কলকাতা থেকে মোটামুটি ৪৫ কিলোমিটার পূর্বে অধুনা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্গত বেড়াচাঁপা-দেগঙ্গা গ্রামাঞ্চল। ১৯০৬ সালে এই অখ্যাত গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা স্থানীয় চিকিৎসক তারকনাথ ঘোষের মাধ্যমে একটা চিঠি পাঠান আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিসে। তাঁদের বক্তব্য, বেড়াচাঁপা গ্রামে এক দুর্গম জঙ্গল-ঘেরা জায়গায় কয়েকটা প্রত্নবস্তুর সন্ধান মিলেছে। এই জায়গাটার ইতিহাস ঘিরে নানা কিংবদন্তী উত্তরাধিকার সূত্রে স্মৃতিতে ধারণ করে আসছেন গ্রামের মানুষ। কিংবদন্তীতে ওই স্থানের নাম চন্দ্রকেতুগড়, অর্থাৎ চন্দ্রকেতু রাজার গড় বা দুর্গ। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক পরিদর্শন করা হলে এক প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ মিলতে পারে, এমনটাই জানানো হয় ওই চিঠিতে।
গ্রামবাসীদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আর্কিওলজিকাল সার্ভের পূর্বাঞ্চল শাখার সুপারিটেন্ডেন্ট লংহার্স্ট পরিদর্শনে এলেন বেড়াচাঁপায়। কিন্তু কোনো রকম খননকার্য করবার গুরুত্ব তিনি অনুভব করলেন না। এরপর ১৯০৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সম্পাদক এবং পুরাতত্ত্ববিদ নৃপেন্দ্রনাথ বসু এবং ১৯০৯ সালে খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (পরে যিনি মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করবেন) এই জায়গা পরিদর্শন করেন। রাখালদাসই প্রথম চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাচীনতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে এই জায়গা সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু সেসময় কিছু মূল্যবান প্রত্নবস্তু পাওয়া গেলেও কোনো উৎখনন করা হয়নি। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ওখানে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালানো হয় কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামের উদ্যোগে। কুঞ্জবিহারী গোস্বামীর নেতৃত্বে জয়নগর মজিলপুরের তৎকালীন জমিদার এবং পুরাতাত্ত্বিক কালিদাস দত্তের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উৎখনন চলে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তার ফলে কিংবদন্তীর চন্দ্রকেতুগড়ের বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ মিলল, তার প্রাচীনত্ব সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া গেল। জানা গেল, ভারতে মৌর্য শাসন প্রবর্তনেরও আগে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এখানে এক উন্নত নগরসভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। পাওয়া গেল প্রাচীন দুর্গনগরীর ভগ্নাবশেষ, কিংবদন্তিখ্যাত খনা মিহিরের ঢিবি সহ বিভিন্ন মুদ্রা, সিলমোহর, বাসনপত্র, দেবদেবীর মূর্তি, টেরাকোটার কাজ ইত্যাদি নানাবিধ প্রত্নবস্তু। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণার এক নতুন জানালা খুলে গেল।

তাম্রাশ্ম যুগের (আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নিদর্শন বর্ধমান জেলার পাণ্ডু রাজার ঢিবি খুব সম্ভবত বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতার চিহ্ন। সেই হিসাবে পাণ্ডু রাজার ঢিবির পরেই চন্দ্রকেতুগড় বাংলার সবথেকে প্রাচীন জনপদ। কিন্তু চন্দ্রকেতুগড় একা নয়, তার সমসাময়িক কালপর্বে উন্নত নগরসভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে অধুনা তমলুকেও, যার প্রাচীন নাম তাম্রলিপ্ত। চন্দ্রকেতুগড়ের সঙ্গে সেখানকার সাদৃশ্য দেখার মত। এমনকি খাস কলকাতার ক্লাইভ হাউসের ঢিবি থেকেও একই সময়কালের প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে। ২ জুলাই ২০২২ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে, এক সাম্প্রতিক খননকার্যে ক্লাইভ হাউস থেকে অন্তত তিন হাজার বছরের পুরনো পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এইসব অঞ্চলের মধ্যে কি তবে কোনো সম্পর্ক ছিল?
