দীর্ঘ ষোল বছর পর ভারত সরকার তার প্রতিবন্ধকতা নীতি নতুন করে প্রণয়ন করার কথা ভাবছে। ২০০৬ সালে যখন সরকার প্রথমবার প্রতিবন্ধকতা নীতি গ্রহণ করে, তখন বলেছিল পাঁচ বছর অন্তর তারা এই নীতির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করবে। বলাই বাহুল্য ন্যাশনাল ডিসেবিলিটি পলিসি রূপায়ণ হয়নি এবং সরকার মূল্যায়নও করেন। অথচ এই কয়েক বছরে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের অধিকারের আইন আমূল পাল্টে গেছে। যখন আগের নীতি গ্রহণ করেছিল সরকার, তখনকার আইন অনুযায়ী আমাদের দেশে সাত ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ চিহ্নিত করা যেত। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ ধরনের। পুরনো আইন রদ করে নতুন আইন আনার পিছনে যে মূল কারণ, তা হল ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অফ রাইটস অফ পার্সনস উইথ ডিসেবিলিটি। ২০০৭ সালে এই কনভেনশন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গ্রহণ করে এবং ভারত সরকার স্বাক্ষর করে। বাধ্য হয় দেশের অনেকগুলো আইন বদল করতে। তার মধ্যে মূল আইন অবশ্যই প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আইন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানাচ্ছে বিশ্বের অন্তত ১৫ শতাংশ মানুষের কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে। তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নিই সংখ্যাটা অত বেশি নয়, ভারতবর্ষের ৮-১০ শতাংশ মানুষের প্রতিবন্ধকতা আছে। তাহলেও কিন্তু দেশের প্রতিবন্ধী মানুষদের সংখ্যাটা কম নয়। ভারতবর্ষের মত জনবহুল দেশে যদি বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রতিবন্ধকতা থাকে, তাদের নিয়ে নীতি প্রণয়ন ও রূপায়ণ কি সরকারের জরুরি কাজগুলোর মধ্যে পড়ে না?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
গত মাসে ভারত সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রালয়ের ওয়েবসাইটে একটি খসড়া প্রতিবন্ধকতা নীতি আপলোড করে বলেন, দু সপ্তাহের মধ্যে এই বিষয়ে যুক্ত মানুষ যেন তাঁদের মতামত বা সংশোধনী জানান। এই খসড়া নীতি শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় আপলোড করা হয়। ভারত সরকার ভালভাবেই জানে, যে পরিসংখ্যান বলছে দেশের বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ থাকেন গ্রামাঞ্চলে এবং তাঁরা ইংরেজিতে লেখা খসড়া পড়তে পারবেন না। আসলে এইভাবে খসড়া প্রকাশ করে সরকার শহরের হাতে গোনা কিছু এনজিও-র মতামত জানতে চেয়েছেন। প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনে যে কর্মীরা যুক্ত, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই ইমেল করে জানান যে মাত্র দু সপ্তাহে এই কাজ করা সম্ভব নয়। তাঁরা এই খসড়া বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করার দাবি জানান, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ভিডিও করার দাবিও জানান। বেশি সংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে এই খসড়া পৌঁছে দেওয়া যে সরকারের দায়িত্ব তা-ও মনে করিয়ে দেওয়া এবং তাঁরা যেন মতামত জানাতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা যে সরকারের দায়িত্ব তা-ও মনে করিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীদের পরামর্শ অবশ্য সরকার মেনে নেয়নি, কেবল আরও এক সপ্তাহ বেশি সময় দেওয়া হয়েছে মতামত জানানোর জন্য। যে খসড়া আপলোড করা হয়েছে তা প্রায় একশো পাতার কাছাকাছি। এই দীর্ঘ খসড়া পড়ে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা খুবই হতাশ।
এই খসড়া সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কনভেনশন এবং এসডিজি (Sustainable Development Goals)-এর থেকে অনেকাংশ কপি করে লেখা। অথচ লক্ষ্যগুলো পূরণ করার পথ দেখানোর কোনো চেষ্টা করা হয়নি। সর্বোপরি প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে বাজেট বরাদ্দ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে এই খসড়া নীরব। এখানে কোনো কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়নি। এই নীতি গৃহীত হলে তার রূপায়ণের মূল্যায়ন কখন, কীভাবে হবে তা-ও বলা নেই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। আগের নীতিতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারীদের সম্পর্কে পৃথক অধ্যায় থাকলেও বর্তমান খসড়ায় তেমন কিছু নেই। বাদ গেছে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কথা। মানসিক স্বাস্থ্য আইনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র একবার, যদিও দেশে মনোসামাজিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
আরো পড়ুন প্রতিবন্ধীদের উপর আঘাত নামছে খোদ কলকাতার বুকে; সবাই উদাসীন
প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে নেই। নিজের নিজের মত করে তাঁরা এই খসড়া সম্পর্কে মতামত তৈরি করছেন। কেউ কেউ ছোট ছোট অধ্যায়ে ভাগ করে খসড়াটিকে হিন্দি, তামিল বা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এই খসড়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করছেন, মতামত বিনিময় করছেন। প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুক্ত করে স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, লিঙ্গ এমনকি জলবায়ু দূষণ সম্পর্কেও তাঁরা কী ধরনের সরকারি নীতি চান সেই দাবিগুলো এইসব আলোচনা সভা থেকে উঠে আসছে। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারী এবং এলজিবিটিকিউ মানুষের কথা এই নীতির খসড়া থেকে কথা বাদ গেল কেন – সে প্রশ্নও তুলছেন। ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর রাইটস অফ দ্য ডিসেবেল্ড বা নেটওয়ার্ক অফ ওম্যান উইথ ডিসেবিলিটি ইন্ডিয়ার মত বড় সংগঠনগুলো এই মতামত একত্র করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে।
এখানে বলা দরকার, সব আলোচনা সভাতেই একটা প্রশ্ন উঠে আসছে – এই খসড়া তো ইংরেজি ভাষায় লেখা। তা সত্ত্বেও কেন দিব্যাঙ্গ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে? ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিবন্ধী দিবস, অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর, হঠাৎই ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিব্যাঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করেন। #SayNoToDivyang হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বহু সংগঠন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তখন থেকেই সোশাল মিডিয়ায় তাদের আপত্তি জানাতে শুরু করে। দেশের রাস্তাঘাট প্রতিবন্ধীবান্ধব করার জন্য উপযুক্ত বাজেট বরাদ্দ না করে, প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য শিক্ষা, রোজগারের ব্যবস্থা সহজতর না করে তাদের হঠাৎ দিব্যাঙ্গ বলে ডাকা শুরু হল – এটা অনেক মানুষই প্রহসন বলে মনে করেন। তাদের কোন দিব্যশক্তি নেই। দৈব বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ প্রতিবন্ধকতার মত সামাজিক বিষয়ে নিয়ে আসা বিজেপি সরকারের আরেক ফন্দি বলে মনে করেন প্রতিবন্ধী আন্দোলনের অনেক কর্মী। তাঁদের লড়াই এই শব্দচয়নের বিরুদ্ধেও। লড়াইটা অবশ্য অসম। একদিকে শক্তিশালী মোদী সরকার, অন্যদিকে দেশের প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষজন। তাঁদের জীবনে না পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ। তবু তাঁদের লড়াই চলছে, চলবে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।