মশলা, যা সাধারণভাবে জাতিগত, ধর্মগত, জাতীয়তাবাদী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে । উল্টোদিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে আরএসএস পুরনো এবং কুসংস্কারের এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করে চলেছে।

 

অধ্যাপক হবসবমের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। “একমাত্র ইতিহাস, যা ইজরায়েল নিজের পক্ষে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপিত করতে পারে সেটি হল অন্তত দু হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস আর এ দু’হাজার বছর সময় কালের মধ্যে যা কিছু ঘটেছে, সে সমস্ত ইতিহাসকেই নানা কৈফিয়ৎ ও ফিকিরে এড়িয়ে চলে ইসরায়েল। কারণ এই সমস্ত ইতিহাস ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনকে এবং এই সময় ইজরায়েল যত যুদ্ধ করেছে তার কোন কিছুকেই যুক্তিগ্রাহ্য করতে পারেনা। জেরুসালেম চিরকালই ইহুদি ধর্মের প্রধান কেন্দ্র এবং সেই কারণে ইহুদি জনগণের রাজধানী ছিল এই যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আসলেই জেরুসালেমে অবস্থিত উপাসনা স্থলকে একটি আধুনিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এইসব কথা সাজিয়েই ইহুদিরা নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন এবং তাদের রাজধানী জেরুসালেমকে যুক্তি-গ্রাহ্য করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে”।

 

সবমিলিয়ে ইতিহাস নির্মাণের এক রণক্ষেত্রের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ইতিহাসকে ঘিরে এরকম রণক্ষেত্র তৈরীর উন্মাদনা আগেও দেখা গিয়েছে কিন্তু এমন আগ্রাসী ঠিক পুঁজিবাদ যেমন আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করেছে সাম্প্রতিক কালে। আসলে ইতিহাসই হল পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক অগ্রণী বাহিনী।

 

– মতামত ব্যক্তিগত

 

আরো পড়ুন:

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.