প্রাচীন গ্রিক ও রোমান লেখকরা ম্যাসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ সম্পর্কে যেসব বিবরণ লিখেছেন, তাতে বিপাশা নদীর পূর্বদিকে (পূর্ব ও মধ্য ভারতে) দুটো পরাক্রান্ত রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, একটি Prasioi (প্রাচ্য বা প্রাচী) ও অন্যটি Gangaridai (গঙ্গারিডাই)। এই গঙ্গারিডাই রাজ্যের উল্লেখ চীনা সাহিত্যেও মেলে। তার সঙ্গে মেগাস্থিনিস, ডিওডোরাস, স্ট্র্যাবো, প্লুটার্ক, টলেমি, প্লিনি, ক্লটিয়াস, সলিনস প্রমুখ গ্রিক ও রোমান লেখকদের লেখা মিলিয়ে পড়ে একথা স্পষ্ট বোঝা যায়, যে এই গঙ্গারিডাই (গ্রিক বর্ণনায় গঙ্গারিডি, Gangaridae) রাজ্য আর গাঙ্গেয় বঙ্গ অঞ্চল অভিন্ন। তাম্রলিপ্ত কিংবা চন্দ্রকেতুগড় এই গঙ্গারিডাই রাজ্যেরই বন্দর নগর ছিল, একথা আজ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল বন্দরনগর গঙ্গা বা গাঙ্গে, আর বেশিরভাগ ঐতিহাসিকই মনে করেন চন্দ্রকেতুগড়ই এই গঙ্গা নগর। সে কথায় পরে আসছি।
প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য থেকে গঙ্গারিডাইয়ের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা রীতিমত প্রশংসাসূচক। গঙ্গা ও তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে গ্রিস ও সমুদ্রপথে বাণিজ্য চলত। ডিওডোরাস বলছেন, ভারতবর্ষে বহু জাতির বাস; কিন্তু গঙ্গারিডাই জাতি সবার সেরা। এই রাজ্যের হস্তীবাহিনী আর যোদ্ধাদের বীরত্ব ও যুদ্ধকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের লেখায়। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর সুবিখ্যাত বাঙালীর ইতিহাস:আদিপর্ব বইতে নানা সূত্র থেকে প্রমাণ করেছেন যে প্রাচ্য (যা আসলে মগধ রাজ্য) ও গঙ্গারিডাই একসময় দুটো আলাদা রাজ্য ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ থেকে ৩০০ অব্দে এই দুই রাজ্য এক রাজার অধীনস্থ হয় এবং “একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়, যদিও তাহার পরে খুব সম্ভব দুই জনপদের সৈন্যসামন্ত প্রভৃতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল”।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম ‘বাঙ্গালার কলঙ্ক’ প্রবন্ধে গঙ্গারিডাই নামের বঙ্গীকরণের চেষ্টা করে গঙ্গারাষ্ট্র নাম রাখেন। পরে নানা ঐতিহাসিক গঙ্গাহৃদি, গঙ্গাঋদ্ধি প্রভৃতি নাম রেখেছেন। তবে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার বিচারে গঙ্গাহৃদি বা গঙ্গাঋদ্ধি নামগুলোর অর্থ হয় না। একথা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ প্রমাণ করেছেন। প্রবন্ধের আয়তন বৃদ্ধির আশঙ্কায় সেসব বিস্তারিত লিখছি না, উৎসাহী পাঠকরা গবেষক তমাল দাশগুপ্তের ‘গঙ্গারিডাই সপ্তমিথ’ প্রবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন। আমি গঙ্গারিডাই নামটাই ব্যবহার করছি।
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলার প্রাচীন সভ্যতার সম্পর্কে জানতে গিয়ে গ্রিক-রোমান লেখকদের বই দেখতে হবে কেন? প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে কি কিছু জানা যায় না? হতাশ হবেন কিনা জানি না, তবে কালিদাসের কাব্য ছাড়া আর কোনো সংস্কৃত গ্রন্থেই গঙ্গারিডাই সভ্যতার কথা মেলে না। খুব সম্ভবত বেদ, মহাভারত ইত্যাদির স্রষ্টা যে আর্য জাতি, তারা অনেক পরে বাংলায় প্রবেশ করেছে। পাণ্ডু রাজার ঢিবির আমলে বা গঙ্গারিডাই সভ্যতার সময়কালেও বাংলার জনসমাজ তৈরি হয়েছিল ব্রাত্য আর্য তথা আলপীয় (যারা নর্ডিক আর্যদের আগে ভারতে এসেছিল বলে মনে করা হয়), দ্রাবিড় এবং অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠীর মানুষের মিশ্রণে (ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন)। সেজন্যই হয়ত নর্ডিক আর্যদের লেখা বইতে গঙ্গারিডাই সভ্যতার বিবরণ নেই। না হলে এত উন্নত সভ্যতার বিবরণ না থাকার আর কী কারণ থাকতে পারে?
গঙ্গারিডাই সম্পর্কে এত বিস্তারিত বিবরণ দিলাম, তার কারণ এর ইতিহাস না জানলে চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাস বোঝা যাবে না।
চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাসকে দুভাগে ভাগ করে দেখা যায়। একটা অংশকে বলতে পারি তর্কাতীত ইতিহাস আর অন্য অংশকে বিতর্কিত ইতিহাস। চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত নানা প্রত্নবস্তুর ভিত্তিতে এর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, তাকে তর্কাতীত ইতিহাস বলাই যায়, কেন না এবিষয়ে প্রায় সব ঐতিহাসিকই একমত হয়েছেন। চন্দ্রকেতুগড় বন্দর নগর ছিল, কাজেই সেখানকার অধিকাংশ মানুষ সম্ভবত বণিক ছিলেন। এছাড়া টেরাকোটার কাজে কৃষিকাজ ও গোপালনের ছবি পাওয়া যায়। কৃষিকাজে সম্ভবত মেয়েরাও যোগ দিত, কেননা এক টেরাকোটা-চিত্রে দেখা যাচ্ছে মহিলারা সন্তান সামলাতে সামলাতেই ফসল ঘরে তোলার কাজ করছেন পুরুষদের সঙ্গে।

কথায় বলে “মাছে ভাতে বাঙালি”। বাঙালি জাতির পূর্বপুরুষ, চন্দ্রকেতুগড়বাসীর খাদ্য ছিল ভাত (ধান কাটার চিত্র পাওয়া যায়) এবং তার সঙ্গে মাছ। হস্তী ও অশ্ববাহিনী যুদ্ধে ব্যবহৃত হত সে তো গ্রিক-রোমান লেখকরা বলেই গিয়েছেন, এই ঘোড়া আর হাতি পরিবহনেও ব্যবহৃত হত। নদীমাতৃক সভ্যতায় নৌকাও ব্যবহার করা হত পরিবহণের জন্য। আরও পাওয়া গিয়েছে নৃত্যগীতের মাধ্যমে অবসর বিনোদনের চিত্র। বানর খেলা দেখানোর চিত্রও মেলে। প্রধানত আলপীয় আর্য ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মানুষ থাকতেন এখানে, কাজেই এই সমাজ পুরোপুরি মাতৃতান্ত্রিক না হলেও নারীর যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল বলেই মনে হয়।
এবার বিতর্কিত ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। বস্তুত, চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাসের বেশিরভাগটাই বিতর্কিত। স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তী আর প্রকৃত ইতিহাস এমনভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, যে আসল তথ্য নিরূপণ করা কঠিন হয়ে গেছে।
আরো পড়ুন সুরিনাম ঘাট: পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন
চন্দ্রকেতুগড়ের খনা মিহিরের ঢিবি এমনই এক বিতর্কের উৎসস্থল। খনা এবং বরাহমিহিরের কাহিনী অনেকেই জানেন, এই প্রবন্ধে তার পুনরুল্লেখের অবকাশ নেই। না জানা থাকলে পড়ে নিতে পারেন এই লিঙ্কে অথবা মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত খনা-বরাহ ছবিটাও দেখে নিতে পারেন। প্রচলিত কিংবদন্তী অনুযায়ী, চন্দ্রকেতুগড়ে খনা নিয়মিত আসতেন। এখন এই খনা যদি বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহিরের সঙ্গেই সম্পর্কিত হন, তবে তো তিনি গুপ্তযুগের মানুষ। অথচ আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে খনা মিহিরের ঢিবি পালযুগের স্থাপত্য। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলার বাইরে খনা কাহিনী প্রচলিত নয় কেন? গুপ্তযুগে তো বাংলা ভাষা ছিল না, তাহলে খনার বচনগুলো সব বাংলায় কেন? এমনকি খনার বচনে যে প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিচয় মেলে, তা-ও একান্তই বাংলার। তাহলে কি খনা আসলে বরাহমিহিরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নন, তিনি এই বাংলারই অধিবাসী? বিষয়টা এখনও গবেষণাসাপেক্ষ।
চন্দ্রকেতুগড়বাসীর ধর্ম, লোকাচারও কিছুটা বিতর্কের বিষয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে এই জায়গা থেকে কিছু অপ্সরা বা যক্ষিণীর মূর্তি পাওয়া গেছে, তাদের চুলে কাঁটার মত পাঁচটা আয়ুধ আছে। তাই একে পঞ্চচূড়া যক্ষিণী বলা হয়। এরকম মূর্তি বেড়াচাঁপার চন্দ্রকেতুগড় সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। কিন্তু কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এক নারীমূর্তিকেও পঞ্চচূড়া আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যার চুলে কিন্তু আয়ুধ পাঁচটা নয়, দশটা।


তমাল দাশগুপ্তের মত কয়েকজন গবেষক ওই মূর্তিকে দশভুজা দুর্গার আদিরূপ বলে প্রমাণ করতে চাইছেন। সেক্ষেত্রে চন্দ্রকেতুগড়বাসীদের শাক্ত বলা যায়। আলপীয় ও দ্রাবিড়দের মাতৃতান্ত্রিকতার দিকটা মাথায় রাখলে এই দাবি সংগত বলেই মনে হয়। তবে এই বিষয়টাও তর্কসাপেক্ষ। এছাড়া বৌদ্ধধর্মের প্রভাব পড়েছিল চন্দ্রকেতুগড়ে। বুদ্ধদেব বা বোধিসত্ত্বের মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে।

চন্দ্রকেতুগড়ের সবথেকে বিতর্কিত বিষয় জায়গাটার নাম। এই অঞ্চলে প্রচলিত কিংবদন্তী অনুযায়ী চন্দ্রকেতু রাজার নামানুসারে এই গড়ের নাম। এই চন্দ্রকেতু রাজার বাস্তব অস্তিত্বের তেমন প্রমাণ মেলে না, শুধু বিভিন্ন মুসলমানি কিসসা (গল্প) থেকে মধ্যযুগে পীর গোরাচাঁদ নামে এক মুসলিম ধর্মপ্রচারকের সঙ্গে চন্দ্রকেতুর সংঘর্ষের কথা জানা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গবেষক দিলীপকুমার মৈতের ইতিহাসে দেগঙ্গা বইটা পড়তে পারেন অথবা ইন্টারনেটে দেখে নিতে পারেন। এই কাহিনীর সত্যাসত্য জানা নেই, তবে পীর গোরাচাঁদ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামে আজও বেশকিছু মাজার রয়েছে। তাছাড়া বেড়াচাঁপা গ্রামের নামকরণেও পীর গোরাচাঁদের হাত আছে। তিনি নাকি লোহার বেড়ায় চাঁপা ফুল ফুটিয়েছিলেন বলে গ্রামের অমন নাম। দিলীপকুমার মৈতে চন্দ্রকেতুকে সেনবংশীয় রাজা বলে মনে করেছেন। এই কাহিনী থেকে এতদিন মনে করা হত, চন্দ্রকেতুগড় নামটা মধ্যযুগের। এর প্রাচীনকালে নাম ছিল গঙ্গা বা গাঙ্গে, যা ছিল গঙ্গারিডাই রাজ্যের রাজধানী। উপগ্রহ চিত্র থেকে জানা যায় চন্দ্রকেতুগড়ের পাশ দিয়ে আগে একটা নদী বইত, যার নাম বোধহয় দেবগঙ্গা। সেই থেকে দেগঙ্গা নামটা এসেছে।

কিন্তু ২০১৬ সালে আইআইটি খড়গপুরের ‘সন্ধি গবেষণা দল’ চন্দ্রকেতুগড় সম্পর্কে গবেষণা চালায়। ওই দলের প্রধান ডঃ জয় সেন দাবি করেন, মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা বইতে উল্লিখিত সান্দ্রোকোত্তাস (Sandrocottus) নামক রাজা, যাকে এতদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বলে মনে করা হত, তিনি আসলে চন্দ্রকেতু। অর্থাৎ মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত নন, চন্দ্রকেতু। এই দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হলে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে, আর তার কেন্দ্রে মগধ নয়, থাকবে বাংলা। তাছাড়া সেক্ষেত্রে চন্দ্রকেতুগড়ের নাম হয়ত চিরকালই চন্দ্রকেতুগড়ই ছিল, গঙ্গা বন্দর হয়তো অন্য কোনো আবিষ্কৃত বা অনাবিষ্কৃত প্রত্নস্থল; এরকম সম্ভাবনাও দেখা দেবে।
কিন্তু একটা কথা। সান্দ্রোকোত্তাসকে চন্দ্রকেতু বলে ধরে নিলে বাঙালি অস্মিতা কিছুটা পূরিত হয় হয়ত, কিন্তু এর সপক্ষে তেমন প্রমাণ দেখাতে পারেননি ডঃ সেন বা তাঁর সহযোগীরা। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বোক্ত প্রবন্ধটিতেই দেখা যাচ্ছে, নানাভাবে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে গঙ্গারিডাইয়ের রাজা অনন্তবর্মা কলিঙ্গদেশ জয় করেছিলেন, এবং সম্ভবত তা সান্দ্রোকোত্তাসের অনেক আগের ঘটনা। যদি ধরে নিই সান্দ্রোকোত্তাস গঙ্গারিডাই জাতিরই রাজা আর কলিঙ্গদেশও এই রাজ্যের অধীনস্থ ছিল, সেক্ষেত্রে সান্দ্রোকোত্তাসের সাম্রাজ্যে কলিঙ্গ অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা। কিন্তু চন্দ্রকেতুই যদি সান্দ্রোকোত্তাস বা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হন, তবে তো তাঁর সাম্রাজ্যে কলিঙ্গ ছিল না। অন্তত আমাদের জানা ইতিহাস তেমনটাই বলে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (তর্কের খাতিরে চন্দ্রকেতুর) পৌত্র অশোক আবার কলিঙ্গ জয় করেন। তিনি কি তাহলে নিজে গঙ্গারিডাই জাতিভুক্ত হয়ে গঙ্গারিডাই রাজ্যেরই অন্তর্গত কলিঙ্গ জয় করলেন? হিসাব মিলছে কি?
আসল কথা হল, চন্দ্রকেতু-সান্দ্রোকোত্তাস-চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে। অতএব শেষ কথা বলার সময় আসেনি।
চন্দ্রকেতুগড় থেকে অসংখ্য প্রত্নবস্তু উদ্ধার হয়েছে, কিন্তু তার অধিকাংশই চলে গিয়েছে নানা বিদেশি জাদুঘরে। অনেক প্রত্নবস্তু আবার পাচার হয়েছে বেআইনিভাবে। কিছু সংরক্ষিত আছে কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে। আর প্রায় ৫২৪টি প্রত্নবস্তু দিলীপকুমার মৈতের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। তাঁর ছেলে দীপন মৈতে সেগুলো সরকারকে দান করে ‘চন্দ্রকেতুগড় সংগ্রহশালা, বেড়াচাঁপা’ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। এখানে বলে রাখি, দীপন মৈতে, যিনি নিজেও একজন গবেষক, এই প্রবন্ধ রচনার জন্য নানা তথ্য জানিয়েছেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁর সাহায্য ছাড়া এ প্রবন্ধ লেখা হত না।
ছবি ইন্টারনেট থেকে
তথ্যসূত্র:
১) বাঙালীর ইতিহাস: আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়, দে’জ পাবলিশিং।
২) ইতিহাসে দেগঙ্গা, দিলীপকুমার মৈতে
৩) Chandraketugarh, A Synoptic collation of three researches by the SandHI Group, Indian Institute of Technology, Kharagpur.
৪) চন্দ্রকেতুগড়ের সমাজচিত্র: কেমন ছিলেন আমাদের পূর্বমানুষ, গঙ্গারিডাই জাতি? – ঋতুপর্ণা কোলে; সপ্তডিঙা কালীপুজো ১৪২৭ সংখ্যা।
৫) বাঙ্গালার কলঙ্ক – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।